সিল্করুট

কী আছে ইম্পে অ্যালবামে?

ফজল হাসান


স্যার এলিজা ইম্পে ছিলেন কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি। তিনি তার স্ত্রী মেরি ১৭৭৭ থেকে ১৭৮২ সালের মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, প্রাণী এবং স্থানীয় গাছপালা তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে চিত্রিত করার জন্য দক্ষ অভিজ্ঞ চিত্রশিল্পী নিয়োগ করেছিলেন। তাদের মধ্যে তিনজন শিল্পীর নাম জানা যায়। তারা হলেন শেখ জয়েন উদ্দিন, ভবানী দাস রাম দাস। তারা তিনজনই আগে মোগলদের জন্য কাজ করেছিলেন। তাদের আঁকা চিত্রকর্মের সংগ্রহ ইম্পে অ্যালবাম নামে পরিচিতি লাভ করে। উল্লেখ্য, ইম্পে অ্যালবামে সংকলিত সব চিত্রকর্ম ১৭৭৭ থেকে ১৭৮৩ সালের মধ্যে আঁকা।

স্যার এলিজা ইম্পে লেডি মেরি ইম্পের পরিচয়


ভারতবর্ষে পদার্পণের আগে স্যার এলিজা ইম্পে ছিলেন লন্ডনের বিখ্যাত লিঙ্কন ইন-এর বিচারক। ১৭৭৩ সালে গৃহীত ইস্ট ইন্ডিয়া রেগুলেটিং অ্যাক্ট আইন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতবর্ষের আংশিক নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার প্রদান করে এবং পরবর্তী সময়ে বেঙ্গল সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠা করেছিল। স্যার এলিজা ইম্পেকে বেঙ্গল সুপ্রিম কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করে ১৭৭৪ সালের মার্চে কলকাতায় পাঠানো হয়। তাকে দায়িত্ব দিয়ে ভারতে পাঠানোর সময় নাইট উপাধি দেয়া হয়েছিল। তার আগে ১৭৬৮ সালে স্যার এলিজা লেডি মেরি ইম্পেকে (তার কুমারী নাম ছিল মেরি রিড) বিয়ে করেন।

বাংলা উর্দু শেখার জন্য ভারতে আসার সময় স্যার এলিজা তার সঙ্গে একজন মুন্সি নিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ফার্সিও শেখেন এবং একসময় ভারতীয় চিত্রকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সংগ্রহ করা শুরু করেন। ইম্পে দম্পতির বাড়িটি এমন একটি সভাস্থলে পরিণত হয়েছিল যে সেখানে তত্কালীন কলকাতার সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আগমন ঘটত এবং তারা শিল্প-সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়সহ ইতিহাস সাহিত্য নিয়ে আলোচনায় মশগুল হতেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে রাজা নন্দকুমারের বিতর্কিত বিচার ফাঁসি থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কারণ দর্শানোর জন্য স্যার এলিজাকে ইংল্যান্ডে ফিরিয়ে নেয়া হয় এবং তত্কালীন বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের (১৭৩২-১৮১৮) সঙ্গে একই অভিযোগে তাকে অভিশংসিত করা হয়। কিন্তু ১৭৮৮ সালে স্যার এলিজার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। অন্যদিকে ওয়ারেন হেস্টিংয়ের বিচার দীর্ঘ সময় চলেছিল। যাহোক, দুই বছর পরে (অর্থাৎ ১৭৯০ সালে) স্যার এলিজা ইম্পে নিউ রোমনি নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং সাত বছর সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৮০৯ সালে তার মৃত্যু হয়। এর নয় বছর পরে (১৮১৮ সালে) লেডি ইম্পে মারা যান।

নিচের ইম্পে পরিবারের চিত্রটি ১৭৮৩ সালে জার্মান নব্যতাত্ত্বিক চিত্রশিল্পী জোহান জোসেফ জোফানি (১৭৩৩-১৮১০) এঁকেছেন। উল্লেখ্য, ছবিটি আঁকা হয়েছিল ইম্পে পরিবার ভারত ছেড়ে যাওয়ার ঠিক আগে। ছবিতে দেখা যায়, কলকাতায় ইম্পে দম্পতির বাড়িতে তাদের বিনোদনের জন্য ভারতীয় একদল শিল্পী সংগীত পরিবেশন করছে এবং সংগীতের তালে তালে তাদের শিশুকন্যা মারিয়ান ইম্পে ভারতীয় নৃত্যের ভঙ্গিতে নাচছে।


ইম্পে অ্যালবাম সৃষ্টির নেপথ্য কাহিনী

ইম্পে দম্পতি ভারতে অবস্থানকালে প্রাপ্ত সুযোগ ভালোই কাজে লাগিয়েছিলেন। লেডি ইম্পে ধীরে ধীরে স্থানীয় উদ্ভিদ প্রাণিকুলের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন। তাদের বিশাল বাড়ির আঙিনায় ছিল প্রশস্ত বাগান। লেডি ইম্পে সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এবং বন্যপ্রাণী রাখার জন্য অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

একসময় ইম্পে দম্পতি সিদ্ধান্ত নেন, তারা তাদের অভয়ারণ্যে বিভিন্ন ধরনের পাখি এবং প্রাণীর ছবি আঁকিয়ে সংরক্ষণ করবেন। তাদের সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পাটনা থেকে তিনজন অঙ্কন শিল্পীকে নিয়োগ করেছিলেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রবীণ ছিলেন শেখ জয়েন উদ্দিন। তার দুই সহকর্মী ছিলেন ভবানী দাস রাম দাস। ভবানী দাস রাম দাস দুই বা তিন বছর পরে জয়েন উদ্দিনের সঙ্গে কাজে যোগ দিয়েছিলেন। তারা তিনজনই মোগল শিল্পকলায় প্রশিক্ষিত ছিলেন। তারা ইউরোপীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রকৃতিনির্ভর চিত্রের স্পষ্টতা প্রকাশ করতে এবং তাদের দক্ষতাকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

জানা যায়, লেডি ইম্পে ছিলেন ইম্পে অ্যালবাম-এর প্রধান চালিকাশক্তি। তিনি কাজের তত্ত্বাবধান ছাড়াও সহযোগী পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি চিত্রকর্মের শিরোনাম বা নামফলক এবং তারিখযুক্ত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। তিনি চিত্রকর্মের নিচে শিল্পীদের ফার্সিতে তাদের নাম স্বাক্ষর করার অনুমতি দিয়েছিলেন।


কী আছে ইম্পে অ্যালবামে?

ইম্পে অ্যালবামে চিত্রশিল্পীদের অঙ্কিত সর্বমোট ৩২৬টি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছিল। মূলত চিত্রকর্মের প্রধান বিষয় ছিল পাখি প্রাণী। সেসব চিত্রকর্ম ইংরেজি হোয়াটম্যান কাগজে আঁকা হয়েছিল। বেশির ভাগ ফল ফুলগাছের শাখায় চিত্রিত বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এঁকেছেন শেখ জয়েন উদ্দিন। তিনি সম্ভবত লেডি ইম্পের সঙ্গে পরামর্শ করে চিত্র অঙ্কন করেছিলেন। শেখ জয়েন উদ্দিনের উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে ১৭৭৭ সালে আঁকা Rufous Treepie and Caterpillar on a Branch এবং ১৭৭৯ সালে আঁকা Indian Roller on Sandalwood Branch উল্লেখ্য, বর্তমানে চিত্রকর্ম দুটি যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিস ইনস্টিটিউট অব আর্টসে সংরক্ষিত।

যাহোক, ফুল বা ফলের শাখা এবং গাছে পাতার পরিবর্তে পাখি নিয়ে শিল্পীর অন্যান্য অনুরূপ কাজ রয়েছে, যেমন A Sulphur-Crested Cockatoo on an Ashoka branch এবং A Grand Eclectus Parrot on a Mango Branch, উভয় ছবি ১৭৭৭ সালে আঁকা হয়েছিল। বলা হয়, A Sulphur-Crested Cockatoo on an Ashoka branch চিত্রকর্মটি শেখ জয়েন উদ্দিনের আঁকা সবচেয়ে সুন্দর এবং অন্যসব চিত্রকর্মের চেয়ে স্বতন্ত্র। ছবিতে কাকাতুয়া সবুজ পাতা হলুদ ফলের আকর্ষণীয় প্যাটার্নের সঙ্গে গাছের একটি ভাঙা শাখায় বসে আছে। তবে পাখিটি কোনো ভারতীয় পাখি নয় এবং সম্ভবত অস্ট্রেলিয়া বা নিউগিনি থেকে এসেছিল। বলা হয়, লেডি ইম্পে পাখিটি পোষা প্রাণী হিসেবে নিজের অভয়ারণ্যে লালনপালন করতেন। এছাড়া একইভাবে আঁকা Demoiselle Crane ভবানী দাসের অঙ্কিত চিত্রকর্মের মধ্যে অন্যতম, যা তিনি ১৭৮০ সালে এঁকেছিলেন। চিত্রকর্মটি কিছুটা ছোট এবং অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পাখির ধূসর পালক আঁকা হয়েছে। তার আঁকা অন্যান্য পশুপাখি চিত্রকর্মের মধ্যে Rhodonessa (গোলাপি মাথার হাঁস), বাঁদুড়, সাপ, ফড়িং মাছ উল্লেখযোগ্য।

ইম্পে অ্যালবাম কেন বিখ্যাত?

ইম্পে দম্পতি ভারতীয় শিল্পীদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে এসেছিলেন। যদিও তখন শিল্পীরা বিস্ময়করভাবে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, কিন্তু জলরঙের এক নতুন ধারার জন্য তাদের প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছিলেন না। ইম্পে অ্যালবামের মাধ্যমে শিল্পীরা মোগল প্রতিকৃতি ঐতিহ্য ব্যবহার করে তাদের নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন। উদাহরণ হিসেবে ইম্পে অ্যালবামে সংকলিত শেখ জয়েন উদ্দিনের কপারস্মিথ বারবেট চিত্রের কথা উল্লেখ করা যায়। কপারস্মিথ বারবেটের বিস্তারিত বর্ণনা, বিশেষ করে তার মোটা শরীর, ছোট ঘাড়, বড় মাথা, ছোট লেজ এবং ঝোপঝাড় শাখাযুক্ত গাছ চিত্রশিল্পীর নিখুঁত পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে।

মোগল প্রতিকৃতির বোধগম্য জ্ঞানের সঙ্গে চিড়িয়াখানায় বাস্তব জীবনে দেখা প্রাণীদের সংমিশ্রণে ইম্পে অ্যালবামের প্রকৃতিবাদী প্রাণবন্ত ছবিগুলো আঁকা হয়েছিল। বলা হয়, ইম্পে অ্যালবামের চিত্রকর্মগুলো ইউরোপীয় প্রাকৃতিক ইতিহাসবিষয়ক চিত্রকলার গতিপথ পরিবর্তন করেছিল। ভারত ছেড়ে যাওয়ার সময় ইম্পে দম্পতি পুরো অ্যালবাম লন্ডনে নিয়ে যান এবং অ্যালবামটি সেখানে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক শৈল্পিক আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।

বর্তমানে অ্যালবামের এক একটি ছবি সাধারণত নিলামে লাখ লাখ ব্রিটিশ পাউন্ডে বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইম্পে অ্যালবামের প্রায় ২০০ ছবি ভারতীয় চিত্রকলার সবচেয়ে বড় গৌরবের বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।


ইম্পে অ্যালবামের বিভিন্ন চিত্রকর্মের বর্তমান অবস্থান

জানা যায়, ১৮০৯ সালে স্যার এলিজা ইম্পের মৃত্যুর পর ইম্পে অ্যালবামের চিত্রকর্ম ১৮১০ সালের ২১ মে লন্ডনে নিলামে বিক্রি হয়েছিল। তাই ইম্পে অ্যালবামের সেরা ছবিগুলো বিশ্বজুড়ে ব্যক্তিগত সংগ্রহে বা জাদুঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টসহ বিভিন্ন দেশের একাধিক জাদুঘরে অনেক ছবি রয়েছে। সেসব ছবির মধ্যে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যালবার্ট জাদুঘরে (তিনটি), অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাডক্লিফ সায়েন্স লাইব্রেরিতে (১৮টি) এবং ওয়ার্ল্ড মিউজিয়াম ন্যাশনাল মিউজিয়াম লিভারপুলে রয়েছে চারটি। কথিত আছে, ইম্পে অ্যালবামের ৬৪টি জলরঙের ছবির জন্য ১৮৫৫ সালে মিসেস সারাহ ইম্পে লন্ডনের লিনিয়ান সোসাইটির কাছে অধিকারিত্ব ফিরে পাওয়ার দাবি জানিয়েছিল।

বিভিন্ন সময়ে ইম্পে অ্যালবামের ছবি দিয়ে বিভিন্ন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। অক্সফোর্ড শহরে অবস্থিত র্যাডক্লিফ সায়েন্স লাইব্রেরিকে দেয়া ১২টি ছবি (শেখ জয়েন উদ্দিনের ১১টি) অক্সফোর্ডের আশমোলিয়ান মিউজিয়াম ধার নিয়ে ২০১২ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৩ সালের এপ্রিলের মধ্যে লেডি ইম্পে ইন্ডিয়ান বার্ড পেইন্টিংস নামে এক প্রদর্শনীর অংশ হিসেবে দর্শকের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। এছাড়া ইম্পে অ্যালবামের প্রায় ৩০টি চিত্রকর্ম একত্রিত করে আরেকটি প্রদর্শনী (শিরোনাম: ফরগটেন মাস্টার্স: ইন্ডিয়ান পেইটিং ফর দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) লন্ডনের ওয়ালেস কালেকশনে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে খোলা হয়েছিল এবং প্রদর্শনী ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত চলার কথা ছিল। কিন্তু কভিড-১৯ মহামারীর কারণে -জাতীয় অনেক অনুষ্ঠানের মতো কর্তৃপক্ষ তা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল।

শেষ কথা

কথা সত্যি, ইম্পে অ্যালবাম ভারতের প্রাকৃতিক ইতিহাসের চিত্রকর্মের অন্যতম সেরা সংগ্রহ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তবে সমালোচক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অ্যালবামে সংকলিত আঁকা ছবিগুলোর জন্য শুধু লেডি ইম্পেকে বড় করে দেখানো উচিত নয়, বরং অঙ্কন শিল্পীরাও যথার্থ মূল্যায়নসহ স্বীকৃতি সম্মান পাওয়ার যোগ্য। বলাবাহুল্য, শিল্পীরা তা পাননি।

তবে লন্ডনের সথবি নিলামের ইসলামিক আর্ট বিভাগের প্রধান বেনেডিক্ট কার্টার মন্তব্য করেছেন, ইম্পে অ্যালবামে সংকলিত ছবিগুলো অবশেষে তাদের প্রাপ্য স্বীকৃতি পেয়েছে। ছবিগুলো আসলে অন্য ছবির মতো নয়। এগুলো শুধু ব্রিটিশ এবং অন্য ইউরোপীয় পৃষ্ঠপোষকদের জন্য আঁকা হয়নি, ছবিগুলো তাদের নিজস্ব সত্তায় মহান ভারতীয় চিত্রকলার উজ্জ্বল উদাহরণ।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: লেখায় ব্যবহূত সব তথ্য ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট, জার্নালে প্রকাশিত একাধিক গবেষণাপত্র উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত।

 

ফজল হাসান: লেখক অনুবাদক