পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে ভুগছেন আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা

ইকবাল মুনাওয়ার

আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা বিভীষিকাময় স্মৃতি ভুলতে পারছেন না ছবি: ফাইল/নিজস্ব আলোকচিত্রী

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে নানা বিভীষিকাময় পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে। কেউ প্রাণ হারিয়েছেন, কেউ পঙ্গু হয়েছেন। আবার এমন অনেক আন্দোলনকারী আছেন যারা চোখের সামনে সহযোদ্ধাদের মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়তে দেখেছেন। চোখের সামনে গুলিতে আরেকজনের বুক ঝাঁঝরা হওয়ার দৃশ্যও দেখতে হয়েছে তাদের। বিভীষিকাময় সেসব মুহূর্ত আজও এ প্রত্যক্ষদর্শীদের তাড়িয়ে বেড়ায়। তাদের কেউ কেউ এখনো ঘুমের মধ্যে আঁতকে ওঠেন; দুঃস্বপ্ন দেখেন। কেউ কেউ ভুগছেন মানসিক অস্থিরতা ও অবসাদে। 

চিকিৎসাবিজ্ঞানে এ ধরনের উপসর্গকে বলা হয় পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি)। এটি একটি মানসিক ও আচরণগত রোগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত সহিংসতা প্রত্যক্ষ করার কয়েক সপ্তাহ পর থেকে ব্যক্তির মধ্যে পিটিএসডির লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। এ রোগের চিকিৎসায় কাউন্সেলিংয়ে গুরুত্ব দিতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি স্কুল-কলেজেও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার বিষয়ে জোর দিয়েছেন। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ১৪ জুলাই পর্যন্ত শান্তিপূর্ণই ছিল। আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার সূত্রপাত ১৫ জুলাই। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠে পুলিশসহ ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। হামলায় আহত হন তিন শতাধিক।

১৫ জুলাই আহত হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহেদী মামুন। তিনি একটি দৈনিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। ঘটনার রাতে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশের ছররা গুলিতে আহত হন তিনি। 

বণিক বার্তাকে মেহেদী মামুন বলেন, ‘প্রায় ৪০টি স্প্লিন্টার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রবেশ করে। কাছ থেকে গুলি করায় তা বেশি গভীরে প্রবেশ করে। এছাড়া মাটিতে পড়ে যাওয়ায় ডান কানের পাতা ও চোয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ২০টির মতো স্প্লিন্টার বের করা হয়েছে।’

বর্তমান শারীরিক ও মানসিক অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অপারেশন করা স্থানগুলোর ক্ষত শুকালেও সমস্যা রয়েছে ডান কানের পাতা ও চোয়ালে। এখনো অবশ বোধ হয়; ব্যথাও আছে; শরীর দুর্বল। স্মৃতিশক্তিও কিছুটা কমে গেছে মনে হয়। আর কখনো ঘটনার কথা মনে হলে অস্থিরতা ও শঙ্কা জাগে। নিজেকে জোর করে শক্ত রাখার চেষ্টা করি।’

যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস মেডিসিনের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পিটিএসডি হলে ব্যক্তির প্রায়ই মনে হয়, যে ঘটনায় তিনি আক্রান্ত হয়েছেন, তিনি এখনো ওই ঘটনার মধ্য দিয়েই যাচ্ছেন। ওই ঘটনা আবার ঘটতে পারে এমন আতঙ্কও মাঝে মাঝে কাজ করে।

সহিংসতার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মহসিন বিন মোজাম্মেল। ১৮ জুলাই ছররা গুলিতে বিদ্ধ হন ব্র‍্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষার্থীও। তার চোখের পাশের একটি অংশে এখনো একটা গুলি রয়ে গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় চিকিৎসকরা সেটি এখনো বের করেননি। 

বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘১৮ জুলাইয়ের কথা মনে পড়লে আমার মধ্যে উৎকণ্ঠা কাজ করে, দুশ্চিন্তা কাজ করে। কখনো কখনো রাতে ঘুম ভেঙে যায়। আমার সামনে পুলিশের গুলির আওয়াজ ও বন্ধুদের আহত হওয়ার দৃশ্য ভাসতে থাকে। তবে আমি নিয়মিত কাউন্সেলিং নিচ্ছি। যাতে এই ট্রমাটিক অবস্থা থেকে মুক্ত হতে পারি।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ড. আহমেদ হেলাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের উপসর্গগুলো কোনো ভয়ংকর ঘটনার সাক্ষী হওয়া ব্যক্তির মধ্যে প্রায় এক মাস পর থেকে বেশি দেখা যায়। উপসর্গ দেখা দিলে প্রথমে কোনো মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে কাউন্সেলিং করাতে হবে। এর পরও উন্নতি না হলে কিছু ওষুধ সেবন করতে হবে।’

নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী জুলফিকার আলী গুলিবিদ্ধ হন রাজধানীর উত্তরা এলাকায়। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক ছররা গুলি আছে। চোখের পাশে ছররা গুলি থেকে যাওয়ায় তার পরিবার ভয়ের মধ্যে আছে। মা মরিয়ম বেগম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার ছেলে কিছুক্ষণ পর পর কান্না করে। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ করে উঠে বসে। তখন তার চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক বিরাজ করে। কিছু জিজ্ঞাসা করলে সে বলতে পারে না। দিনে তার চেহারায় বিষণ্নতার ছাপ থাকে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. একেএম রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখন পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের উপসর্গ দেখা যাবে। কেউ হয়তো বুঝতে পারবেন, কেউ বুঝতে পারবেন না। পিটিএসডিতে আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্সেলিং দরকার। দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এর ব্যবস্থা করতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা নিয়মিত কাউন্সেলিং নিতে পারেন। কারণ সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সুবিধা নেই বললেই চলে।’

আন্দোলনে আহত হয়েছেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীও। তাদের বিষয়ে ড. রেজাউল করিম বলেন, ‘স্কুল-কলেজে কাউন্সেলিংয়ের জন্য প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবী টিম গঠন। এর মাধ্যমে তারা এলাকাভিত্তিক কাউন্সেলিং কার্যক্রম চলমান রাখতে পারবে।’

মনোবিজ্ঞানের এ অধ্যাপকের পরামর্শ হলো, ‘বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী টিম গঠন করলে তা দ্রুত ফলপ্রসূ হবে। গ্রামাঞ্চলেও স্বেচ্ছাসেবীর মাধ্যমে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। গ্রামের অনেকেই তা নিতে চাইবে না। এজন্য প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন