এখনো আতঙ্কে শিশুরা

‘হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছুড়বে না তো?’

নিজস্ব প্রতিবেদক

‘আমার মেয়ে আগে বিমান দেখলে ছুটে যেত, হাত নেড়ে বিদায় জানাত। কিন্তু এখন আর তা করে না। বিশেষ করে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনলেই ভীত হয়ে যায়, আঁতকে ওঠে। ঘরের বাইরে যেতে চায় না। নিয়ে যেতে চাইলেও বলে—নিচে গেলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে’ ছবি: নূর আলম

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে রাজধানীর যেসব এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে তার একটি মোহাম্মাদপুর। ওই এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকেন পান্না আহমেদ। সংঘর্ষের দিন অর্থাৎ ১৯ জুলাই তার চার বছরের মেয়ে আফিফা নানুর সঙ্গে ছাদে গিয়েছিল খেলা করতে। হঠাৎই হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া হয় কাঁদানে গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড, যা দেখে সে প্রচণ্ড ভয় পায়। এর পর থেকে শব্দ শুনলেই আঁতকে ওঠে শিশুটি। অথচ অন্য শিশুদের মতো সেও হেলিকপ্টার কিংবা উড়োজাহাজ দেখলে আনন্দে মেতে উঠত। হাত নেড়ে বিদায় জানাত।

ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে পান্না আহমেদ বলেন, ‘‍আফিফা সেদিন তার নানুর সঙ্গে ছাদে খেলছিল। হঠাৎ সংঘর্ষের তীব্রতা বেড়ে যায়। হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়া হচ্ছিল। আমি ছুটে গিয়ে দেখি মা চিৎকার করছে আর আমার মেয়েও তার সঙ্গে কাঁদছে। তাদের নিয়ে কোনোমতে নিচে নেমে আসি। এর পর থেকে আমার মেয়ে আর ঘরের বাইরে যেতে চায় না। আমি নিয়ে যেতে চাইলেও বলে, নিচে গেলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমার মেয়ে আগে বিমান দেখলে ছুটে যেত, হাত নেড়ে বিদায় জানাত। কিন্তু এখন আর তা করে না। বিশেষ করে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনলেই সে আঁতকে ওঠে। সে প্রশ্ন করে, গুলি ছুড়বে না তো?’ 

কেবল আফিফাই নয়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে যেসব স্থানে সংঘর্ষ হয়েছে তার নিকটবর্তী এলাকার বেশির ভাগ শিশুর মাঝেই এ ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। বণিক বার্তার পক্ষ থেকে মোহাম্মদপুর, আজিমপুর, মিরপুর ও উত্তরার সংঘর্ষস্থলের নিকটবর্তী আবাসিক ভবনের মোট ১৭টি পরিবারের সঙ্গে কথা হয়। এর মধ্যে ১৩টি পরিবারের অভিভাবক জানিয়েছেন, এ ঘটনার পর তাদের সন্তানরা, বিশেষত তিন থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। আগে যেসব শিশু ঘরের বাইরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকত তারা এখন বের হতে চায় না। এমনকি অনেকে খেলার প্রতিও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। সামান্য শব্দেও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠছে। 

মনোবিদরা বলছেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে শিশুদের আতঙ্কিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে পরিবারের সান্নিধ্য পেলে তারা এ পরিস্থিতি থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে পারে। অন্যথায় এর প্রভাব পড়তে পারে দীর্ঘমেয়াদি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ ধরনের সংঘর্ষে যারা আশপাশে থাকে তাদের আতঙ্কিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে কোনো শিশু যখন সামনে থেকে গুলিবর্ষণ, আহত হওয়া বা ভীতিকর কিছু দেখে তখন সেটি ট্রমায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এক্ষত্রে কাউন্সেলিং প্রয়োজন। অন্যথায় দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তবে যারা গোলাগুলির শব্দ শুনে ভয় পেয়েছে তাদের ক্ষেত্রে পরিবারের আন্তরিকতা, পরিবারের সদস্যদের সময় দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায় তাদেরও এটি দীর্ঘমেয়াদে বয়ে বেড়াতে হবে।’

সোমবার মোহাম্মদপুর এলাকায় ১০ বছরের কম বয়সী শিশু আছে এমন ছয়টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়। এর মধ্যে চারটি পরিবার মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি এলাকায়, একটি নূরজাহান রোডে ও একটি পরিবার লালমাটিয়ায় বসবাস করে। চারটি পরিবারের সদস্যরাই জানান, তাদের সন্তানরা সংঘর্ষের পর থেকে ভীতসন্ত্রস্ত। 

মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাসিন্দা রোখসানা আক্তার বলেন, ‘পুরো দুদিন আমরা কেউ বাসা থেকে বের হতে পারিনি। ছেলেমেয়েদেরও বাইরে বের হতে দিইনি। পরিস্থিতি এত ভয়াবহ ছিল যে বাচ্চারা তো বটেই, আমরা বড়রাই খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। আর দ্বিতীয় দিন আমাদের ভবনেরই দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটের একটি ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়। বাসার সামনেই সে গুলিবিদ্ধ হয়। তাকে যখন দেখতে যাই তখন আমার ছয় বছর বয়সী ছেলেও সঙ্গে ছিল। চারপাশে গুলির শব্দ, সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে ছেলে আগেই ভীত ছিল আর যখন গুলিবিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি দেখে তখন সে আরো ভয় পেয়ে যায়। এখন সে কোথাও একা যেতে চায় না। ঘুমের মধ্যেও কেঁদে ওঠে।’

রোখসানা আক্তারের মতো উম্মুল আরা, আব্দুল আউয়াল ও হাফসা বেগমও জানান, সংঘর্ষের জেরে তাদের সন্তানরাও ভীত হয়ে আছে এখনো। ঘরের বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছে। 

সংঘর্ষে গুলির ঘটনা ঘটেছিল ঢাকার আজীমপুর কলোনিতেও। এ সময় একজন ব্যাংক কর্মকর্তা নিজ বাসার সামনেই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। বুধবার বণিক বার্তার পক্ষ থেকে আজীমপুর কলোনিতে গিয়ে দেখা যায়, অন্যান্য সময়ের চেয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের আনাগোনা তুলনামূলক কম। কলোনির একাধিক ভবনের বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও কেউ রাজি হননি। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এক বাসিন্দা কেবল বলেন, ‘এখানে সবাই সরকারি চাকরিজীবী, তাই কেউই কোনো কথা বলবে না। তবে এটুকু বলতে পারি, আমাদের সন্তানরা খুব ভয় পেয়ে আছে। শুধু তারা নয়, আমরাও ভয়ে আছি। প্রতি মুহূর্তে দুঃস্বপ্ন তাড়া করে।’

এ সময় কথা হয় কলোনির ভেতরের গেটসংলগ্ন একটি দোকানে কেনাকাটা করতে আসা চতুর্থ শ্রেণী পড়ুয়া তাসনীমের (ছদ্মনাম) সঙ্গে। জানতে চাইলে তাসনীম বলে, ‘সেদিন সারা দিনই মা বাসা থেকে বের হতে দেয়নি। সন্ধ্যার সময় হঠাৎ খুব চিৎকার-চেঁচামেচি আর গুলির শব্দ। আমার তখন মনে হচ্ছিল সবাইকেই বুঝি মেরে ফেলবে। এর পর থেকে ঘুমাতে গেলেই আমার ভয় হয়। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়লেই আবারো গুলি শুরু হবে।’

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ১৮ ও ১৯ জুলাই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে উত্তরা ও মিরপুর ১০ এলাকায়ও। এর মধ্যে উত্তরার সাতটি পরিবারের সঙ্গে বণিক বার্তার কথা হয়। এর মধ্যে পাঁচটি পরিবার শিশুদের আতঙ্কিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। তাদেরই একজন সরকারি কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ (ছদ্মনাম)। বিএনএস সেন্টারের পাশেই দীর্ঘদিন ধরে বাস করছেন তিনি। সেদিনের মুহুর্মুহু গুলির ঘটনা এখনো ভুলতে পারছেন না। একই অবস্থা তার সন্তানদেরও। তারা এখন বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছে। হারুনুর রশিদ বলেন, ‘আমরা নিজেরাই এখন প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কে থাকি। আমার সন্তানরা তো জানালা খুলতেই ভয় পায়।’ 

