২৬ ওষুধ কারখানায় উৎপাদন বিঘ্নিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : সংগৃহীত

দেশের বৃহৎ ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বোর্ডঘর এলাকায় তাদের কারখানা। ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধি, চাকরি স্থায়ীকরণসহ ২১ দফা দাবিতে শ্রমিকরা গত ৩১ আগস্ট আন্দোলনে নামেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় কর্তৃপক্ষ ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করে। 

ওষুধ সরবরাহকারী আরেক বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালসের কারখানা রয়েছে শ্রম অধ্যুষিত এলাকা আশুলিয়ায়। সাম্প্রতিক শ্রম অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে আট-নয়দিন ধরে তাদের কারখানাটিও বন্ধ রয়েছে। 

শুধু স্কয়ার কিংবা ইনসেপটা নয়, শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে বর্তমানে দেশের ২৬টি কারখানায় কার্যত বন্ধ রয়েছে ওষুধ উৎপাদন। আর এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে সংকট দেখা দিতে পারে সরবরাহে। তাই এটিকে জাতীয় সংকট উল্লেখ করে সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা চেয়েছেন ওষুধ শিল্প মালিকরা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজের (বিএপিআই) সহসভাপতি ও গ্লোব ফার্মাসিউক্যালস লিমিটেডের চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক অস্থিরতায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে ২০টির মতো ওষুধ কারখানায়। আর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বন্ধ হয়েছে এমন কারখানা ছয়টি। তবে আজকে (গতকাল) পরিস্থিতি কিছুটা ঠাণ্ডা আছে। কম্প্রোমাইজ করতে হচ্ছে। যেমন ২৪ ঘণ্টা পর বুধবার দুপুরে হেলথকেয়ারের সমস্যা সমাধান হয়েছে।’ 

শিল্প পুলিশ ও খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের শ্রম অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় বিভিন্ন খাতের কারখানা থাকলেও অধিকাংশ বস্ত্র ও পোশাক খাতের। ফলে এ খাতের কারখানাগুলোকে ঘিরেই শ্রম অসন্তোষ বেশি দেখা দেয়। ৩১ আগস্ট থেকে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে ওষুধ খাতের কারখানাগুলোয়ও। এর প্রভাবে দেশের স্বাস্থ্য খাতে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা। কারখানাভেদে ওষুধের মজুদও ফুরিয়ে আসছে। গত মঙ্গলবার এ নিয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনও করেছে বিএপিআই।

সংগঠনটির নেতারা বলছেন, ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে বিগত ৫০ বছর ধরে কোনো শ্রমিক উত্তেজনা বা আন্দোলন হয়নি। ইদানীং শ্রমিকরা বিভিন্ন অযৌক্তিক দাবিতে, আইনবহির্ভূতভাবে আন্দোলন করছেন এবং ভাংচুর চালাচ্ছেন। অনেক কারখানায় কর্মকর্তাদের প্রবেশেও বাধা দিচ্ছেন তারা। এতে উৎপাদনকাজ ব্যাহত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে এবং দেশে ওষুধের সংকট দেখা দেবে। বর্তমানে মজুদ থাকা ওষুধ দিয়ে চলছে সরবরাহকাজ। 

এ বিষয়ে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক (ফাইন্যান্স ও স্ট্র্যাটেজি) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যে কারখানাগুলোর উৎপাদন বিঘ্নিত হয়েছে সেগুলোয় জীবন রক্ষাকারী কিছু কিছু ওষুধের মজুদ রয়েছে খুব অল্প দিনের। এমনও ওষুধ আছে যেগুলোর কেবল পাঁচ-ছয়দিনের মতো মজুদ আছে। তাই কারখানাগুলো যদি দ্রুতই উৎপাদনে না আসে তাহলে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।’ 

ওষুধ কারখানাগুলোর বেশির ভাগই আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহ এলাকায় অবস্থিত। এর মধ্যে আশুলিয়ায় রয়েছে আনুমানিক ১০টি কারখানা। গতকাল একটি ওষুধ কারখানা বন্ধ ছিল। গাজীপুর এলাকায় ওষুধ কারখানা রয়েছে ৬০টির মতো। গত কয়েকদিনের শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বন্ধ হয়েছে পাঁচটির মতো কারখানা। এর মধ্যে স্কয়ার, ইবনে সিনা ও হেলথকেয়ারের কারখানাও রয়েছে।  

বণিক বার্তার গাজীপুর প্রতিনিধির তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রধান রফতানি খাত পোশাক শিল্পের চলমান শ্রমিক অসন্তোষের পাশাপাশি গাজীপুরের ওষুধ কারখানাগুলোয়ও শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। চাকরি স্থায়ীকরণ, কারখানার কর্মকর্তাদের পদত্যাগ, শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত না করা, দুদিন সাপ্তাহিক ছুটিসহ বিভিন্ন দাবিতে বেশ কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করছেন শ্রমিকরা। এতে কারখানার উৎপাদন কার্ক্রমে বিঘ্ন ঘটছে। 

পুলিশ, কারখানা কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কালিয়াকৈর উপজেলার বোর্ডঘর এলাকায় ৩১ আগস্ট স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের কারখানার শ্রমিকরা ২১ দফা দাবিতে আন্দোলনে নামেন। তাদের দাবি, ১০ বছর চাকরি করলেও কর্তৃপক্ষ তাদের স্থায়ী করেনি। 

একই দাবিতে ওইদিন কালিয়াকৈরের হরিণহাটি এলাকায় আন্দোলনে নামেন এপেক্স ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের শ্রমিকরা। তারা ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ রেখে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখান। পরে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করে। ২১ আগস্ট টঙ্গীতে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, নুভিস্তা ফার্মা লিমিটেড ও ইউনিহেলথ ফার্মাসিউটিক্যালস এবং কালিয়াকৈরের ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালসের শ্রমিকরাও একই দাবিতে আন্দোলন করেন।

কালিয়াকৈরে অবস্থিত দেশের একটি প্রথম সারির ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ওষুধ শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য একটি স্বার্থান্বেষী মহল ষড়যন্ত্র করছে। শ্রমিকরা যেসব দাবি করছেন, তার অনেকগুলো আগেই পূরণ হয়েছে। অযৌক্তিক দাবিগুলোও মেনে নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। তার পরও শ্রমিকরা শান্ত হচ্ছেন না। তাদের এমন আচরণ, কারখানাই যেন বন্ধ করে দিই। প্রশাসন ও সরকার যদি ওষুধ শিল্পের এ অস্থিরতা দূর করতে সহযোগিতা না করে তাহলে প্রতিষ্ঠান চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।’ 

একই কারখানার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ২৬টি দাবি নিয়ে কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করেন। তাদের বেশির ভাগ দাবি পূরণ করা হয়েছে। এমনকি সব বিষয়ে একমত পোষণ করে শ্রমিকরা কাজেও যোগ দিয়েছিলেন। দুইদিন কাজ করার পর তারপর হঠাৎ করেই আবার তারা আন্দোলন শুরু করেন। তাই বাধ্য হয়েই কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে। 

টঙ্গীতে ১৯ দফা দাবিতে ২৫ আগস্ট কারখানার প্রধান ফটকে বিক্ষোভ করেন ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের কারখানার প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক। কারখানাটির মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা আসিফ হাসনাত বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শ্রমিকরা ৮, ১৯ ও ১৮ দফা দাবি জানিয়ে তিনটি তালিকা পাঠান। যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে আমরা তাদের সঙ্গে কথাও বলেছিলাম।’

ওষুধ কারখানা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রমিকরা যেসব দাবিতে আন্দোলন করছেন, তার বেশির ভাগই অযৌক্তিক। তার পরও সেগুলো পূরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাতেও যদি আন্দালন চলতে থাকে, তাহলে এটা হবে এ শিল্পের জন্য অশনিসংকেত। কারখানা বন্ধ হয়ে বাজারে দেখা দেবে ওষুধ সংকট। তাই এ সমস্যা অচিরেই সমাধান করা জরুরি।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ সারওয়ার আলম  বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের কাজ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা। এসব কাজ করতে গিয়ে আমরাও অনেক কিছু দেখছি। নানা রকম স্বার্থের কারণে সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে মূলত বহিরাগতরা কাজ করছে। যারা আন্দোলন করছে তাদের অধিকাংশই শ্রমিক নয়। এসব বহিরাগত কেন কী উদ্দেশ্যে শ্রমিকদের উসকানি দিচ্ছে, কারখানা ভাংচুর করছে, তা বলতে পারছি না।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন