গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান ঘটেছে, তার প্রেক্ষাপট সবারই জানা। গত ১৫ বছর সাত মাস ধরে দেশে এমন এক শাসন ব্যবস্থা চলছিল যা গণতন্ত্রকে ক্রমান্বয়ে গলা টিপে রেখেছিল। দীর্ঘদিন ধরে দেশের মানুষ এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক যে শাসন প্রত্যক্ষ করেছে, সেটি জনগণের ঘাড়ে চেপে বসেছিল। এ শাসনের কুফল মানুষ নানাভাবে প্রত্যক্ষ করেছে। দেশে দুর্নীতির প্রসার থেকে শুরু করে মানবাধিকারের বিচিত্র ধরনের লঙ্ঘন উল্লেখযোগ্য। এ আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর যে স্লোগানটি সামনে এসেছে তা হলো দ্বিতীয় বাংলাদেশ। এর অর্থ হলো নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। যেখানে ন্যায্যতা কিংবা বৈষম্য— সেসবের কোনো আলোচনাই ছিল না। এরপর দেশের আর্থিক খাতে বিরাট সংকট তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে বিরোধী মতকে সাংঘাতিকভাবে দমন-পীড়ন করা হয়েছে। বিরোধী মতকে প্রান্তিক পর্যায়ে ফেলে দিয়ে সরকারের শাসনক্ষমতাকে শক্তিশালী করার বিষয়টিও লক্ষ করা গেছে। অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ সবকিছুই প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। আর এ প্রেক্ষাপটটিই ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সৃষ্টি করেছে। এটি হওয়া একেবারে অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।
গত জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছে। জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী মনোভাব অব্যাহত ছিল। তারা সংকট সমাধানে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। ছাত্র আন্দোলনকে শুরু থেকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আসছে। এসব মানুষকে অসন্তুষ্ট করেছে এবং বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে সংঘবদ্ধ করেছে। আর ছাত্রদের ভূমিকা ছিল নেতৃত্ব পর্যায়ে।
বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন বিরোধী দল দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছিল। কিন্তু তারা এককভাবে কিছু করতে পারছিল না। ফলে তারা ছাত্রদের আন্দোলনের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এটিকে এক দফা আন্দোলনে পরিণত করেছে। তদানীন্তন আওয়ামী লীগের দিক থেকে সবসময় একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল যে ছাত্রদের কোটার সংস্কারের আন্দোলন কেন সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে পরিণত হলো। রাজনীতিতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ খুবই স্বাভাবিক।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলগুলোর প্রতি যে আচরণ করে অভ্যস্ত হয়েছিল, ছাত্রদের সঙ্গেও সেটি করতে থাকে। কারণ তারা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে মানুষের কোনো ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে তারা সহজে নিতে পারেনি। এ কারণে সরকার শুরু থেকেই ছাত্রদের কোটা সংস্কারের যৌক্তিক আন্দোলনকে ব্র্যাকেটবন্দি করার চেষ্টা করেছে। এ জনবিচ্ছিন্নতার কারণেই সরকার ছাত্রদের আন্দোলনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। শুধু তুচ্ছতাচ্ছিল্য নয়, এ আন্দোলনকে প্রতিহত করতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট বলেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হুমকি দিয়েছিলেন। সরকারের যদি জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকত তাহলে যৌক্তিক দাবি আদায়ের আন্দোলনকে কখনই দলীয় সংগঠন দিয়ে দমনের কথা বলত না। আন্দোলনকে সমাধান করতে সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন দরকার দেশের গণতান্ত্রিক শাসন প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করা। এটি করার অনেকগুলো পথ আছে। কয়েকটি জায়গায় কিছু আইনি সংস্কার করতে হবে। প্রথমত সংবিধানের কিছু কিছু জায়গায় সংশোধনের প্রয়োজন আছে। পুরোপুরি সংবিধান সংশোধনের বিতর্কে আমি যেতে চাই না। রুলস অব বিজনেস বা কার্যপ্রণালি বিধিতেও কিছু আইনি সংস্কার দরকার। সংসদের কিছু সংস্কার দরকার। আরো নির্দিষ্ট করে যদি বলি তাহলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার রাশ টানতে হবে। এটিই এখন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। আর প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার রাশ না টানলে বাংলাদেশকে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে এবং এ ধরনের পরিস্থিতি বারবার আসতে বাধ্য।
