সিল্করুট

নীলের বিষ ও ডানলপ সাহেব

পান্না বালা


নীল চাষ দেশে এখন অতীতের একটি অধ্যায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ভূখণ্ডের মানুষের ভাগ্য বিপর্যয়ের পর উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নামে ব্রিটিশ রাজত্বের সূচনা ঘটে। বেশি লাভ এবং কৃষিনির্ভর অঞ্চলের মাটি নীল চাষের উপযোগী হওয়ায় ব্রিটিশ বেনিয়া গোষ্ঠী ধান, পাট বাদ দিয়ে কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করে। যেসব কৃষক নীল চাষ করতে অস্বীকৃতি জানান তাদের ওপর নেমে আসে সীমাহীন নির্যাতন।

কালের সাক্ষী হিসেবে বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নীল রাজত্বের নানা নিদর্শন। ফরিদপুর শহরের কমলাপুর লক্ষ্মীপুর এলাকায় নীলকুঠি ছিল। অবশ্য বর্তমানে সেই কুঠির কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে কুঠিবাড়ি কমলাপুর নামের আড়ালে রয়ে গেছে অতীত দিনের স্মৃতি। ফরিদপুর শহরে একটি মহল্লার নাম নীলটুলী এটি কুমার নদের পূর্ব ফরিদপুর খালের ( খালের বর্তমানে কোনো অস্তিত্ব নেই) দক্ষিণে অবস্থিত। ধারণা করা হয় নীল কেনাবেচা হওয়া নদীপথে বিভিন্ন জায়গায় পরিবহনের জন্য কালের বিবর্তনে এই মহল্লা নীলটুলী নামে পরিচিত। নীল চাষ বেঁচে আছে দীনবন্ধু মিত্রের রচিত অমর নাটক নীল দর্পণ-এ।

১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের কিছুকাল পর তত্কালীন বৃহত্তর ফরিদপুরের অংশ হিসেবে মাদারীপুরে নীল চাষ শুরু হয়। অঞ্চলটি নীল চাষের বিশেষ উপযোগী হওয়ায় ইংরেজরা নীলের ব্যবসা করে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার বাসনা নিয়ে অঞ্চলে নীল চাষ শুরু করেন।

ফরিদপুরের ডেপুটি জেলা কালেক্টর ডেলাতুর সে সময়ে তার সাক্ষ্যপ্রমাণে নীল কমিশনকে বলেছিলেন, এমন একটিও নীলের বাক্স ইংল্যান্ডে পৌঁছায় না যেটা মানুষের রক্তে রঞ্জিত নয়। ফরিদপুরের ডেপুটি কালেক্টর ডেলাতুর আরো বলেছেন, ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বহু রাইয়তকে আমার কাছে পাঠাতে দেখেছি যাদের এপিঠ-ওপিঠ বর্শাবিদ্ধ। অন্যদেরও বর্শাবিদ্ধ করে গুম করা হয়েছে। রকম নীলপদ্ধতিকে আমি রক্তপাত পদ্ধতি মনে করি।

ইন্ডিগো কমিশনের মতে, ১৮৪৯ সালে বাংলায় প্রায় ৫০০ নীলকর মোট ১৪৩টি ইন্ডিগো কনসাল- কাজ করত। ফার্মগুলোতে পৃথিবীর সর্বোত্কৃষ্ট নীল উৎপাদন হতো। বাংলার যে যে অঞ্চলে নীল চাষ হতো এবং যেসব স্থানে নীলের কারখানা স্থাপিত হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, বারাসাত, যশোর, খুলনা, বর্ধমান, বাকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম, হুগলি, হাওড়া, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, রংপুর, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহ ফরিদপুর।

অষ্টাদশ শতকে ফরিদপুরের মধুমতী, বারাশিয়া, চন্দনা প্রভৃতি নদীর তীরবর্তী উর্বর জমিতে নীল চাষ করা হতো। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার মীরগঞ্জে তখন প্রধান কুঠি স্থাপন করা হয়েছিল। বোয়ালমারী, মধুখালী, বালিয়াকান্দী অসংখ্য নীলকুঠি ছিল। প্রধান কুঠির অধীনে ৫২টি কুঠি ছিল। মীরগঞ্জ কুঠি ঘিরে গড়ে উঠেছিল বাজার। প্রধান ম্যানেজার ছিলেন ডানলপ। নীলকর ডানলপ চাষীদের বাধ্য করেন নীল চাষ করতে। নীল চাষে নিরুৎসাহীদের নীল কুঠিতে ধরে এনে অমানবিক অত্যাচার করা হতো। এমনকি হত্যা পর্যন্ত করা হতো।

জানা যায় এক বিঘা জমিতে নীল উৎপাদন হতো থেকে ১২ বান্ডিল। ১০ বান্ডিলের মূল্য ছিল এক টাকা। এই টাকা থেকেও কৃষকদের সামান্য কিছু দেয়া হতো। পক্ষান্তরে নীলকরেরা নীল রফতানি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করত। প্রতিটি কুঠি নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন ম্যানেজার থাকতেন। তাকে বলা হতো বড় সাহেব। বড় সাহেবের সহকারীকে বলা হতো ছোট সাহেব। দেশীয় কর্মচারীদের প্রধানকে বলা হতো নায়েব বা দেওয়ান। নায়েবের মাসিক বেতন ছিল ৫০ টাকা। নায়েবের অধীনে ছিল একজন করে গোমস্তা। গোমস্তারা বড় ছোট সাহেবের কথামতো চলত। তারা কৃষকদের ধরে এনে বেত্রাঘাত করত। এছাড়া কৃষকের মা-বোনদের কুঠিতে ধরে এনে নির্যাতন করত। এজন্য ইউরোপিয়ানরা নীলকে কৃষকের নীল রক্ত বলে চিহ্নিত করেছে।

অধুনা বৃহত্তর ফরিদপুরের দুই সন্তান হাজী শরীয়তুল্লাহ তার পুত্র দুদু মিয়া অত্যাচারী নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কৃষকদের নিয়ে গড়ে তোলেন বিশাল এক লাঠিয়াল বাহিনী। বিদ্রোহ একসময় গণআন্দোলনে রূপ নেয়, যা নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ১৮৩৮ সালে দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ব্রিটিশ নীলকরদের সঙ্গে কৃষকদের প্রচণ্ড লড়াই হয়। যুদ্ধে ডানলপ সাহেব আউলিয়াপুর নামক স্থানে পরাজিত হন এবং দলবল নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান। ডানলপ সাহেবের মৃত্যুর পর তাকে আলফাডাঙ্গার মীরগঞ্জে প্রধান কুঠির পাশে সমাহিত করা হয়। আগে এখানে নীল প্রস্তুতের জন্য চুল্লি, লম্বা চিমনি, সিন্দুক, নীল কারখানার গুদাম, ছোট-বড় পাকা দালান ছিল। এখন তা ধ্বংস হয়ে মাটিতে মিশে গেছে।

ঊনবিংশ শতকে নীলের চাষ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় এবং মীরগঞ্জের নীলকুঠিগুলো আস্তে আস্তে জরাজীর্ণ হতে থাকে। শেষ চিহ্ন হিসেবে পড়ে থাকে ডানলপ সাহেবের সমাধি। সমাধির গায়ে পাথরে খোদাই করা বাংলা ভাষায় কিছু লেখা আজও জ্বলজ্বল করছে।

সেই লেখাটুকু হুবহু নিম্নে দেয়া হলো, অকপট পরোপকার বিখ্যাত নীল শ্রীযুক্ত য়্যানেল কেম্পবল ডানলপ আয়ের নামক জিলার অন্তঃপতি ডন্ডন্যান্ড নগরে বাস করিয়া সন ১১৯৫ (বাংলা) সালে বঙ্গদেশে শুভাগমন করত মিরগঞ্জ প্রভৃতি নীল কুঠিতে ৬০ বৎসর পর্যন্ত অভিশয় যশঃপূর্বক স্বজীবিত কাল যাবত অতিবাহিত করিয়া সন ১২৫৫ সালে কাত্তিক মাসের শুক্রবারে স্বর্গ হইয়াছেন। বান্ধবগণ বেতনভোগী ব্যক্তিগণ চিরকাল তদ্বীয় গুনগান স্মরনাথ অর্থব্যয় দ্বারা স্ফোলিত পুস্তক স্থাপিত করিলেন।

মীরগঞ্জের এই সমাধি ছাড়াও বোয়ালমারীর বানচাকীতে ডানলপের মায়ের সমাধিসহ খরসূতী, ময়নার মদনধরি, কাদিরদী, সৈয়দপুর, নড়িখালীর নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ এখনো দেখতে পাওয়া যায়। নীলকরদের বিচিত্র ধরনের অত্যাচারের চিত্র সব জায়গায় একই ছিল। কিংবদন্তির মতো শোনা যায়, অবাধ্য চাষীর মাথার ওপর মাটি দিয়ে নীলের বীজ বপন করে গাছ বের না হওয়া পর্যন্ত নাকি দাঁড় করিয়ে রাখা হতো! আমঝুপি ভাটপাড়া নীলকুঠিতে এখনো নীল গাছ দেখা যায়। আগাছা নীলগাছ এখনো অতীতের নীলকরদের সেই ভয়াল অত্যাচারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নীলগাছ থেকে তৈরি রং নীল হলেও আসলে সেটি ছিল বাংলার চাষীদের বুকের পুঞ্জীভূত রক্তের জমাটবাঁধা কণিকা।

ইংরেজ আমলে গড়ে ওঠা সেই নীলকুঠিগুলো আজ কালের গর্ভে বিলীনপ্রায়। ইউরোপীয়দের দ্বারা বাংলায় নীল চাষের প্রবর্তন হয় এবং একশ বছর পর উনিশ শতকের শেষে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। নীলকরদের জন্য ব্যবসা লাভজনক হলেও চাষীদের জন্য ছিল ভয়াবহ অভিশাপ। কারণে নীল চাষের প্রতি চাষীদের ছিল অনীহা। ইচ্ছার বিরুদ্ধে নীল চাষ করানোর ফলেই ১৮৫৮ সালে নীল বিদ্রোহ দেখা দেয়। ক্রমে বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করে। ১৮৯৫ সালে নীল চাষের অবনতি ঘটে। এই নীল ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই একসময় গড়ে উঠেছিল অসংখ্য নীলকুঠি। নীল চাষ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নীলকুঠিগুলো পরিণত হয় পোড়োবাড়িতে।

 

পান্না বালা: প্রাবন্ধিক