সিল্করুট

৬৩৪ বছরের রাজভাষা ফারসি

এমএ মোমেন


সোহরাব কিংবা রুস্তম, নূরজাহান কিংবা দিলরুবাবাঙালি তরুণ কিংবা তরুণীর নাম হতেই পারে; কারো পরনে আচকান কালো সালওয়ার থাকতে পারে; কারো বাবা পাদশাহ, কারো বাবা দারোগা হতে পারেও; কেউ বিরিয়ানি গোশত, কেউ কাবাব কিমা, কেউ হালুয়া মোরব্বা, কেউ কিশমিশ পেস্তা খেতে পারে; কেউ খরগোশ কেউ কবুতর পুষতে পারে; কারো বাবা মা, কারো দোস্ত ইয়ার থাকতে পারে; কারো সিনা টান, কারো খাড়া গর্দান থাকতে পারে; কারো গোলাপ পছন্দ, কারো আতর; কেউ মসজিদে, কেউ দরগাহে যেতে পারে; কারো কারখানা, কারো বালাখানা থাকতে পারে; কেউ পরহেজগার, কেউ গোনাহগার হতে পারে; কারো আতশবাজি, কারো সেতারের টুংটাং ভালো লাগতে পারেএকটি ভাষা যদি রাজভাষা হিসেবে পুরো ৬৩৪ বছর রাজত্ব করতে পারে তাহলে তো এমন ঘটতে পারে। যে টা বিষয় বলা হলো তার প্রতিটিই ভারতবর্ষে, আরো সুনির্দিষ্টভাবে বাংলায় আমদানি করা ভাষা। ১২০৩ থেকে ১৮৩৭ সালের মধ্যে বাংলা ভাষায় নিজের অবস্থান করে নিয়েছে শব্দগুলো। রক্ষণশীল ভাষা পণ্ডিতরা এই সাদর আমদানি কিংবা বলপূর্বক চেপে বসা ফারসি ভাষার শব্দগুলোকে যেভাবেই দেখুন না কেন বাংলা ভাষায় আত্মীকৃত হওয়াতে বাংলার এমন কোনো ক্ষতি হয়নি, বাংলায় ধারণক্ষমতা বেশি হলে আরো বেশি শব্দ ধারণ করতে পারত। যে ভাষায় বিরিয়ানির মতো লোভনীয় শব্দ থাকতে পারে, অবশ্যই নমস্য সে ভাষা। ১২০৩ সালে দিল্লির সম্রাট কুতুবউদ্দিন আইবেকের প্রধান সেনাপতি তুর্কি-আফগান বংশোদ্ভুত ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির নদিয়া, গৌড় এবং পরে বাংলা বিজয়ের মধ্য দিয়ে অঞ্চলে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের শাসন শুরু হয়, ইসলাম ধর্মগ্রহণ গতিশীলতা পায়, রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ফারসি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় সব মাদ্রাসায় ফারসি পাঠ শুরু হয়, অষ্টাদশ শতকে ফারসি পত্রিকাও শিক্ষিত বাঙালির আদরণীয় হয়ে ওঠে। ফারসি সাহিত্যের সুখ্যাত নাম জালালুদ্দিন রুমি, ফেরদৌসি, হাফিজ, ওমর খৈয়াম, সাদি সিরাজি, নিজামি গঞ্জাবি, রুদাকি, শামস তাব্রিজি, খাকানি জামি প্রমুখ ভাষা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করেন। মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠাপোষকতা অবশ্যই অনস্বীকার্য। ভারতবর্ষ, বাংলা এবং ঢাকার ইতিহাস জানতে হলেও ফারসি গ্রন্থ নির্ভর হতেই হয়। বাংলা সাহিত্য বাংলা ভাষায় ফারসি প্রভাব ছিল অনিবার্য এবং বাংলা সেই প্রভাবের অনেকটাই আত্মস্থ করে নিয়েছে। ইংরেজ শাসন এবং শাসকদের মুসলমান বিরোধিতার চূড়ান্ত পরিণতি ১৮৩৭ সালে রাষ্ট্রীয় কাজে ফারসির ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা। ফারসির পুনর্বহালের জন্য তখন যে আবেদন পড়ে তার অধিকাংশই ছিল হিন্দু কর্মজীবী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আসা। ঔপনিবেশিক শাসনের সুবিধার জন্য শাসকদের ইংরেজিই দরকার ছিল, তারা ইংরেজিই প্রতিষ্ঠা করেছে। ইংরেজি ভাষাই এখন অন্যসব ভাষাকে হটিয়ে দিয়েছে। শুধু ভারতবর্ষে কেন খোদ পারস্য বা ইরানেও ফারসির ব্যবহার অনেক কমে এসেছে।

