সিল্করুট

কোম্পানি পেইন্টিং

এসএম রশিদ


অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ভারতীয় চিত্রকররা নতুন এক পৃষ্ঠপোষক শ্রেণী খুঁজে পেয়েছিলেনতারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা। নতুন পৃষ্ঠপোষকদের চাহিদা, রুচি অনুযায়ী চিত্রকররা কয়েক হাজার চিত্রকর্ম এঁকেছিলেন। চিত্রকররা পরিচিত হয়েছেন কোম্পানি স্কুল নামে আর চিত্রকর্মগুলোকে বলা হয় কোম্পানি পেইন্টিং, হিন্দিতে বলা হতো কোম্পানি কালাম

শুরুর দিকে অবশ্য ইংরেজ শিল্পীরাই ভারতকে আঁকছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর তারা বুঝতে পারলেন ভারতের বিষয়াদি স্থানীয় শিল্পীরাই ভালো বোঝেন, তাদের দিয়ে আঁকানোই শ্রেয়। অন্যদিকে ভারতীয় শিল্পীরা নতুন পৃষ্ঠপোষক খুঁজছিলেন। ব্রিটিশদের পছন্দসই বিষয় কৌশলে আঁকতে তারা প্রস্তুত ছিলেন। ভারতের নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে চিত্রকরদের জন্য স্থানীয় পৃষ্ঠপোষকতা ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছিল। ভারতের রাজনীতি ক্ষমতা কাঠামো যেভাবে বদলে যাচ্ছিল তার পরিষ্কার ছাপ পড়েছিল শিল্পের অঙ্গনেও।


১৮০৬ সালে ক্যাপ্টেন চার্লস গোল্ড তার ওরিয়েন্টাল ড্রইংস- লেম বেগার অ্যান্ড হিজ ফ্যামিলি শিরোনামের একটি চিত্রকর্মের কথা উল্লেখ করেছেন। এটি এঁকেছিলেন তাঞ্জোর মুচি নামে পরিচিত এক শিল্পী। শিল্পীদের বিবর্তন নিয়ে চার্লস গোল্ড লিখেছেন—‘ইউরোপীয়দের পরামর্শে স্থানীয় শিল্পীদের অনেকে প্রান্তিক জাত-গোত্রের মানুষের ছবি আঁকতে শুরু করেন। প্রত্যেক ছবিতেই একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে দেখা যেত। ইউরোপীয়রা চাইত ছবিগুলো পুরোপুরি বাস্তবের অনুগামী হোক। এক্ষেত্রে ভারতীয় সমাজকে বৈজ্ঞানিকভাবে অনুসন্ধানে এসব চিত্রকর্ম ব্যবহারের লক্ষণ স্পষ্ট হয়। একবার এক ইংরেজ দড়াবাজিকরদের ছবি আঁকার দায়িত্ব দেন এক শিল্পীকে। এজন্য তিনি শিল্পীর সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ থাকার জন্য দড়াবাজিকরদের একটি দলকে ভাড়া করেন। যেন তাদের কাছ থেকে দেখে শিল্পী নিখুঁতভাবে ছবিগুলো আঁকতে পারেন।

কোম্পানির এক কর্মকর্তা ছিলেন ক্লদ মার্টিন। ভদ্রলোকের বেশ আগ্রহ ছিল ভারতীয় শিল্প সংগ্রহের। রত্নখচিত, শিল্পকর্মের মতো তৈরি অনেক মোগল ড্যাগার, অস্ত্র তিনি সংগ্রহ করেন। এখানেই থেমে থাকেননি। তিনি ভারতীয় উদ্ভিদ, প্রাণী জনগণের নিত্যজীবনের ছবি আঁকতে পৃষ্ঠপোষকতা করেন অনেক প্রতিভাবান ভারতীয় শিল্পীকে। ১৭৭০-এর দশকে তিনি ভারতে ১৭ হাজার ইউরোপীয় জলরঙ পেপার আমদানি করেছিলেন ছবি আঁকার জন্য। তথ্যটি তার আগ্রহের পরিমাপক হিসেবে যথেষ্ট।

সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। ভারতের পথে পথে তারা নতুন ধরনের উদ্ভিদ, প্রাণী, প্রাচীন স্থাপনা, নতুন চেহারার মানুষ, পোশাক দেখতে পেলেন। নতুন দৃশ্য তার নিজ দেশের মানুষকে দেখাতে চাইলেন, কেউ চাইলেন নিজের ঘরে সাজিয়ে রাখতে। ঠিক এখনকার পর্যটকরা যেমন ভ্রমণে গেলেই ছবি তুলতে শুরু করেন, ঘটনাটা সে রকমই। আর তখন যেহেতু ক্যামেরা ছিল না, তাই কর্মকর্তারা ভারতীয় চিত্রকরদের নিযুক্ত করতেন সেসব দৃশ্যকে স্থায়ী করে তুলতে।

ইউরোপীয় স্টাইল আর সরঞ্জাম ব্যবহার করে তৈরি এসব চিত্রকর্মই ইতিহাসে কোম্পানি পেইন্টিং টেকনিকের দিক থেকে ভারতীয় শিল্পীরা গোয়াচ থেকে জলরঙে প্রবেশ করলেন। আরো যুক্ত হলো রৈখিক আঙ্গিক শেডিং। নন্দনতত্ত্বের দিক থেকে এগুলো থমাস উইলিয়াম ড্যানিয়েল ভ্রাতৃদ্বয়ের কাজের উত্তরসূরি।

কোম্পানি স্টাইলের চিত্রকর্ম ভারতের বিভিন্ন শহরে বিকশিত হয়েছিল। প্রত্যেক অঞ্চলের কাজের আবার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল, তাই সেগুলোকে আলাদা করা যেত। প্রত্যেক এলাকার স্টাইলে নিজ নিজ অঞ্চলের স্থানীয় ঐতিহ্যের প্রভাব দেখা যেত। কোম্পানি চিত্রকর্মের অন্যতম কেন্দ্র ছিল কলকাতা। শহরের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি (১৭৭৭-৮৩) লর্ড ইম্পে গভর্নর জেনারেল মার্কুয়েজ ওয়েলেসলি। এরা দুজনই অনেক পশুপাখি সংগ্রহ করেছিলেন এবং সেগুলোর ছবি আঁকতে নিয়োগ করেছিলেন স্থানীয় চিত্রকরদের। কলকাতায় স্থাপন করা ব্রিটিশদের বোটানিক্যাল গার্ডেনে জড়ো করা উদ্ভিদকুলের জন্যও একই রকম উদ্যোগ নেয়া হয়। ঘরবাড়ি, চাকর, ক্যারিজ গাড়ি, ঘোড়াসহ আরো যেসব বিষয় ব্রিটিশদের প্রিয় ছিল, সেগুলোই মূলত ফুটে উঠছিল ক্যানভাসে। এছাড়া বারানসি মাদ্রাজও ছিল দুটি বড় কেন্দ্র। দিল্লিতেও এমন চিত্রকর্মের বাজার বিস্তৃত হয় ১৮০৩ সালে ব্রিটিশরা শহরের দখল নেয়ার পর। বলাই বাহুল্য, শহরে থাকা মোগলদের বাদশাহি স্থাপনাগুলো ছিল চিত্রকর্মের জনপ্রিয় সাবজেক্ট। এখানকার শিল্পীরা অনেকে হাতির দাঁতের ওপর ছবি আঁকতেন।

শুরুর দিকে চিত্রকররা নির্ভর করতেন অল্প কয়েকজন পৃষ্ঠপোষকের ওপর। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ভিন্ন চিত্র দেখা গেলভারতীয় শিল্পীরা কিছু জনপ্রিয় বিষয়কে শনাক্ত করতে পারলেন। সেসব বিষয়ের ছবি তারা বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটে সহজেই বিক্রি করতে পারতেন। তাঞ্জোর, ত্রিচিনোপলি, দিল্লি, মুর্শিদাবাদ, পাটনা, কলকাতা, বেনারস লক্ষেৗয়ের শিল্পী পরিবারগুলো ছবি এঁকে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করতে শুরু করেন।

সময় পাটনার সেবক রাম ছিলেন ঘরানার গুরুত্বপূর্ণ একজন শিল্পী। তিনি ছিলেন দিল্লির গুলাম আলী খানের সঙ্গে সম্পর্কিত। পাটনা তখন কোম্পানি আর্টের বড় কেন্দ্র, কারণ সেখানে কোম্পানির অনেক ফ্যাক্টরি প্রাদেশিক কমিটির কার্যক্রম ছিল। রাম সেখানে ১৭৯০-এর দশকে হাজির হয়েছিলেন কাজের খোঁজে। ১৮২০ নাগাদ তার আঁকা বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের ছবি সংগ্রহ করেন লর্ড মিন্টো, লর্ড আর্মহার্স্টের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। দিল্লির গুলাম আলী খান ছিলেন গ্রামীণ দৃশ্য আঁকার জন্য বিখ্যাত, তার পরিবারের অনেক সদস্য বিখ্যাত হয়েছিলেন প্রতিকৃতি আঁকার জন্য।

কোম্পানি আর্ট ভারতের সব অঞ্চলে বিস্তৃতি পায়নি। যেসব স্থানে ব্রিটিশ পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো কিছু ছিল না, সেখানে কোম্পানি আর্ট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার শর্ত ছিল না। আবার রাজস্থান, হায়দরাবাদ কিংবা পাঞ্জাবে শক্তিশালী স্থানীয় পৃষ্ঠপোষক ছিল বলে সেখানেও কোম্পানি আর্ট অবস্থান তৈরি করতে পারেনি।

কোম্পানি পেইন্টিংয়ের উল্লেখযোগ্য শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন শেখ জয়েন উদ্দিন, ভবানী দাস, রাম দাম, শেখ মুহাম্মদ আমীর, ইল্লেপাহ গুলাম আলী খান। শিল্পীরা ইতিহাসে যথেষ্ট মূল্যায়ন কখনো পাননি। যদিও তাদের চিত্রকর্ম ইউরোপে বহু দামে নিলাম হয়, সেখানকার জাদুঘরগুলোর আদরণীয় সংগ্রহ হয়ে প্রদর্শিত হয়। ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ড্যালরিম্পল তাই কোম্পানি স্কুল শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে চান না। আমার মনে হয় ভুল পরিচয় হাজির করা কোম্পানি স্কুল কথাটিকে বিদায় জানানোর সময় হয়েছে। ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষক নয়, বরং চিত্রকর্মগুলোর স্রষ্টাদের প্রতি মনোযোগ দেয়া দরকার। সিস্টাইন চ্যাপেলের ছাদে থাকা চিত্রকর্মের দিকে তাকিয়ে কেউ পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসকে স্মরণ করে না, বরং এর শিল্পী মিকেলেঞ্জেলোকেই প্রশংসা করে।

কোম্পানি আর্টে যে কৌশল ব্যবহার হয়েছিল সেটিকে বলা যায় লক্ষেৗয়ি-মোগল ঘরানার ওপর ইউরোপীয় প্রভাব। গুঁড়ো রঙ ব্যবহার করা মোগল ঘরানার শিল্পীরা হাতে নিলেন ইউরোপীয় জলরঙ আর হোয়াটম্যান ওয়াটারকালার পেপার। মোগল মিনিয়েচারের ঐতিহ্য থেকে ফুটে উঠতে শুরু করল ইংরেজদের উদ্ভিদবিদ্যা টপোগ্রাফিক্যাল চিত্রকর্মের স্থিরচিত্র। রঙের ক্ষেত্রে মোগল মিনিয়েচারে উজ্জ্বল রঙের প্রধান্য ছিল। এবার ব্রিটিশদের পছন্দমতো সেখানে জায়গা করে নিল হালকা নীল, সবুজ সেপিয়া ওয়াশ।

ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকরা ভারতীয় চিত্রকরদের পারিশ্রমিক কেমন দিতেন? এর পরিমাণটা কখনো নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। আবার ব্রিটিশ চিত্রকরদের সঙ্গে তাদের পারিশ্রমিকের বৈষম্য কতটা ছিল সেটাও অজানা রয়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রে একমাত্র ভরসা এইচ জে নলটির ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট আর্ট? দ্য বোটানিক্যাল ড্রইংস অবশ্য ইনিও সরাসরি পারিশ্রমিকের কোনো হিসাব দিতে পারেননি। ভারতীয় শিল্পীদের দিয়ে উদ্ভিদের চিত্রকর্ম আঁকানোর একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জেমস কার। তার মৃত্যুর পর সংগ্রহের চিত্রকর্ম নিলামে ওঠে। ফুলের চিত্রকর্ম বিক্রি হয় গড়ে হাজার ৪০০ রুপিতে, মাছ ২০৫, জলাশয়ের পোকামাকড় ১১৮, পাখি বা উভচর প্রাণী ২৯০ রুপি। বলাবাহুল্য, এগুলো ছিল বাজারের মূল্য, এক্ষেত্রে শিল্পীরা কত পেতেন সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

কোম্পানি পেইন্টিং শুধু ভারত নয়, সঙ্গে তখনকার বার্মা, নেপাল শ্রীলংকায়ও বিস্তৃত হয়েছিল। কারণ ব্রিটিশ শাসন দেশগুলোয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়। ফটোগ্রাফির আগমন ধীরে ধীরে কোম্পানি পেইন্টিংয়ের গুরুত্ব হ্রাস করতে শুরু করেন।

 

এসএম রশিদ: লেখক