এখন অনেকেই দাবি করেছেন, প্রধানমন্ত্রীর পদে কোনো ব্যক্তিকে দুই মেয়াদের বেশি রাখা যাবে না। তাদের সঙ্গে আমি একমত। এটি এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে বলে মনে করি। এটি করা সম্ভব হলে তারপর যে দল থেকেই প্রধানমন্ত্রী হোক না কেন, তখন তিনি মনে করবেন আগের বাংলাদেশেই এসেছেন।
অনেকেই সংস্কারের কথা বলছেন। তবে সংস্কারের প্রক্রিয়া কীভাবে হতে পারে বা এ সরকার কীভাবে সংস্কার করতে পারে—সেটি একটি জটিল প্রক্রিয়া। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ হবে সংস্কারের চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরি করা। এরপর সরকারকে দেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হবে। আমার মনে হচ্ছে, এবার সংস্কারের পথ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সংস্কারের বিষয়টি এখন গণ-ঐকমত্যের প্রক্রিয়ার মধ্যে চলে গেছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়ে মানুষ এখন খুবই সচেতন। যেসব বিষয়ে সংস্কারের দাবি উঠেছে সেগুলোর চূড়ান্ত রূপ দেয়ার আগ পর্যন্ত ছাত্রদের মাঠে থাকতে হবে। তাহলে কোনো রাজনৈতিক দল সংস্কার না করার আর সাহস করবে না।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি কঠিন বার্তা দিয়েছে। এ আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অনেক শিক্ষা আছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তা-চেতনার জায়গাগুলোয় পরিবর্তন আসা দরকার। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বর্তমান প্রজন্মের চাওয়া-পাওয়া, সেখান থেকে রাজনৈতিক দলগুলো এখন অনেক দূরে অবস্থান করছে। দলগুলোকে তাদের চাওয়া-পাওয়াকে বিবেচনায় নিতে হবে। গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় যে সরকার ক্ষমতায় ছিল, তারা যেভাবে জনগণের সঙ্গে আচরণ করেছে, রাজনৈতিক দলগুলো যদি আবারো এর কম আচরণ করে তাহলে তারা ক্রমান্বয়ে জনগণের কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। কোনো দলকে বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় থাকতে হলে তাদের জনগণের কল্যাণে কাজ করতে হবে। তাদের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার জায়গাগুলো আরো শক্তিশালী করতে হবে।
বাংলাদেশে যিনি প্রাধনামন্ত্রী তিনি একাধারে নির্বাহী বিভাগের প্রধান, সংসদ নেতা এবং দলের প্রধান। এটিই বড় সমস্যা তৈরি করেছে এবং প্রধানমন্ত্রীকে একনায়কতান্ত্রিক হতে সহায়তা করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি আইন করে এ ব্যবস্থাকে একদম ভেঙে দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর প্রধান কাজ হবে নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বটি যথাযথভাবে পালন করা। যদি তিনি সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন তাহলে তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ ও দল থেকে চলে যেতে হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে যদি সীমিত করা না যায়, তাহলে দেশে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অনেক বিষয়ের সংস্কার করতে হবে—সেই মানসিকতা থেকে দূরে সরে কতগুলো সিলেকটিভ বিষয় যেগুলো সংস্কার করা জরুরি সেগুলো ঠিক করা উচিত। তাদের পক্ষে এ মুহূর্তে সবকিছু সংস্কার করা সম্ভব না। পুরো সংবিধানকে সংস্কার না করে মৌলিক বিষয়গুলোয় সংস্কার আনা দরকার। আর্থিক খাতেও মৌলিক বিষয়গুলো সংস্কার করা দরকার। এছাড়া বাজার যাতে আর কোনো সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে না যেতে পারে, সেখানে কী তী করলে তা স্থায়ীভাবে সমাধান করা যাবে সেগুলো সংস্কার করতে হবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে কেন একের পর এক অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন হয় সেগুলো যাচাই করে দেখা দরকার। শিক্ষায় বারবার পরিবর্তন কখনই টেকসই শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে না।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের কথা উঠছে। তবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক যে পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে, তাতে সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ পুরোপুরি তুলে দেয়ার সময় আসেনি। এটি বাতিল করা হলে সরকার অস্থিতিশীল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ অনুচ্ছেদে কিছুটা সংস্কার আনা যেতে পারে। পুরোপুরি বাতিল করার পক্ষে আমি নই।
ড. সাব্বীর আহমেদ: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়