একই এলাকার বাসিন্দা রুমানা ইসলাম। তার সঙ্গে কথা হলে বলেন, ‘আমার একটাই মেয়ে, বয়স সাত বছর। সংঘর্ষে গোলাগুলির শব্দ শোনার পর থেকে সে খুব ভীত। দুদিন সবসময় প্রশ্ন করত, আমাদেরও গুলি করবে না তো? আগে বিকালের সময়টা সে ছাদেই কাটাত। ছাদে গুলিবিদ্ধ হয়ে যে বাচ্চাটা মারা গেছে সে আমাদের এক প্রতিবেশীর আত্মীয়। ঘটনাটি শোনার পর থেকে আমার মেয়ে আর ছাদে যেতে চায় না। এমনকি বারান্দায়ও যেতে চায় না। বারান্দার গ্লাস খুললেই সে আমাকে বলে, মা বারান্দা বন্ধ করো প্লিজ, আমার ভয় লাগছে।’

মিরপুর ১০ নম্বর এলাকার দুটি পরিবারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। এদের একজন তাজরীন সুলতানা। গোল চত্বরের যে স্থানে সংঘর্ষ হয়েছিল সেখান থেকে তাদের বাসার দূরত্ব খুবই কম। তাজরীন সুলতানা বলেন, ‘আমার দুই ছেলেমেয়ে খুব ভয় পেয়ে আছে। ওরা সামনে থেকে কিছু দেখেনি। তবে গোলাগুলির শব্দ শুনেছে। আশপাশের মানুষের কাছে ‍শুনেছে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হচ্ছে। এ কারণে ওরা এখন হেলিকপ্টারের শব্দ শুনলেই ভয় পেয়ে যায়। ছুটে গিয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়। ওরা মনে করে, আবারো হয়তো কোথাও সংঘর্ষ হচ্ছে। আমি ওদের ভয় দূর করে স্বাভাবিকতায় ফেরাতে পারছি না। তাছাড়া কী নিশ্চয়তা আছে যে আবারো একই পরিস্থিতি হবে না?’

এ ধরনের চাপ বা বিপর্যয়ের ফলে মানুষের মধ্যে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় বলে জানান জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম। তার একটি হলো অ্যাকিউট স্ট্রেস রিঅ্যাকশন আর দ্বিতীয়টি পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস রিঅ্যাকশন। এর মধ্যে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস রিঅ্যাকশন অর্থাৎ যখন তাৎক্ষণিক তীব্র চাপটি আসে তখন তার মধ্যে ভীতি, আতঙ্ক, নিদ্রাহীনতাসহ কিছু মানসিক সমস্যা তৈরি হয়। এটা তার মস্তিষ্কেও একটি অভিঘাত তৈরি করে বলে জানান এ মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। 

ডা. তাজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্রেইন যখন কোনো আঘাত বা ট্রমা স্মৃতি হিসেবে রেখে দেয় তখন তারা ওই একই ধরনের ঘটনা বা শব্দে আঁতকে ওঠে। কারণ মস্তিষ্ক তখন সিগন্যাল দেয় যে আবারো হয়তো একই ঘটনা ঘটবে। কারণ আমাদের মস্তিষ্ক এমন একটি সিস্টেম তৈরি করে রেখেছে যে কোনো বিপদ, ভয় কিংবা হুমকি এলে এটি সিগন্যাল দেয়, বিপদ আসছে প্রস্তুত হও। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমরা তিন ধরনের সাড়া দিই। প্রথমটি হলো বিপদ মোকাবেলা বা ফাইট, দ্বিতীয়টি পালানো। আর তৃতীয়টি হলো বিপদ দেখে হতভম্ব হয়ে যাওয়া, এটিকে বলা হয় ফ্রিজ। যখন মস্তিষ্ক তার স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে আশপাশের কোনো শব্দের বা ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিপদের সংকেত দেয় তখন আমরা এর যেকোনো একটি প্রতিক্রিয়া দিই।’

শিশুদের ক্ষেত্রে এ ধরনের পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে ডা. তাজুল ইসলামের পরামর্শ, তাদের সময় দেয়া এবং বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত করা। এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হলে পরিবারের অন্য সদস্যদের, বিশেষ করে বাবা-মাকে সময় দিতে হবে। তার পাশে থাকতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে ভয়ের কিছু নেই, এমন পরিস্থিতি হতেই পারে। জীবনে এগুলো মোকাবেলা করেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন