কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলায় গতকাল ত্রাণবাহী একটি নৌকা দেখেই ছুটে আসে বাকশীমূল গ্রামের বাসিন্দারা। এদের একজন কৃষক বাবুল মিয়া। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গত দুদিন খাবার নিয়ে গ্রামে কোনো নৌকা আসেনি। নৌকা না এলে আমরা খাবার পাব কীভাবে? আমাদের আশ্রয় কেন্দ্রে খাবার না পেয়ে অনেক শিশু কান্নাকাটি করছে।’
স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, বুড়িচংয়ের বিভিন্ন স্থানে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী রয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত নৌকা না থাকায় ত্রাণসামগ্রী বন্যাকবলিত অঞ্চলে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। তারা জানান, বুড়িচং উপজেলায় তিনদিন ধরে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানে করে ত্রাণসামগ্রী আসছে। এগুলো রাখা হচ্ছে উপজেলার দুটি মসজিদে। সেনাবাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবীরা নৌকায় করে এসব ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু চাহিদার তুলনায় নৌকার সংখ্যা খুবই কম।
আশরাফুল ইসলাম নামের এক স্বেচ্ছাসেবক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পর্যাপ্ত নৌকা না থাকায় খাবার সরবরাহ করা যাচ্ছে না।’
বাকশীমূলের এক বাসিন্দা বলেন, ‘চিড়া-মুড়ি পেয়েছি তিনদিন আগে। নৌকা আমাদের সামনে দিয়ে চলে যায়। আমাদের পাড়ায় অনেক গাছপালা থাকার কারণে বাড়িঘর দেখা যায় না। তাই নৌকা দেখলে আমরা ডাক দিই।’
কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলায় দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। নৌকা থাকলেও পর্যাপ্ত ত্রাণ নেই এ উপজেলায়। ফলে বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।
বুড়িচং ও মনোহরগঞ্জ উপজেলায় চারদিন ধরে কাজ করছেন ইয়াসির আরফাত নামের এক যুবক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মনোহরগঞ্জের শ্রীরামপুর গিয়ে দেখলাম বানভাসি মানুষ ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে।’
শুধু কুমিল্লা নয়, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে বন্যাকবলিত বাকি ১০ জেলায়ও। বিশেষ করে শুকনা খাবার ও সুপেয় পানির সংকট তীব্র রূপ নিয়েছে।
এদিকে দেশে বন্যাকবলিত ১১ জেলার মধ্যে নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বাকি নয় জেলায় পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত রয়েছে।
গতকাল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বন্যার কারণে গত এক সপ্তাহে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৫৭ লাখ। মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের। এর মধ্যে কুমিল্লায় ছয়জন, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে পাঁচজন করে এবং কক্সবাজারে তিনজন মারা গেছে। একজন করে মারা গেছে ফেনী, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষ্মীপুরে।
বন্যার পানির তীব্র স্রোতে গতকাল নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ মুছাপুর রেগুলেটর ভেঙে যায়। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয়দের মাঝে। তারা জানান, শনিবার রেগুলেটরের পশ্চিম অংশে ফাটল ধরে। তাৎক্ষণিক পানি উন্নয়ন বোর্ড কিছু জিও ব্যাগ দিয়ে সামাল দেয়। কিন্তু গতকাল সকালে হঠাৎ পুরো রেগুলেটরে ফাটল ধরে এবং মাঝের অংশ ভেঙে যায়। একপর্যায়ে ভেঙে যায় পুরোটাই।
নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সী আমির ফয়সাল বলেন, ‘রেগুলেটরের ২৩টি গেট দিয়ে গত কয়েক দিন ফেনীর বন্যার প্রচুর পানি নেমেছে। গতকাল সকালে মুহূর্তের মধ্যেই পুরো রেগুলেটর ভেঙে যায়।’
লক্ষ্মীপুরেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এ জেলায় পানিবন্দি রয়েছে প্রায় আট লাখ মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ২৩ হাজার মানুষ বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছে। স্থানীয়রা জানান, নোয়াখালী থেকে অনবরত বন্যার পানি রহমতখালী খাল হয়ে লক্ষ্মীপুরে ঢুকছে। দুর্গম এলাকাগুলোয় কোনো খাবার যাচ্ছে না।
এদিকে উজানের পানিতে চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে পাঁচ শতাধিক পরিবার।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুর প্রতিনিধি)