রামমোহন রায়ের ফারসি চর্চা

বাংলা ভাষা তখনো বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার যোগ্য ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি। রামমোহন রায় লিখলেন: আঠার শতকের অন্ধকারে বাংলাদেশ তখন আচ্ছন্ন। ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে আসীন সমাজপতির রক্তচক্ষুর কাছে ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত। ভক্তির অন্তরালে মানুষের ভয়ই ভারি সর্বনাশের কবল থেকে পরিত্রাণের জন্য ধর্মের মন্দিরে নৈবদ্য সাজাতে ব্যস্ত। স্বাধীন চিন্তা অথবা বিচার সেথা নৈব নৈব চ। রামমোহনকে তাই নিজের কথা বলার জন্য ভিন্ন ভাষার আশ্রয় নিতে হলো। ১৮০৩-০৪ সালে তিনি লিখলেন তুহফাৎ-উল-মুয়াহিদীন’—গিফট টু দ্য মনোথেয়িস্টস (একেশ্বরবাদীদের জন্য উপহার); বইটি লিখলেন ফারসি ভাষায়, আর বইয়ের ভূমিকা আরবিতে। বইতেই উল্লেখ করেছেন মানজারতুন আদিয়ান নামে একটি ফারসি গ্রন্থ আরো আগেই তিনি রচনা করে রেখেছেন। তুহফাৎ গ্রন্থ রচনার সময় তিনি বাংলাদেশের ঢাকায় উডফোর্ডের একজন কর্মচারী হিসেবে কিছুকাল চাকরি করেছেন। বইয়ের কাহিনী শোনানো নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য এটা জানানো যে প্রথম আলোকিত বাঙালি (এনলাইটেন্ড) রাজা রামমোহন রায় বই লেখার জন্য ফারসি ভাষার ওপর নির্ভর করেছেন, কারণ বাংলা গদ্য তখনো বিকশিত হয়নি। রামমোহনকে উপলক্ষ করে এমনকি উনিশ শতকের প্রথম ভাগেও ফারসি ছিল শিক্ষিতজনের ভাষা, চাকরিজীবীর ভাষা, জ্ঞান অন্বেষণের ভাষা, অর্থকরী ভাষাফারসি ভালো জানলে দোভাষী হিসেবে স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করা যেত।

মদনমোহনের রামমোহন: সময়-জীবন-সাধনা গ্রন্থ থেকে তখনকার শিক্ষাব্যবস্থার একটি চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে:

সে যুগে শিক্ষার স্থান ছিল প্রধানত তিনটিগুরু মশাই এর পাঠশালা, ভট্টাচার্যের চতুষ্পদী আর মৌলভিদের মক্তব। পাঠশালার শিক্ষার মান ছিল একান্তভাবে সাধারণ। কিছু অংক আর কিছু পত্রলিখন প্রণালির মধ্যেই এর ক্ষেত্র সীমিত। সাধারণভাবে শিক্ষাই বরাদ্দ ছিল সবার জন্য। এরপর যারা ব্রাহ্মণ সন্তান তারা যেতেন ভট্টাচার্যের চতুষ্পদীতে। সেখানে সংস্কৃত শিক্ষা দেয়া হতো। এছাড়া যারা বিষয়ী পরিবারের সন্তান তাদের পথে আরবি ফারসি ভাষা শিক্ষা অপরিহার্য ছিল। তখন কোর্ট কাচারি সর্বত্রই উভয় ভাষার চলন। ব্যবহারিক জীবনে ছিল এর প্রচুর দাম। তাই এদের মৌলভিদের মক্তবে শিক্ষাগ্রহণ করতে হতো। রামমোহন বাঙালি, ব্রাহ্মণ বিষয়ী ঘরের সন্তান, তাই পাঠশালা চতুষ্পদী এবং মক্তব তিনটি স্থানেই তিনি শিক্ষা লাভ করেন।

রামমোহন রায়ের ফারসি গ্রন্থটি রচনার ৮০ বছর পর ঢাকা গভর্নমেন্ট মাদ্রাসার সুপরিনটেনডেন্ট মৌলভি ওবেদুল্লাহ ১৮৮৪ সালে গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন এবং আরো ৬৫ বছর পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দাস অনূদিত বাংলা সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

ফারসি ডায়েরি থেকে ১৯১৮

ফারসির চর্চা ঢাকা শহরে এমনকি ১৯৬০ দশকেও হয়েছে। ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা মওদুদের ফারসি ডায়েরি থেকে উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক হবে। অনুপম হায়াৎ এর নওয়ার পরিবারের ডায়েরিতে ঢাকার সমাজ সংস্কৃতি ১৯০৪-১৯৩০ থেকে কয়েকটি দিন তুলে ধরছি।

২০ ফেব্রুয়ারি ১৯১৮: আজ বুধবার ফাল্গুন ১৩২৪ বঙ্গাব্দ। খাজা মওদুদ লিখেছেন, আজ পল্টনে টেনিস খেলার টাইব্রেকারে ড্র হয়। রাতে তিনি খাজা আতিকুল্লাহর সঙ্গে ছোট মিয়া অর্থাৎ খাজা করিমুল্লাহর বাড়িতে যান। তার পুত্র খাজা হামিদুল্লাহর বিয়ে উপলক্ষে নাচের অনুষ্ঠান হয়। নাচে অংশ নেন দেবী বাইজি অন্য একজন বাইজি।

২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯১৮: খাজা হামিদুল্লাহর সঙ্গে ১০ হাজার টাকা দেনমোহরের বিনিময়ে নওয়াব সলিমুল্লাহর মেয়ে আকতার বানুর আকদ হয় আহসান মঞ্জিলে। প্রত্যেককে মিষ্টি খাওয়ানো হয় এবং একটি করে রুমাল দেয়া হয়। বিয়েতে খুব জাঁকজমক আনন্দ-ফূর্তি হয়।

তার ফারসি ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ কয়েকটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে: মার্চ লাট সাহেব (বাংলার গভর্নর) এক সমাবেশে ভাষণ দেন, বাঙালি সিপাইরা শহরে মার্চ পাস্ট করে। এপ্রিল ময়মনসিংহের এক ব্যক্তি একটি কুমির উপহার দিলে তা খাজা আতিকুল্লাহর স্ত্রী আজিজুন নেসাকে দেয়া হয়। এটি দিলখুশা গার্ডেনের পুকুরে রাখা হয়। ২২ এপ্রিল পল্টনে খাজা আতিকুল্লাহ বাড়িতে বায়স্কোপ আনা হয়। তিনি সেখানে বায়স্কোপ দেখেন। জুলাই ঢাকায় প্রবল ভূমিকম্প হয়। অনেক ঘরে ফাটল ধরে দরজা-জানালা ভেঙে যায়। ২২ অক্টোবর রাতে মহররমের মিছিল বের হয়। ২৭ নভেম্বর শহরে প্রচার করা হয় যে বিশ্বযুদ্ধ থেমে গেছে। এজন্য আনন্দ উৎসব করা হবে, শুক্রবারে জলসা বসানো হবে।

সিপাহি বিদ্রোহের বিচার: ফারসি রায়

মুনতাসীর মামুনের ঢাকা: ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ দলিলপত্র গ্রন্থে ফারসি থেকে অধ্যাপক আবদুস সাইদ অনূদিত বিদ্রোহী সিপাইদের একটি মামলার বিবরণীর সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো: ব্রিটিশ সম্রাট বনাম কফুর খান সিপাহি অন্যান্য মামলায় কফুর খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ: সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ যুদ্ধ সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ এবং পালায়ন। ঘটনার তারিখ ২২ নভেম্বর ১৮৫৭।

তিন সিপাহি জিউলাল রাম, হিরামন রাম শঙ্কর রামের অপরাধ পলায়ন করা। মোকাদ্দমার তারিখ ডিসেম্বর ১৯৫৭। কফুর খান বলেন, সিপাহিদের যুদ্ধের সময় একটি ভাড়া-বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। অন্যদের উত্তর অফিসারের নির্দেশে তারা অস্ত্র সমর্পণ করেন, কিন্তু গোরা সৈন্যর গুলিতে সহকর্মীর মৃত্যু হওয়ায় ভয়ে পালিয়ে যান।

রায়: আদেশ করা যাচ্ছে যে কফুর খানকে ফাঁসি দেয়া হোক। জিউলাল রাম, হিরামন রাম এবং শঙ্কর রাম সিপাহিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে দরিয়ার অন্য তীরের কারাগারে রাখা হোক। রায়ের তারিখ ডিসেম্বর ১৮৫৭।

প্রশাসনের ভাষা

মোগল আমলে প্রশাসন, রাজস্ব এবং আদালত ফারসি, আরবি, উর্দু তুর্কি শব্দ নির্ভর ছিল। মহান রাজা কিংবা সম্রাট সর্বোচ্চ আসনের পুরুষ মানুষটি ছিলেন বাদশাহ। তার পরবর্তী স্তর উজির বা ওয়াকিল। মোগল সম্রাটদের উপদেষ্টা থাকলেও মন্ত্রিপরিষদ ছিল না। উজিরকে প্রধানমন্ত্রী ভাবা যেতে পারে। উজিরদের পরবর্তী অধঃস্তন কর্মকর্তা হচ্ছেন: অর্থ রাজস্বের জন্য দেওয়ান উজির, বিচারের জন্য কাজি উল কুজাত, রাজকীয় গৃহস্থালি কাজ করতেন খাম--জামান, সামরিক বেতন ভাতার দায়িত্বে ছিলেন মীর বকশি, নৈতিক স্খলনজনিত বিষয় দেখতেন মুহতামিম।

নগরের প্রধান পুলিশ কর্মকর্তা কোতোয়াল, রাষ্ট্রীয় উৎসবের প্রধান আয়োজক মীর তুসকি প্রভৃতি। কোনো পদবিই দেশীয় শব্দে নয়।

দেওয়ানি কার্যাবলি সম্পাদিত হতো কয়েকটি দপ্তরে: দেওয়ান--খালিসা (সরকারি জমিজমা-সংক্রান্ত); দেওয়ান--তান (মনসবদার জায়গিরদার ইত্যদি সংক্রান্ত), মুশতাওয়াফি। প্রদেশ বা সুবার কর্মকর্তারা ছিলেন: সুবাদার, দেওয়ান, বকশি, কাজি, কোতোয়াল, মীর বাহর প্রমুখ।

ভূমি রাজস্ব প্রশাসনের কিছু ফারসি শব্দ যা কালক্রমে বাংলায় আত্মীয়কৃত হয়েছে এগুলোর মধ্যে রয়েছে: আবওয়াব, আমিন, আমিল, ইজারা, ইনাম, ওয়াকফ, গোমস্তা, ওয়াসিল, পাটোয়ারী, মজকুরি তালুক ইত্যাদি।

ফারসির ওমর খৈয়াম, বাংলার নজরুল

এক সোরাহি সুরা দিও, একটু রুটির ছিলকে আর

প্রিয়া সাকী, তাহার সাথে একখানি বই কবিতার

জীর্ণ আমার জীবন জুড়ে রইবে প্রিয়া আমার সাথ

এই যদি পাই চাইব নাকো তখৎ আমি শাহানশার।

(নজরুলের অনুবাদে খৈয়ামের একটি রুবাইয়াত)

