‘হামিদ
মিয়া যে
মরছেন, ব্যাংকে
আঠারো লাখ
টাকা রাইখা
মরছেন, বুঝেন
অবস্থা!’ ‘কী
হইছিলো ওনার?’ ‘হাটেটাক।
পরশু রাইতে
হঠাৎ বুকে
বেথা উঠছে,
হাসপাতালে লওনের
পথেই নাকি
শ্যাষ।’ ‘যাক,
মরছেন কিন্তু
ফ্যামিলির লাইগা
উপায় রাইখা
গেছেন, কী
বলেন?’ চায়ের দোকানের
আড্ডাগুলোয় কখনো
প্রবেশ করা
হয় না।
নিজের মতো
যাই, সঙ্গে
কেউ পরিচিত
থাকলে কথা
চলে। কিন্তু
অচেনাদের সঙ্গে
পরিচিত হয়ে
ওঠা মুহূর্তের
জন্য, কেউ
কারো নাম
না জেনে
কিংবা কোথা
থেকে এসেছি,
এসব বাদ
দিয়েই বড়
আপন লোকের
মতো একে-অন্যের
গল্পে সায়
দেয়া, দ্বিমত
করা এগুলো
থেকে বঞ্চিত
বলতে পারতাম
নিজেকে। কিন্তু
জীবনে সামান্য
পরিমাণে যেসব
ব্যতিক্রম আসে,
তার একটা
ধরে ওই
পড়ন্ত বেলার
আড্ডাটিতে ঢুকে
পড়ি আমি।
আমার ভারিক্কি
ধরনের প্রশ্নে
মাঝবয়সী লোকটি
আমন্ত্রণের হাসি
ছুড়ে দেন। ‘বলেন
তো ভাই,
এই আঠারো
লাখ টাকা
জীবনভর জমাইয়া
মারা গেলেন
হামিদ মিয়া।
নিজে তো
সেই টাকা
কোনো কাজে
লাগাইতে পারলেন
না।’ ‘ঐটা
তো জমানি
টাকা। উনি
ফেলাট কিনছেন
তো। তার
এক পোলা
টেসটাইল ইঞ্জিনিয়ার।
চল্লিশ হাজার
বেতন পায়
মাসে। মাইয়া
ইন্টারে পড়ে।
ইস্কুলে পড়ে
ছোট পোলাডা।
এইগুলাও তো
লাইফের অর্জন,
নাকি?’ পাশ থেকে
আরেক লোক,
ইনি বৃদ্ধ,
ষাটের মতো
বয়স, মুখে
বিগত বসন্তের
মৃদু চিহ্ন
নিয়ে বলেন,
‘বুকে
কী জানি
ম্যাশিং বসায়
ঐ...’ ‘পেসমেকার?’ ‘ঐ
হইবো হইবো।
কিসব বসাইলে
নাকি আরো
কিছুদিন বাঁচতেন।
ডক্টার কইছিলেন।’ এবার প্রথম
লোকটি হতাশার
সুরে বলেন,
‘তা
কিন্তু ঠিক
কথা ভাই।
উনারে জিগাইলে
হাসছিলেন। বলছিলেন,
ওষুধ খাইয়াও
তো চলে।
খালি খালি
লাখ তিনেক
হাসপাতালে দিয়া
দিমু?’ চায়ের কাপে
চুমুক দিতে
দিতে আমরা
কিছুটা ক্লান্ত
যেন বোধ
করি অথবা
আমাদের ভেতরে
কিছু একটা
মুষড়ে পড়ে। ‘আঠারো
লাখ টাকা
রাইখা লাভ
আর কী
হইল? তৃতীয়
আরেকজন আমার
দিকে চেয়ে
বলে আসলেই।
মাইনষে নিজে
না খাইয়া
পোলাপাইনের ভবিষ্য
বানায়া দিয়া
যায়। এতে
লাভ আছে
কোনো?’ উপরের ঘটনাটা
উঠে এল
পুরনো স্মৃতি
থেকে, যখন
অনেক দিন
পর লেভ
তলস্তয়ের সেই
বিখ্যাত গল্পটা
আমি আবার
পড়ে উঠেছি—‘একজন
মানুষের কতটুকু
জমি দরকার?’ গল্পটা তলস্তয়
লিখেছিলেন ১৮৮৬
সালে। পাহোম
নামে এক
লোকের ঘটনা।
যে ছিল
একজন গ্রাম্য
কৃষক ও
পরে বেশ
অনেকটা জমির
মালিক। কিন্তু
একরৈখিক ধরনের
গল্পটিতে পাহোম
একটা ডিভাইস
মাত্র, আলাদা
কোনো সত্তা
না। পাহোমকে
তার পরিণতির
দিকে যা
টেনে নিয়ে
যেতে থাকে
তা হলো
অনিঃশেষ লোভ। উনিশ শতকে
নিশ্চয় মানুষের
জীবনযাত্রা অন্য
রকম ছিল।
পৃথিবী উন্মুক্ত
ছিল, মানুষের
সংখ্যা ছিল
কম। সে
আমলে লেখা
গল্পটিতে তলস্তয়
মানুষের লোভের
প্রকৃতির ব্যাখ্যা
করে দেখিয়েছিলেন।
সম্ভবত সবচেয়ে
সহজ উপায়ে
এবং একটা
নীতিশিক্ষার আবরণে।
যে গল্পে
আসল খেলোয়াড়
স্বয়ং শয়তান।
এ শয়তান
বস্তুটি আসলে
কী বা
কে? আর
এ একুশ
শতকে এসেই
বা মানুষের
লোভের প্রকৃতি
কেমন চেহারা
ধারণ করেছে? লেখার শুরুতে
যে ঘটনাটি
আমি উল্লেখ
করলাম, এমন
ঘটনা আমাদের
সবার জীবনেই
আছে কমবেশি।
আমাদের বাবা-চাচাদের
দিকে তাকালে
কিংবা নিজের
দিকেও, একজন
পরিপূর্ণ বা
প্রায় হয়ে
উঠতে থাকা
হামিদ মিয়াকে
আমরা দেখতে
পাব। এই
যে সন্তানদের
কথা মাথায়
রেখে অর্থ
জমাতে থাকা,
নিজের চাওয়া
পাওয়াকে তুচ্ছ
করে, এর
তো শেষ
নেই। ঠিক
কী পরিমাণ
অর্থ জমাতে
পারলে আমাদের
মনে হতে
পারে যথার্থ
সঞ্চয় হয়েছে?
উত্তরটা আমরা
দিতে পারব
না সহজে। এর মানে
আমাদের আকাঙ্ক্ষা
কোথায় গিয়ে
শেষ হবে,
তার তল
কিংবা ছাদ
আমাদের জানা
নেই, কিংবা
আমরা জানতেও
চাই না।
আর অর্জনের
পথে যেকোনো
বাধা যেকোনো
মূল্যে আমরা
জয় করতে
চাই, অনেকে
করিও। আমাদের
সময়ে এসে
বিষয়টা সম্ভবত
যেকোনো নৈতিকতা,
সামাজিকতা, মানবকল্যাণ—সবকিছুর
ঊর্ধ্বে উঠে
গেছে। সোস্যাল মিডিয়ায়
কিছুদিন পরপর
এমন অনেক
ঘটনা ভাইরাল
হয়। ধরা
যাক, তৃতীয়
বা চতুর্থ
শ্রেণীর কোনো
সরকারি চাকুরে।
কিন্তু তার
সম্পদের পরিমাণ
৫ হাজার
কোটি টাকা।
সংখ্যাটা কখনো
থামবে কিনা,
সে লোকটার
জানা নেই।
ঢাকায় তার
এপার্টমেন্ট বিল্ডিং
আছে ১০টা,
পাঁচটা আছে
পেট্রল পাম্প,
গোটা বিশেক
দামি গাড়ি।
এবং তার
বাড়ি যখন
তল্লাশি করা
হচ্ছে, দেখা
যায় তার
তোশক ভরে
আছে নগদ
টাকায়, ড্রামভর্তি
টাকা, সিলিংয়ে
লুকনো টাকার
স্তূপ। এত
টাকা দিয়ে
কী করবে,
জিজ্ঞাসা করলে
সঠিক কোনো
উত্তর কিন্তু
দিতে পারে
না লোকটা।
সর্বোচ্চ বলতে
পারে, সন্তানের
ভবিষ্যৎ গড়ে
দিয়ে যাচ্ছে। এই যে
মানুষের একটা
যাত্রা, একটা
প্রাপ্তির পর
আরো বড়
আকারের প্রাপ্তির
দিকে এগিয়ে
যাওয়ার তাড়না,
এটা মানুষ
কোত্থেকে পায়
বা কেন
পায়? অ্যারিজোনা
বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ববিদ
ভিক্টর শামাস
এ ব্যাপারে
বলেছিলেন, ‘লোভ
এবং ড্রাগ
প্রায় একই
পদ্ধতিতে কাজ
করে আমাদের
মনে।’ অর্থাৎ,
একটা ড্রাগ
নিতে থাকলে
আমাদের মস্তিষ্কে
সেই ড্রাগের
জন্য নির্দিষ্ট
চাহিদা তৈরি
হয়ে যায়,
অনবরত তা
যদি আমরা
নিতে না
থাকি, আমাদের
শরীর খারাপ
করবে, কিছু
ড্রাগের আসক্তি
এমন পর্যায়ে
যেতে পারে
যে সেটির
অভাবে আপনি
মারাও যেতে
পারেন। সম্পদ
বা বৈষয়িক
অর্জনের ক্ষেত্রেও
মানুষের এমন
আসক্তি তৈরি
হয়। কোথায়
থামতে হবে
তা যেমন
আমরা বুঝতে
পারি না,
কেন একটা
লক্ষ্যে আমরা
পৌঁছতে চাই,
একসময় সেই
কারণটাও অবসোলেট
হয়ে যায়।
চাহিদার প্রকৃতিই
এমন যে
লক্ষ্যগুলো সে
আমাদের মনে
গেঁথে দেয়
সাময়িক একটা
বন্দর হিসেবে।
সেখানে পৌঁছানোর
পর আমরা
আর থামতে
পারি না,
পরের বন্দরের
দিকে যাত্রা
করি। আলোচ্য গল্পের
পাহোমও এ
কাজই করে।
একসঙ্গে অনেক
জমির মালিক
হয়ে যাওয়ার
পরেও তার
মনে হয়
যথেষ্ট না।
আরো বেশি
জমি কীভাবে
পাব? এ
চিন্তায় সে
মানুষের কথায়
প্রলুব্ধ হয়।
আরো জমির
নেশায় সে
এমনকি এক
এলাকা থেকে
অন্য এলাকায়
পাড়ি জমাতেও
দ্বিধা করে
না। আগের
লব্ধ জমি
সে বেঁচে
দিয়ে নতুন
করে আরো
বেশি জমি
কেনার চেষ্টা
করে। গল্পের
শরীরে তার
স্ত্রী, সন্তান
কারো কথাই
আর যোগ
হয় না।
কারণ যে
গল্পটি শুরু
হয়েছিল একটা
অহংকার ও
শহুরে-গ্রাম্য
জীবনের তুলনাবোধ
থেকে, পাহোম
নিজের স্ত্রীর
কথায় নিজেকে
শান্তিকামী ও
সচ্ছল হিসেবে
উঁচুদরের সরল
মানুষ ভেবেছিল,
সে অহংকারটি
তাকে স্বয়ং
শয়তান বা
মানুষের অন্ধকার
প্রবৃত্তির ঘেরাটোপে
নিয়ে ফেলে। এখন আমাদের
পুরো আলাপের
আসল ব্যাপারটিতে
আসা যাক।
রচিত হওয়ার
প্রায় ১৩৫
বছর পরেও
লেভ তলস্তয়ের
এ নিতান্ত
সাদামাটা গল্প
কতটা প্রাসঙ্গিক?
যে গল্পে
কী হবে
আমরা আগেভাগে
অনুমান করতে
পারি, চরিত্র
হিসেবে পাহোম
বহুস্তরবিশিষ্ট না,
আখ্যানবস্তুও পরিণতি
প্রবণ—এ
যুগে এসে
কেন গল্পটি
আমরা পড়ব? ফিরে যেতে
পারি হামিদ
মিয়ার গল্পে।
ধরা যাক,
সে লোভী
না, সন্তানদের
একটা সুন্দর
আগামী উপহার
দেয়ার জন্যেই
লোকটা অর্থ
সঞ্চয় করেছিল
সেই পিঁপড়া
ও ঘাসফড়িংয়ের
উদাহরণ মাথায়
রেখে। নিজেকে
তার পরিশ্রমী
পিঁপড়া মনে
হতো। গোটা
গ্রীষ্মকাল পরিশ্রম
করে নিদারুণ
শীতে স্বস্তির
জীবন কাটানো
যার লক্ষ্য।
কিন্তু সারা
জীবনের সঞ্চয়
নিয়ে তার
শেষ হলো
কোথায়? মৃত্যু
এসে সবকিছুকে
অর্থহীন করে
দিল। এখানে,
আমাদের জানা
হয় না
জীবনভর হামিদ
মিয়া তার
সঞ্চয়ের পেছনে
কী কী
কর্ম করেছে।
কেউ নিশ্চয়তা
দিতে পারে
না যে
সে পাহোমের
মতো একটা
চাহিদার ড্রাগ
দিয়ে পরিচালিত
হয়নি। আপনি কি
নিজেকে কখনো
প্রশ্ন করেছেন
যে লক্ষ্যগুলো
নিজের জন্য
আপনি ঠিক
করেছেন, সেই
লক্ষ্যগুলো পূরণ
হয়ে গেলে
আর কী
করার থাকবে
আপনার? হয়তো
আপনি জানেন
না, কিন্তু
অন্যদের দেখে
আপনি ঠিকই
শিখে যান—সত্যিকার
লক্ষ্য বলে
আসলে কিছু
নেই, আমরা
মানুষ চলি
একটা স্টিমুলেশনের
ওপরে। আধুনিক
বিশ্ব নিজেও
যেই স্টিমুলেশনের
শিকার। অনবরত
তাকে পরবর্তী
গন্তব্যে রওনা
করতে হয়।
৫ হাজার
কোটি টাকা
যার আছে,
সে জানে
না এত
অর্থ দিয়ে
তার কাজ
কী, কিন্তু
সে তা
অর্জন করে
থেমে নেই,
আরো অর্জনের
তাড়না তার
আছে। কিন্তু
যার কিছুই
নেই, তার
কি অর্জনের
তাড়না নেই?
আমার ধারণা
আছে। আমাদের
সবার মাঝেই
সেই কৃষক
পাহোম ঘুমিয়ে
আছে। যে
ভাবে, তার
সীমিত আয়ে
সে তো
ভালোই আছে,
কিন্তু তার
যদি অনেক
টাকা থাকত,
সে পৃথিবীকে
বদলে দিত।
কিন্তু এ
বদলে দেয়াটা
পাহোমের মতোই
হয়, পৃথিবীকে
আসলে কেউ
বদলে দিতে
পারে না,
শুধু জীবনযাপনের
ধারাটা পরিবর্তিত
হয়। একজন মানুষের
ছয় ফুটের
বেশি জমি
আসলে লাগে
না মৃত্যুর
পর। নীতিকাহিনী
হিসেবে আমরা
তলস্তয়ের এ
গল্পকে এড়িয়ে
যাওয়ার চেষ্টা
করতে পারি,
কিন্তু এ
গল্পের এক
সামান্য ডিভাইস
পাহোম অমর,
যুগে যুগে
তার রাজত্ব,
তাকে আমরা
এড়াতে পারি
না। কারণ
আমরা নিজেরাও
পাহোম। তার
চেয়ে আমাদের
সুবিধা একটাই,
গল্পের পাহোম
নিজের পরিণতি
জানে না,
আমরা জানি,
কিন্তু আমাদের
গল্পের পরিণতি
কে বা
জানে?
এনামুল রেজা: গল্পকার ও প্রাবন্ধিক