দেশে চলতি অর্থবছরে সারের মোট চাহিদা হতে পারে প্রায় ৬৯ লাখ টন। বাংলাদেশে সারের মোট চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের সরকারি গুদামগুলোয় সার মজুদ আছে প্রায় ১৮ লাখ টন। এ মজুদ দেশের আসন্ন প্রয়োজনও তাৎক্ষণিকভাবে মেটাতে পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন কৃষিবিদরা।
তাদের ভাষ্যমতে, দুই মাসের মধ্যে শুরু হচ্ছে বোরো ও রবি মৌসুম। দেশে সবচেয়ে বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী মৌসুমটিতে সারসহ চাষাবাদের প্রয়োজনীয় উপকরণের চাহিদাও থাকে সবচেয়ে বেশি। দেশে মোট রাসায়নিক সারের ৭০ শতাংশেরও বেশি ব্যবহৃত হয় শুধু বোরো ও রবি মৌসুমে। যদিও এবার গ্যাস সংকটে সারের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। আমদানিতে জটিলতা তৈরি করেছে ডলার সংকট। ফলে আসন্ন রবি ও বোরো মৌসুমে সারের প্রয়োজনীয় জোগান নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬৮ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ টন। চলতি অর্থবছরে এ চাহিদার পরিমাণ কিছুটা বেড়ে প্রায় ৬৯ লাখ টনে দাঁড়াতে পারে। যদিও এর বিপরীতে সরকারি গুদামগুলোয় সারের মজুদ আছে মাত্র ১৭ দশমিক ৭৪ লাখ টন। দেশে সারের মোট চাহিদার চার-পঞ্চমাংশ পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। এবার বেসরকারি উদ্যোগে সাড়ে নয় লাখ টন সার আমদানির কথা আছে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে সার আমদানি করা যায়নি। আবার দেশের পাঁচটি ইউরিয়া সার কারখানার মধ্যে তিনটির উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে গ্যাসের অভাবে।
উৎপাদন ও আমদানি নিয়ে সৃষ্ট সংকটে ইউরিয়াসহ প্রয়োজনীয় সার সরবরাহ নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় সার আমদানি ও উৎপাদন উভয় দিকেই সংকট থাকায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সাম্প্রতিক বন্যার পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে বোরো উৎপাদনে আরো বেশি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু এলসি জটিলতায় সার আমদানি কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় রেশনিং করে হলেও গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে সার কারখানাগুলোকে পুরোদমে উৎপাদনে নিয়ে আসা প্রয়োজন। একই সঙ্গে যাবতীয় প্রক্রিয়াগত জটিলতা দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমাধান করে প্রয়োজনমতো আমদানির মাধ্যমে সারের পর্যাপ্ত জোগান নিশ্চিত করতে হবে।
অবশ্য কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি আমন মৌসুমে সার নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার উইংয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. নূরুন্নাহার চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রতি বছরের মতো নিয়মিত প্রক্রিয়ায় সার ব্যবস্থাপনার কাজ চলমান রয়েছে। আমদানির কাজও চলমান রয়েছে।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে ব্যবহৃত সারের মধ্যে প্রধান চারটি সারের মোট চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৯ লাখ টন। এছাড়া বোরোসহ অন্যান্য সার মিলিয়ে মোট চাহিদা দাঁড়াতে পারে প্রায় ৬৯ লাখ টনে। আর চাহিদার বিপরীতে এখন পর্যন্ত সরকারের কাছে মজুদ রয়েছে ১৭ দশমিক ৭৪ লাখ টন। আর সাড়ে নয় লাখ টন সার আসবে বেসরকারি উদ্যোগে।
চলমান বন্যায় আমন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বোরো উৎপাদনে আরো বেশি জোর দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা। ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের পরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মোট ধানের ৫৪ শতাংশ আসে বোরো মৌসুমে। তাই বন্যার প্রভাব মোকাবেলা করে মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে কমপক্ষে ৪০-৪৫ লাখ টন সারের মজুদ নিশ্চিত করতে হবে। ডলার সংকটে আমদানি পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়েছে। আর আমদানি করতেও দেড়-দুই মাস সময় লেগে যায়। তাই এখন উৎপাদনে গুরুত্ব দেয়া উচিত। রেশনিং করে হলেও গ্যাস সরবরাহ করে পাঁচটি ইউরিয়া সার কারখানা পুরোপুরি সচল করা উচিত।’
এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের কারখানা প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু গত রমজান থেকেই গ্যাস সংকট চলছে। গ্যাস সরবরাহ দিতে আমরা জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছি। গত বছরও আমাদের উৎপাদন করতে কষ্ট হয়েছে। তাই এবার আমরা আমাদের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১০ লাখ থেকে সাত লাখ টনে নামিয়ে এনেছি। আর ইউরিয়া আমদানি নিয়ে আমাদের এখনো কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’
সরকারি পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সার আমদানি হয়েছিল ৫৫ লাখ টনের বেশি। আর দেশে উৎপাদন ছিল নয় লাখ টনের বেশি। সে বছর সারের প্রাপ্যতা বা মজুদ ৬৪ লাখ টন থাকলেও ব্যবহার হয়েছিল প্রায় ৬১ লাখ টন।
সার ব্যবস্থাপনার সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নভেম্বর পর্যন্ত সার নিয়ে কোনো সমস্যা নেই আমাদের। তবে বোরো মৌসুমের সার নিয়ে কাজ করছি আমরা। ডলার সংকট একটি ইস্যু। তবে এটি নিয়ে আমরা আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছি। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সার আমদানির প্রয়োজনীয় ডলারের সংস্থান করা হবে। আশা করছি দু-তিনদিনের ভেতরে সমস্যা কেটে যাবে। ডলারের জন্যই একটু দেরি হচ্ছে।’