মুর্শিদাবাদ, রাজমহল, শ্রীরামপুর, হুগলী এবং পরবর্তী সময় কলকাতাও ফারসি চর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল, চুরুলিয়ায় সে ঢেউ সামান্যই লেগেছিল। তাছাড়া নজরুল তো পড়াশোনা করার সুবোধ বালকটিও ছিলেন না। জীবন সংগ্রামের শুরু তো কৈশোরেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে পল্টনের এক পাঞ্জাবি মৌলভি তাকে হাফিজের দিওয়ান ধরিয়ে দিয়েছিলেন। হয়তো নজরুল নিজেই ধরেছিলেন। তবু সৈয়দ মুজতবা আলীর আশঙ্কা, পল্টনের হাবিলদার যে জোব্বা-জাব্বা পরে দেওয়ানা-দেওয়ানা ভাব ধরে হাফিজ-সাদীর কাব্য কিংবা মৌলানা রুমীর মসনবী সামনে নিয়ে কুঞ্জে কুঞ্জে ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়াবেন তাও তো মনে হয় না। এমনকি রঙিন সদরিয়ার ওপর মলমলের বুটিদার আঙ্গরাখা পরে হাতে শিরাজীর পাত্র নিয়ে সাকীর কণ্ঠে ফারসি গজল আর কাসীদা-গীত শুনেছেন, এও খুব সম্ভবপর বলে মনে হয় না। তবু ওমর খৈয়ামের শ্রেষ্ঠ বাংলা অনুবাদ কান্তি ঘোষের নয়, নজরুলের। একজন বড় কবিই পারেন অন্য একজন বড় কবিকে আত্মস্থ করতে এবং তার মতো করে পুনর্নির্মাণ করতে।

ফিটজেরাল্ডের ইংরেজি অনুবাদ পরে যে পাশ্চাত্য ওমর খৈয়ামকে চিনেছে যে কবি ভোগবাদের। নজরুলের মতো আত্মস্থ করে যিনি অনুবাদ করতে জানেন, তার কাছে ভোগবাদ খণ্ডিত বিবরণ মাত্র। ভারতে ছয়শত বছরের রাজভাষা এবং নজরুলের মতো কবির যদি সমন্বয় ঘটে তাহলেই হতে পারে ফারসি ভাষার নতুন উদ্বোধন, ওমর খৈয়ামের অলৌকিক অভ্যুদয়। সৈয়দ মুজতবা আলী উপসংহার টানেন এই বলে: ওমরই ওমরের শ্রেষ্ঠ মল্লিনাথ এবং কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী।

ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ অনুবাদ করতে গিয়ে নজরুল যেসব আরবি-ফারসি শব্দ বাংলা অনুবাদ তথা বাংলা ভাষায় আত্মস্থ করেছেন তার তালিকা করেছেন শাহাবুদ্দীন আহমদ: সাকী, গুল, খোয়ারী, কবর, গজল, শিরীন. শিরাজী, শরাব, তারিফ, নার্গিস, গোলাপ, ফজুল, তুফান, আবহাওয়া, বুলবুলি, গুলিস্তান, পিয়ালা, খোশবু, গোর, লালা, শাহানশাহ, সেরেফ, মেকী, সাফ, কারসাজি, মোল্লাজি, খানা, পীর, খোদা, খাজা, পোশাক, তকদীর, দোস্ত, গুলবাগিচা, আস্তানা, দাফন, খিজির, নিয়ামত, মালুম, কিস্তি, দিলরুবা, বরাত এবং আরো অনেক শব্দ।

বাংলা ভাষা সাহিত্যের সমৃদ্ধিতে ফারসির অবদান অবশ্যই স্মরণীয়। উপমহাদেশের অনেক ভাষাই ফারসির কাছে ঋণগ্রস্ত।

 

এমএ মোমেন: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা