বিশেষ সংখ্যা

শিক্ষানীতি: ইতিহাস ও পরম্পরা

গৌতম রায়


বাংলাদেশের শিক্ষানীতির ইতিহাস প্রসঙ্গে নিবন্ধে ব্রিটিশ পাকিস্তান আমলের নানা শিক্ষানীতি, শিক্ষা কমিশন শিক্ষা কমিটির প্রভাবগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হবে। আলোচনাটি প্রাসঙ্গিক। কারণ এর মাধ্যমে শিক্ষানীতির পরম্পরাটুকু অনুধাবন সহজতর হবে। শিক্ষানীতিকে কেবল কিছু ভালো নীতি, কৌশল, সুপারিশ কথামালার সংকলন হিসেবে চিহ্নিত করা ঠিক হবে না; বরং একটি দেশের শিক্ষানীতি অনুধাবন করতে হলে সে দেশের শিক্ষার ইতিহাস রূপান্তর এবং শিক্ষার সঙ্গে তত্কালীন রাজনীতির সম্পর্কগুলোও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন।

শিক্ষানীতির আনুষ্ঠানিক যে রূপের সঙ্গে আমরা বর্তমানে পরিচিত, ভারতীয় উপমহাদেশে তার প্রাথমিক ভিত্তি ঘটে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে। এটি মনে করার কোনো কারণ নেই যে উপনিবেশ স্থাপনের পর ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশরা স্থানীয় মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়েছে। ইতিহাস বরং সাক্ষ্য দেয়মূলত কোম্পানির কাজের জন্য সহায়ক জনগোষ্ঠী তৈরির প্রাথমিক উদ্দেশ্য নিয়েই তারা উপমহাদেশে শিক্ষার বিস্তারে মনোযোগী হয়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উপমহাদেশে তাদের শাসন শুরুর অনেক পরে শিক্ষার প্রসারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে; ততদিনে খ্রিস্টান মিশনারিরা ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি শিক্ষা সম্প্রসারণের কাজটিও করেছে। কোম্পানির শাসনামলে ১৮১৩ সালে প্রথমবারের মতো কোম্পানি সনদ আইন বা চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় শিক্ষার গোছানো প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করে। একই সঙ্গে, আইন উপমহাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার গতি-প্রকৃতি নিয়ে বিতর্কেরও সৃষ্টি করে। বিশেষত শিক্ষার উদ্দেশ্য, কারা শিক্ষা প্রদানের দায়িত্বে থাকবেন এবং শিক্ষার মাধ্যম কী হবেএসব বিতর্কের মাধ্যমে শিক্ষার সঙ্গে মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সম্পর্কগুলোও আলোচিত হতে শুরু করে।

শিক্ষা যে সমাজ ব্যবস্থা শাসন ব্যবস্থার বাইরে কিছু নয়, তার প্রমাণ পেতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৮৩৫ সালে লর্ড থমাস ম্যাকলে সরাসরি জানিয়ে দেন, কোম্পানির এমন কিছু ভারতীয় মানুষ প্রয়োজন যারা মূলত তাদের এবং কোম্পানি যাদের শাসন করে, অর্থাৎ ভারতীয়দের মধ্যকার যোগসূত্র হিসেবে কাজ করবে। মানে দাঁড়াচ্ছে, শিক্ষা বিস্তার তাদের মূল উদ্দেশ্য নয়; বাণিজ্যের স্বার্থে যতটুকু শিক্ষা প্রদান প্রয়োজন, কোম্পানি ততটুকুর আয়োজনই করবে। ম্যাকলে আরো জানান যে, মানুষগুলো শরীরে রক্তে হবে ভারতীয় কিন্তু চিন্তাচেতনায় হবে ব্রিটিশ। অর্থাৎ শুধু ভৌগোলিকভাবে নয়, মনোজগতে উপনিবেশ স্থাপনও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বড় উদ্দেশ্য। লক্ষ্যে ম্যাকলে ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার মাধ্যমে ভারতীয় জনগণের উন্নতির বদলে ভারতীয় জনগণকে শাসন শোষণে যারা নিয়োজিত ছিল, ম্যাকলে মূলত তাদের প্রয়োজনকে মুখ্য করে তুলেছিলেন। শিক্ষা নিয়ে কোম্পানির রকম নানা সিদ্ধান্তে একদিকে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে স্থানীয়ভাবে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে যেমন মূল্যহীন করে তোলা হয়েছিল; তেমনি এক দল কেরানি সৃষ্টির মাধ্যমে বিভাজনের পথটিকেও আনুষ্ঠানিক করে তোলা হয়। মানুষের বিকাশে নয়, শিক্ষা মূলত কিছু নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহূত হতে থাকে।

ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শিক্ষা নিয়ে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং সেগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হতে থাকে। যদিও ম্যাকলের শিক্ষানীতিকে অঞ্চলের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু ১৮৫৪ সালে চার্লস উডের তৈরীকৃত উড ডেসপ্যাচ অন এডুকেশনকে অনেকে ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষার ম্যাগনা কার্টা হিসেবে অভিধা দেন। কারণ উডের ডেসপ্যাচে প্রথমবারের মতো গোছানো শিক্ষাক্রমের আভাস মেলে। কথা অবশ্য একই সঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, কোম্পানির শাসনের সুবিধার্থে ভারতের শিক্ষাকে সাজানো হলেও ব্রিটিশদের মাধ্যমেই ভারতীয় উপমহাদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার কাঠামো রূপরেখার প্রবেশ ঘটে এবং কোথাও কোথাও তা ইতিবাচক হিসেবেই কাজ করে। ব্রিটিশদের প্রয়োজনের তাগিদেই ভারতজুড়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হতে থাকে, যা অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকেও ত্বরান্বিত করে। উডের ডেসপ্যাচ ভারতীয় উপমহাদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষাকে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত করে এবং বলা যায়, এর মাধ্যমে স্থানীয় শিক্ষা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সমাজ মানুষের চাহিদা পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে কেন্দ্র করে শিক্ষা আবর্তিত হওয়ার কথা; ব্রিটিশরা সেখানে সফলভাবে চাপিয়ে দেয়ার নীতি চুইয়ে পড়ার নীতিকে প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পর ব্রিটিশ সরকার অঞ্চলের শাসনের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেও শিক্ষার মূলনীতিগুলোতে তারা তাত্পর্যপূর্ণ কোনো পরিবর্তন ঘটায়নি। ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ১৮৮২ সালের হান্টার কমিশন, ১৯০৪ সালের লর্ড কার্জনের শিক্ষা সংস্কার, ১৯১৯ সালের স্যাডলার কমিশন কিংবা সর্বশেষ ১৯৪৪ সালের জন সার্জেন্ট স্কিম শিক্ষার উন্নয়নে নানা সুপারিশ সিদ্ধান্ত প্রদান করলেও সেগুলো মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষার বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছে।

দেখা যাচ্ছে, ব্রিটিশ শাসনামলে অত্যন্ত ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় স্থানীয় পর্যায়ের শিক্ষাকে পেছনে ঠেলে এবং স্থানীয় জ্ঞানকে গুরুত্বহীন করে অঞ্চলে পাশ্চাত্য শিক্ষাকে প্রধান করে তোলা হয়েছে। ভারতবাসীও ধীরে ধীরে এতে অভ্যস্ত হয়েছে কারণ সমাজ, রাজনীতি অর্থনীতির যে কাঠামো গড়ে উঠেছিল সে সময়ে, সেগুলোর সঙ্গে শিক্ষার কাঠামোকে সমলয়ে তৈরি করা হয়েছে। ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে গেলে সেই লয়ে আপাত ছেদ পড়ে সত্যি, কিন্তু দেখা যায়, পাকিস্তান আমলের শিক্ষানীতির ইতিহাস মূলত পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক শিক্ষার মাধ্যমে শোষণ করতে চাওয়ার ইতিহাস। ব্রিটিশ আমলের ২৯টি বড় শিক্ষা কমিশন বা শিক্ষানীতি মানুষকে যতটুকু না সরাসরি ক্ষুব্ধ, ক্রোধান্বিত প্রতিবাদী করেছিল, পাকিস্তান আমলের ছয়টি শিক্ষানীতি তার চেয়েও বহুগুণে বিদ্রোহী তরে তোলে মানুষকে। শিক্ষার মাধ্যমে কীভাবে একটি জনগোষ্ঠীকে দমিয়ে রাখার পরিকল্পনা করা যায়, তার উদাহরণ হতে পারে পাকিস্তান আমলের শিক্ষানীতিগুলো। ১৯৫১ সালের মওলানা আকরাম খান কমিটি, ১৯৫৭ সালের আতাউর রহমান খান কমিশন, ১৯৫৯ সালের এসএম শরীফ কমিশন, ১৯৬৬ সালের হামুদুর রহমান কমিশন, ১৯৬৯ সালের এয়ার মার্শাল এম নূর খান কমিশন কিংবা ১৯৭০ সালের শাসসুল হক কমিশনের কোনোটিই বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণীয় হয়নি। মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে রকম বড় ছয়টি কমিশন একাধিক ছোট কমিটি প্রণয়নের ইতিহাস আসলে শিক্ষার মাধ্যমে বৈষম্য সৃষ্টি শোষণ করতে চাওয়ার ইতিহাস তা প্রত্যাখ্যান করার ইতিহাস হিসেবেই চিহ্নিত হবে।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় ১৯৭২ সালে, . কুদরাত--খুদাকে প্রধান করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের তত্কালীন সীমিত সম্পদ, রাষ্ট্রীয় নীতি জনমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে কমিশন ১৯৭৪ সালে তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে রাজনীতির পরিবর্তন ঘটায় প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালের অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি কিংবা ১৯৮৩ সালের মজিদ খান কমিশন প্রতিবেদনের সুপারিশ মানুষের প্রতিবাদে বাস্তবায়ন হতে পারেনি। দুটোর কোনোটিই জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারেনি, উল্টো বৈষম্য সৃষ্টির নানা উপাদান ছিল এগুলোতে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে ১৯৮৮ সালের মফিজ উদ্দিন আহমদের কমিশন প্রতিবেদনের সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি। এর দীর্ঘদিন পর ১৯৯৭ সালে অধ্যাপক এম শামসুল হককে প্রধান করে যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি করা হয়, তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৯৯৯ সালের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি (খসড়া) তৈরি করা হয় এবং ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শিক্ষানীতি সংসদে গৃহীত হয়।

কিন্তু সেই শিক্ষানীতিও আসলে বাস্তবায়ন হয়নি বা হতে দেয়া হয়নি। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন শিক্ষা কমিশন গঠনের সংস্কৃতি তত দিনে বাংলাদেশের বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালে . এমএ বারীকে প্রধান করে নতুন কমিশন গঠন করা হয়। অবোধগম্যের কারণে পরবর্তী বছরই অর্থাৎ ২০০৩ সালে অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞাকে প্রধান করে নতুন আরেকটি কমিশন গঠন করা হয় এবং এই কমিশনের সুপারিশগুলোও বাস্তবায়ন করা হয়নি। সর্বশেষ ২০০৯ সালে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে প্রধান করে জাতীয় শিক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭৪ সালের শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন ২০০০ সালের শিক্ষানীতিকে ভিত্তি ধরে নতুন একটি শিক্ষানীতি তৈরির কথা এই কমিটিকে বলা হয়। সরকারের চাওয়া অনুসারে কমিটি যে প্রতিবেদনটি তত্কালীন সরকারের কাছে পেশ করে, সেটি কিছুটা সংশোধিত হয়ে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে শিক্ষানীতি হিসেবে গৃহীত হয়। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিই বাংলাদেশের দ্বিতীয় বর্তমান শিক্ষানীতি, যা ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কার্যকর রয়েছে। প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সরকার যেকোনো সময়ে প্রয়োজন অনুসারে শিক্ষা কমিশন বা কমিটি গঠন করতে পারে। কমিশন বা কমিটি তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেয়ার পর যখন সেটি রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত হয়, তখনই কেবল সেটিকে নীতি বলা যাবে; এর পূর্বে সেটিকে কেবলই কমিশন বা কমিটির প্রতিবেদন হিসেবে চিহ্নিত হবে।

বেশকিছু সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও ২০১০ সালে গৃহীত শিক্ষানীতির কৌশলগুলো সরকার বাস্তবায়ন করবে বলে আশা করা হয়েছিল, কিন্তু পর্যাপ্ত সময় পাওয়ার পরও কেন সেসব কৌশল বাস্তবায়ন করা হয়নি, তা বোধগম্য নয়। শিক্ষানীতি গৃহীত হওয়ার পর ২০১১ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন মনিটরিংয়ের জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। এসব কমিটির অধীনে অনেকগুলো উপকমিটি গঠন করা হলেও কেন শেষ পর্যন্ত সেগুলো কার্যকর হলো না, তাও রহস্যপূর্ণ। ২০১৮ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও অনেক বড় সুপারিশ ২০২১ সালেও বাস্তবায়ন হয়নি। শিক্ষানীতি অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত হওয়ার কথাসেটির অগ্রগতি নেই। শিক্ষানীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ রাখার ক্ষেত্রেও উন্নতি দৃশ্যমান নয়। শিক্ষা কার্যক্রম সুচারুরূপে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে শিক্ষা আইন তৈরির কথা বলা হয়েছিল। শিক্ষানীতি তৈরির পর পরই শিক্ষা আইন নিয়ে কাজ শুরু হয় এবং খসড়া শিক্ষা আইন তৈরি হলেও তা এখন পর্যন্ত গৃহীত বাস্তবায়ন হয়নি। দেখা যাচ্ছে, যে রকম গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষানীতিটি তৈরি করা হয়েছিল, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে তার চেয়েও বেশি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন যারা ক্ষমতায় এসেছে, পূর্ববর্তী সরকারের শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন বা শিক্ষানীতি তারা কারণে বা অকারণে বাতিল করেছে। কিন্তু যাদের নেতৃত্বে ২০১০ সালে শিক্ষানীতি তৈরি করা হলো, তখন থেকে এখন পর্যন্ত তারাই দেশ পরিচালনায় যুক্ত থাকলেও কেন নিজেদের তৈরি শিক্ষানীতির পুরোপুরি বাস্তবায়নে প্রত্যাশিত উদ্যোগ নেননিসেটি একটি বড় প্রশ্ন।

বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষানীতি সংস্কারের কথা বলেছেন। শিক্ষানীতি সংস্কারের ঘোষণা এক অর্থে অপ্রত্যাশিত। কেননা শিক্ষানীতির বড় বড় বিষয় যেখানে এখনো বাস্তবায়নই হয়নি, সেখানে সংস্কারের অর্থ হচ্ছে শিক্ষানীতিটিকে বর্তমান সময়ের উপযোগী না ভাবা। যদি তাই হয়, সেক্ষেত্রে শিক্ষানীতি সংস্কার না করে বরং পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে নতুনভাবে তৈরি করাই শ্রেয়। এদিকে শিক্ষানীতি সংস্কারের বা নতুন শিক্ষানীতি প্রবর্তনের আগেই ঘোষিত হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা। এভাবে কেন কাজটি করা হলো তাও স্পষ্ট নয়। সরকার যদি অদূর ভবিষ্যতে নতুন শিক্ষানীতি তৈরি করে, তাহলে পরিবর্তিত শিক্ষানীতির আলোকে পুনরায় নতুনভাবে শিক্ষাক্রম তৈরি করতে হবে। না হলে ঘোষিত শিক্ষাক্রমের রূপরেখা আদৌ নতুন শিক্ষানীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে কিনা সেটি বড় সংশয়!

শিক্ষার উন্নতিকল্পে বর্তমান শিক্ষানীতিতে অনেক ভালো ভালো নীতি কৌশল গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। বর্তমান নিবন্ধের শুরুতে শিক্ষানীতিকে কেবল কিছু কিছু ভালো নীতি, কৌশল, সুপারিশ কথামালার সংকলন হিসেবে না দেখার কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, শিক্ষানীতিকে দেখতে হবে শিক্ষার ইতিহাস, রূপান্তর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আবহে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করার পরও একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে নির্ধারিত শিক্ষানীতি অনুসারে চলতে পারে না, সেখানে আলাদাভাবে শুধু শিক্ষানীতি নয়, গভীরভাবে ভাবা প্রয়োজন শিক্ষার প্রতিটি উপাদান নিয়েই।

 

গৌতম রায়: সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়