সিল্করুট

বিস্মৃত মাস্টারপিস

উইলিয়াম ড্যালরিম্পল, অনুবাদ: আলী আমজাদ

শাহ বুর্জের নিচে বড় কামান। শিল্পী: সীতা রাম

জেমস বেইলি ফ্রেজার কলকাতায় জর্জ চিনারির অধীনে চিত্রকর্মে শিক্ষালাভ করেছিলেন। তিনি পুরনো মোগল কেতার চিত্রকরদের নতুন করে ডিটেলড ছবি আঁকায় পৃষ্ঠপোষকতা করেন। দিল্লি থাকাকালীন ফ্রেজার বেশ কয়েকজন শিল্পীকে মোগল স্থাপনা স্মৃতিস্তম্ভ প্রভৃতির চিত্র আঁকতে নিয়োগ করেন। চিত্রকর্মগুলোর সংকলন ফ্রেজার অ্যালবাম নামে পরিচিত। এটি বর্তমানে সর্বভারতীয় চিত্রকর্মের অন্যতম সেরা সংগ্রহ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। এর একটি পাতার দাম প্রায় আড়াই লাখ পাউন্ড। তবে ফ্রেজার বাদে অন্য আরো পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাদের ছিল নিজস্ব অ্যালবাম। এগুলোয় থাকা চিত্রের মধ্যে পাখি, গাছপালা, বাদুড়, বাঁদর, ইঁদুর, মাছ এমনকি শ্লথ পর্যন্ত দেখা যায়।

ওয়ালেস কালেকশন ওয়ান প্রদর্শনীতে কোম্পানি স্কুল পেইন্টিংস বলে পরিচিত প্রায় ১০০টি বৈচিত্র্যময় চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। বিশেষত ফরগটেন মাস্টার্স: ইন্ডিয়ান পেইন্টিংস ফর দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শিরোনামে প্রথমবারের মতো ফ্রেজার অ্যালবামের ছবিগুলো জনসমক্ষে আনা হয়। এর আগে ১৯৮০ সালে অ্যালবাম ভেঙে বিক্রি করা হয়েছিল ছবিগুলো।

প্রদর্শনীটি ১৭৭০-১৮৪০ সালের মধ্যবর্তী সময়ের ভারতীয় সেরা চিত্রকরদের কয়েকজনের চিত্রকর্ম প্রদর্শন করে। এদের মধ্যে শেখ জয়েন উদ্দিন, ভবানী দাস, বিষ্ণুপ্রসাদ, মানু লাল, সীতা রামের নাম সর্বাগ্রে আসে। বিস্ময়কর প্রতিভা প্রদর্শনকারী তাদের ছবিগুলোর মিশ্র বৈশিষ্ট্য ভারতীয় চিত্রশিল্পের শেষ সময়ের পরিচয় প্রদান করে। এর পরে প্রথমত পশ্চিমা চিত্রধারা ফটোগ্রাফি চলে আসার মাধ্যমে দুই হাজার বছরের ধারা লোপ পায়।

শিল্পীদের মধ্যে শিল্প ঐতিহ্যের বিস্মৃত বৈচিত্র্য দেখা যায়। এদের মধ্যে মোগল, মারাঠা, তামিল তেলেগু অঞ্চলের শিল্পীদের পাশাপাশি নানা জাত, সম্প্রদায় এমনকি মোগল দরবারি শিল্পী গুলাম আলী খানের চিত্রকর্মও ছিল। তার পরিবারও ফ্রেজার অ্যালবামের জন্য কাজ করেছে। এমনও শিল্পী ছিল যারা নিজেদের মুচি বলে পরিচয় দিয়েছে এবং সত্যিই তারা চামড়া শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল। শিল্পীদের কাজে লাগানোর ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্য দেখা যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নানা স্তরের কর্মচারী তাদের স্ত্রীরা শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এরা সবাই ভারতের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, ইতিহাস, স্থাপত্য, সমাজ এবং প্রকৃতি পরিবেশ নিয়ে আগ্রহ রাখতেন।

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো ব্রিটেনে অসংখ্য জাদুঘর ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় অসংখ্য শিল্পকর্ম থাকলেও কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতে কোনো শিল্প জাদুঘর তৈরি করা হয়নি। এর কারণ নন্দনতাত্ত্বিক নয় বরং রাজনৈতিক। ১৯৫০ ৬০-এর দশকে সাম্রাজ্যের চিত্রগুলো ব্রিটেনে অপছন্দনীয় হয়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী বেশির ভাগ ছবি সরিয়ে নেয়া হয়। কিছু ছবি সাম্রাজ্যের দূরতম কোণে পাঠানো হয়। দ্য রেমন্যান্ট অব অ্যান আর্মি এর মধ্যে অন্যতম। . ব্রাইটনের আঁকা লেডি বাটলারের জনপ্রিয় ছবিটি কাবুলের পশ্চাদপসরণের সময় (১৮৪২) অক্ষত থাকা একমাত্র চিত্রকর্ম। এটিকে সামারসেটে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সময়ে এসে ব্রিটেনে এমন কোনো গ্যালারি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যেখানে ঔপনিবেশিক সময়ের চিত্রকর্ম দেখা যাবে। পরবর্তীকালে ইতিহাসে সময়ের শিল্প পুরোপুরিভাবে অবহেলিত হয়েছে।

সম্ভবত প্রথমবার শিল্পকর্মগুলো উপযুক্ত মনোযোগ লাভ করছে। ফ্রেজার অ্যালবাম পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে এটি সম্ভব হয়েছে। প্রদর্শনীতে এটিই প্রাধান্য পাচ্ছে। ছবিগুলো অনেকটা প্যানোরমা আকারে মোগল আমল থেকে কোম্পানি আমল পর্যন্ত শিল্পের পরিবর্তন দেখায়। সময় ভারতের সংস্কৃতি তার জায়গায় থাকলেও ক্ষমতা রাজনীতি মোগলদের হাত থেকে কোম্পানির হাতে চলে যাচ্ছিল। ছবিগুলোয় মোগল বাঈজী, হিন্দু সাধুসন্ত, শিখ যুবরাজ, আফগান ঘোড়া ব্যবসায়ী স্থানীয় নবাবদের দেখা যায়। একটি চমত্কার ছবিতে গ্রামীণ মানুষকে দেখা যায়, যারা স্কিনারের ঘোড়সওয়ার বাহিনীতে নতুন যোগদান করেছে। সৈনিকদের দিল্লির আশপাশ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল।

আমরা এখানে এমনকি গ্রামীণ জীবনের চিত্রও পাই। উইলিয়াম ফ্রেজারের প্রধান উপপত্নী আমিবানের গ্রাম ছিল বর্তমান হরিয়ানার রানিয়া। গ্রামটির সঙ্গে ফ্রেজারের যোগাযোগ ছিল। অন্তত সাধারণ ঔপনিবেশিক চরিত্রের তুলনায় সে সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। ফ্রেজার অ্যালবামের প্রধান চিত্রকরের হাতে গ্রামীণ জীবন মানুষের স্পষ্ট চিত্র থেকে বোঝা যায় তা। অ্যালবামটি ফ্রেজার কলকাতায় তার ভাই জেমসকে পাঠিয়েছিলেন। পরিবারগুলোকে ফ্রেজার ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন বলে তিনি নিজ হাতে অ্যালবামে লিখেছেন, স্মৃতি, যা আমার হৃদয় ছেড়ে যাবে না কখনো।