প্রান্তিক কৃষকদের কাছে ঋণ পৌঁছানোর সক্ষমতাই নেই ব্যাংকের

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : বণিক বার্তা

বিপুল শিল্পায়নের পরও দেশের কর্মসংস্থান ও জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে কৃষি খাত। সরাসরি কৃষিতে নিয়োজিত রয়েছে এমন জনশক্তির পরিমাণ প্রায় আড়াই কোটি। জিডিপিরও প্রায় ১২ শতাংশ আসছে কৃষি খাত থেকে। যদিও ব্যাংক ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে দেশের সবচেয়ে অবহেলিত খাত হলো কৃষি। বাংলাদেশ ব্যংকের তথ্য বলছে, গত জুন শেষে দেশের কৃষি খাতে মোট বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র ৫৮ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। তবে এ ঋণের বড় অংশই গেছে কৃষিভিত্তিক শিল্প ও বড় কৃষকদের কাছে।

দেশের ব্যাংক খাত থেকে প্রান্তিক কৃষকরা যে ঋণ পাচ্ছেন, তার বড় অংশই বিতরণ হচ্ছে এনজিওর মাধ্যমে। ব্যাংক থেকে কৃষকরা ঋণ পান ১২-১৩ শতাংশ সুদে। কিন্তু এনজিওর মাধ্যমে নেয়া ঋণের সুদহার দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৩০ শতাংশ। দেশের প্রান্তিক কৃষকদের কাছে ঋণ পৌঁছানোর সক্ষমতাই দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক তৈরি করতে পারেনি। এ কারণে ব্যাংকগুলো কৃষি খাতের ঋণের ৫০-৮০ শতাংশ এনজিওকে দিয়ে দিচ্ছে। এনজিওগুলো ব্যাংক থেকে ১২-১৩ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে কৃষকদের মাঝে দ্বিগুণেরও বেশি সুদে বিতরণ করছে।

ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, গত কয়েক বছরে দেশের ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের নেটওয়ার্ক সে অর্থে বিস্তৃত হয়নি। এখনো ব্যাংকগুলো সারা দেশ থেকে আমানত সংগ্রহ করে অল্পকিছু শাখার মাধ্যমে বড়দের ঋণ দিচ্ছে। এ কারণে প্রান্তিক কৃষকরা বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, সুদহার বেড়ে যাওয়ায় আমরা এখন ১২-১৩ শতাংশ সুদে কৃষি ঋণ দিচ্ছি। তবে এটি ঠিক, কৃষি ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ এনজিওর মাধ্যমে বিতরণ করতে হচ্ছে। কারণ প্রান্তিক কৃষকদের হাতে ঋণ পৌঁছানোর সক্ষমতা দেশের বেশির ভাগ ব্য্যাংকেরই নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কৃষি খাতে বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেক নিজস্ব লিংকে দেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমরা সে নির্দেশনা পালনের চেষ্টা করছি। বাংলাদেশের ধনীদের তুলনায় কৃষকদের মধ্যে ঋণ পরিশোধের প্রবণতা ভালো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কর্মসংস্থান ও জিডিপিতে অংশ গ্রহণের নিরিখে সবচেয়ে কম ঋণ পাচ্ছেন কৃষকরা। চলতি বছরের জুন শেষে বেসরকারি খাতে দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণ ঋণের স্থিতি ছিল ১৬ লাখ ৪১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাত্র ৫৮ হাজার ১১৯ কোটি টাকা গেছে কৃষি খাতে, যা মোট ঋণের মাত্র ৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। বড় ব্যবসায়ী ও ধনিক শ্রেণী ব্যাংক থেকে ঋণ বেশি নিলেও পরিশোধ করছেন কম। এক্ষেত্রে কৃষকরা ব্যতিক্রম। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংকগুলো থেকে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৩৭ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। একই সময়ে ৩৫ হাজার ৫৭১ কোটি টাকার ঋণ কৃষকরা ফেরত দিয়েছেন। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষকরা ব্যাংক থেকে ৩২ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা ঋণ নিলেও ফেরত দিয়েছেন ৩৩ হাজার ১০ কোটি টাকা। এর আগেও কৃষকরা ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের চেয়ে বেশি পরিশোধ করেছেন। এমনকি কভিড-১৯ সৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যেও কৃষি খাতে ঋণ বিতরণের চেয়ে বেশি আদায় হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৫১১ কোটি টাকা। ওই বছর কৃষকরা ২৭ হাজার ১২৪ কোটি টাকা ব্যাংকে পরিশোধ করেছেন।

ব্যাংকগুলোকে কৃষি খাতে ঋণ প্রদানে বাধ্য করতে প্রতি অর্থবছরের শুরুতে কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের জন্য ঘোষিত নীতিমালায় এ খাতে ৩৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ১২ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা এবং বেসরকারি ও বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ২৫ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করবে।

এবারের নীতিমালায় ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর জন্য কৃষি উৎপাদন খাতে বিনিয়োগের বিষয়ে ইসলামিক ব্যাংকিং পদ্ধতি তথা বা ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক বিনিয়োগ পদ্ধতি সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়া প্রাণিসম্পদ খাতে ১ লাখ টাকা এবং পল্লী ঋণে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণের ক্ষেত্রে ডিপি নোট (১০ টাকা থেকে ৫০ টাকার স্ট্যাম্প/সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক), লেটার অব হাইপোথিকেশন (স্ট্যাম্প প্রয়োজন নেই), লেটার অব গ্যারান্টি ব্যক্তিগত (স্ট্যাম্প প্রয়োজন নেই) ছাড়া আর কোনো মাশুল গ্রহণ না করার নির্দেশনা দেয়া হয়।

ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ব্যাংকগুলো নিজস্ব নেটওয়ার্ক (শাখা, উপশাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং, দলবদ্ধ ঋণ বিতরণ) এবং ব্যাংক-এমএফআই লিংকেজ ব্যবহার করতে পারবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৫০ শতাংশের কম হতে পারবে না। এবার মোট লক্ষ্যমাত্রার ৬০ শতাংশ শস্য ও ফসল, ১৩ শতাংশ মৎস্য এবং ১৫ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাতে বিতরণ করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকের শাখা পর্যায়ের কর্মকর্তারা কৃষি খাতে বরাদ্দকৃত ঋণ অন্য খাতে বিতরণ করেন। জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে সে ঋণ কৃষি খাতে দেখান। ব্যাংকগুলোর প্রধান কার্যালয় সতর্ক হলে এ ধরনের জালিয়াতি প্রতিরোধ করা সম্ভব। প্রকৃত কৃষকদের হাতে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ঋণের অর্থ পৌঁছানো সম্ভব হলে কৃষির উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হবে।

ব্যাংকের বাইরে গ্রামীণ ব্যাংকসহ দেশের ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান ও এনজিও থেকে কৃষকরা ঋণ বেশি নিচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক ও শীর্ষ ১০টি এনজিও ১৬ হাজার ৯৯১ কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করেছে। একই সময়ে এ প্রতিষ্ঠানগুলো আদায় করেছে ১৭ হাজার ৯৭ কোটি টাকা। মে শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন