কীটনাশক ও দুই কৃষিপণ্যে শুল্ক হ্রাস এবং প্রত্যাহারের ঘোষণা

ভোক্তা সুফল পাবে কি

নজরুল ইসলাম

ছবি : বণিক বার্তা

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে আমদানি পর্যায়ে পেঁয়াজ, আলু ও ডিমে শুল্ক হ্রাস ও প্রত্যাহার চেয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বুধবার কীটনাশকে সম্পূর্ণ, আলুতে ১৩ ও পেঁয়াজে ৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে এনবিআর। যদিও এ তিন পণ্যে শুল্ক হ্রাস ও প্রত্যাহারের পর এখনো ভোক্তা পর্যায়ে এর সুফল নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

তারা বলছেন, পণ্যগুলোর আমদানিতে শুল্ক হ্রাস বা প্রত্যাহার আরো অনেক আগেই করা প্রয়োজন ছিল। আগেও সরকারের পক্ষ থেকে যথাসময়ের অনেক পর শুল্ক হ্রাস বা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাজারে তার সুফল পাওয়া যায়নি। পণ্যগুলোর উৎপাদন-সরবরাহ নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যানের অভাব ও সরবরাহ চেইনের মধ্যস্বত্বভোগীরা বরাবরই বাজার নিয়ন্ত্রণে বাধা হয়ে ছিল। বাজারে মনিটরিংও পর্যাপ্ত ছিল না। কেবল আমদানিকারক তথা ব্যবসায়ীরা হ্রাসকৃত শুল্ক সুবিধা তাদের পকেটে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজারে পণ্যগুলোর মূল্য কমিয়ে আনতে হলে যথাযথ বাজার মনিটরিং ও সরবরাহ চেইনের বিঘ্নগুলো দূর করার পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে আনতে হবে। 

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আপাতত পেঁয়াজ ও আলুর শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে। এছাড়া ডিম ও চিনির আমদানি শুল্ক কমানোর বিষয়ে আলোচনা চলমান। 

গত ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ভোজ্যতেল, চিনি, খেজুর ও চালের ওপর শুল্ক কমানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এনবিআর ৮ ফেব্রুয়ারি পাঁচটি আলাদা প্রজ্ঞাপনে এসব পণ্যের শুল্ক বিভিন্ন পর্যায়ে কমানোর ঘোষণা দেয়। ঘোষণায় অপরিশোধিত চিনির আমদানি শুল্ক টনপ্রতি দেড় হাজার থেকে কমিয়ে ১ হাজার টাকা করা হয়। এতে প্রতি টনে শুল্ক কমে ৫০০ টাকা। পরিশোধিত চিনির টনপ্রতি শুল্ক ৩ হাজার থেকে কমিয়ে ২ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। ৩১ মার্চ পর্যন্ত কম শুল্কে চিনি আমদানির সুযোগ পান আমদানিকারকরা। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত পরিশোধিত-অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পাম অয়েল আমদানিতে ভ্যাট ১৫ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। ভ্যাটের হার কমে ৫ শতাংশ। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমদানি পর্যায়ে সেদ্ধ ও আতপ চাল আমদানিতে আরোপিত ৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। একই সঙ্গে রেগুলেটরি ডিউটি বা সংরক্ষণমূলক শুল্ক (আরডি) ২৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। ১৫ মে পর্যন্ত হ্রাসকৃত শুল্কে চাল আমদানি করার সুযোগ দেয়া হয়। এছাড়া সব ধরনের খেজুরের আমদানি শুল্ক ২৫ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। ৩০ মার্চ পর্যন্ত কম শুল্কে খেজুর আমদানি করার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু শুল্ক কমানোর এসব সিদ্ধান্তের পরও বাজারে পণ্যের দাম কমেনি। বরং বাড়তি দরেই বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ২০২৩ সালের নভেম্বরে ১৫০ টাকায় বিক্রি হতো। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দাম বেড়ে বিক্রি হয় ১৫৫ টাকায়। আর বোতলজাত সয়াবিন তেল নভেম্বরে প্রতি লিটার বিক্রি হয়েছে ১৬৮ টাকা ও ফেব্রুয়ারিতে ১৭৩ টাকায় বিক্রি হয়। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এএইচএম সফিকুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখন শেষ মুহূর্তে শুল্ক প্রত্যাহার করলে কতটুকু প্রভাব পড়বে? আমরা বলেছিলাম, সিজনাল ট্যারিফ আরোপ করতে। আমরা আরো পাঁচ-ছয় মাস আগ থেকে বলেছি। সেটা করা হয়নি। এখন প্রত্যাহার করলে কতটুকু প্রভাব ফেলবে, সেটা ভাবার বিষয় রয়েছে। এখন প্রত্যাহারের পর যদি ভারত রফতানি নিষিদ্ধ করে দেয়, মিনিমাম এক্সপোর্ট চার্জ বাড়িয়ে দেয়, তাহলে তো লাভ হবে না। তবে পুরো ১০ শতাংশ শুল্কই যদি প্রত্যাহার করা হয়, তাহলে ভারতের পেঁয়াজের সরবরাহ দেশের বাজারে প্রভাব ফেলবে।’

তিনি বলেন, ‘রমজান শুরুর ১৫ দিন আগে খেজুরের শুল্ক প্রত্যাহার করায় দামের প্রভাব বাজারে তেমন পড়েনি। ডিমের ক্ষেত্রে আগে ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তবে আমাদের সঙ্গে ভারতের উৎপাদন খরচে খুব বেশি পার্থক্য হওয়ার কথা নয়। ভোক্তাদের কথা চিন্তা করে দাম সমন্বয় করা যেতে পারে। আর আলুর বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় বলেছে, মজুদ চাহিদার চেয়ে বেশি রয়েছে। তাহলে এখন কেন এত দাম? তাদের হিসাব অনুযায়ী তো নভেম্বর পর্যন্ত আলুর মজুদ রয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ীই তো পরিকল্পনা করা হয়।’

আমদানি পর্যায়ে পেঁয়াজে ৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি (সিডি) ও ৫ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি বা নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) সম্পূর্ণ প্রত্যাহার চেয়ে গত ২৯ আগস্ট এনবিআরকে চিঠি দিয়েছিল ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। এছাড়া ডিম ও আলুতে সিডি ২৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ ও ৩ শতাংশ আরডি প্রত্যাহার চাওয়া হয়। 

চিঠিতে বলা হয়, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য পেঁয়াজ, আলু ও ডিম আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে আমদানি উন্মুক্ত করতে চায় ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। দেশে প্রতি বছর ছয়-সাত লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হলেও বিশেষ অনুমতি ছাড়া ডিম ও আলু আমদানি হয় না। তাই পেঁয়াজ আমদানি থেকে বিদ্যমান শুল্কহারে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব আহরণ করলেও ডিম ও আলু থেকে তেমন রাজস্ব আহরণ হয় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভোক্তা সাধারণের ক্রয়ক্ষমতা ও বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে এ অনুরোধ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে এনবিআরের সাবেক সদস্য (শুল্কনীতি) সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শুল্ক কমলে তো বাজারে একটা প্রভাব পড়ার কথা। এরপর যখন ওই দরে আমদানি হবে, তখন প্রভাব পড়বে। অপেক্ষা করতে হয়। এনবিআরকে ভোক্তা স্বার্থ, উৎপাদনকারী কৃষকের স্বার্থ এবং রাজস্ব আহরণের বিষয়ও দেখতে হয়। এগুলো বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেজন্য হয়তো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আসতে কিছুটা দেরি হয়। বছরের একটা সময়ে এসে যদি বলা হয়, দশটা আইটেমের দাম কমিয়ে দেন। তখন তো এনবিআর চিন্তায় পড়ে যায়, রাজস্ব আহরণ হবে কীভাবে। আবার না কমালে ভোক্তারা অসন্তুষ্ট। আমদানি উন্মুক্ত করে দিলে বলা হয়, কৃষকদের মেরে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু শুল্ক কমানোর সুবিধাটা মূলত নিয়ে নেন ব্যবসায়ীরা। এনবিআর পড়ে বিপাকে।’ 

ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন দাবি করছে, তাদের সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে আমদানি উৎসাহিত হবে এবং স্থানীয় বাজারমূল্য হ্রাসের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমবে। পেঁয়াজ আমদানির অন্যতম উৎস ভারত সরকারের সর্বনিম্ন রফতানি মূল্য প্রতি টন ৫৫০ ডলার নির্ধারণ করে ৪০ শতাংশ রফতানি শুল্কারোপ করা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় ১২ লাখ টন আলু উৎপাদন কম হয়েছে। বিদ্যমান আমদানি নীতি আদেশ অনুযায়ী, আলু ও ডিম শর্তসাপেক্ষে আমদানিযোগ্য পণ্য। ডিম আমদানির ক্ষেত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি এবং পেঁয়াজ ও আলু আমদানির ক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আইপি প্রয়োজন হয়।

সার্বিক বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শুল্ক প্রত্যাহার তো হলো। এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হবে মনিটরিং জোরদার করা। আমদানিকারক থেকে পাইকার হয়ে খুচরা বিক্রেতার পর্যায়ে কী কী কারণে দর বেড়ে যায়, সেসব কারণ চিহ্নিত করা। সেসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া। মাঝখানের বেনিফিট কে খাচ্ছে, কেন দাম বাড়ছে সেটা জানার অধিকার জনগণের আছে। সেই তথ্য জানাতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন