দীর্ঘমেয়াদি করনীতি হলে বিনিয়োগ ও রফতানি বৃদ্ধি করা সম্ভব

ছবি : বণিক বার্তা

গত এক দশকে দেশের ইলেকট্রনিকস ও হোম অ্যাপ্লায়েন্সের বাজারে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রতি বছরই গড়ে দুই অংকের প্রবৃদ্ধি হয়েছে এ শিল্পে। মাঝে কভিড, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের প্রভাবে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকটের কারণে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যায় খাতটি। তবে সেখান থেকে বর্তমানে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে ইলেকট্রনিকস ও হোম অ্যাপ্লায়েন্সের বাজার। একসময় আমদানিনির্ভর এ খাত ভবিষ্যতে সম্ভাবনাময় রফতানি পণ্যে পরিণত হওয়ার স্বপ্নও দেখাচ্ছে। বাজার অংশীদারত্বের ক্ষেত্রেও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে হটিয়ে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আধিপত্য বাড়ছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশের কনজিউমার ইলেকট্রনিকসের বাজারে গত ১০ বছরে গড়ে ১৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০২৫ সালে এর আকার ৬ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান, মাথাপিছু আয় ও শহরে মানুষের বসবাসের প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে কনজিউমার ইলেকট্রনিকসের বাজারের প্রবৃদ্ধি নির্ভরশীল। স্থানীয় বড় ব্যবসায়িক গ্রুপগুলো ইলেকট্রনিক খাতে বড় অংকের বিনিয়োগ করেছে। পাশাপাশি বাজার ধরে রাখতে বেশকিছু বিদেশী ব্র্যান্ডও বাংলাদেশে তাদের কারখানা স্থাপন করেছে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে দেশের ইলেকট্রনিক পণ্য শিল্পসংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, কর, শুল্ক, সুদহার ও রফতানি সম্ভাবনা নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন ইলেকট্রো মার্ট গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. নুরুল আফছার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরফিন শরিয়ত

সম্প্রতি সুদহার বেড়েছে, টাকার মান কমেছে, ইন্ডাস্ট্রিতে এর প্রভাব কেমন দেখছেন?

সুদহার আগে সিঙ্গেল ডিজিটে ছিল, এখন তা বেড়ে ১৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কয়েকদিন আগে একদিনেই টাকার মান ৭ টাকা কমেছে। সুদহার ও টাকার মান কমায় ব্যবসায়ীদের জন্য কষ্টকর হয়ে উঠেছে। আমাদের তা সমন্বয় করতে হচ্ছে। আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে তা আবারো সঠিক সমাধানে আসবে। আমাদের ব্যবসায়ীদের দাবি, সুদহার যাতে সিঙ্গেল ডিজিটে ফিরে আসে বিশেষ করে আমাদের দেশীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর জন্য ছাড় দেয়া হয়।

ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘমেয়াদি কোনো প্রভাব ফেলবে?

দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব তো অবশ্যই ফেলবে। ১৪ শতাংশ সুদ দিয়ে কোনো দেশেই ব্যবসা টিকিয়ে রাখা অনেক কঠিন। ডলারের এক্সচেঞ্জের কারণে অনেক সময় এলসি পাচ্ছি না, অনেক সময় এলসি করতে দেরি হচ্ছে, কাঁচামাল আসতে সময় নিচ্ছে, মার্কেটের চাহিদা ঠিক রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ইন্ডাস্ট্রির কর্মকর্তা-কর্মচারীর খরচ, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই নাভিশ্বাসের মধ্যে আছি। আশা করি এটা অল্প সময়ের মধ্যে সমাধান হবে।

মান বিবেচনায় দেশীয় পণ্যের অবস্থান এখন কেমন?

মান বিবেচনায় দেশে তৈরি ইলেকট্রনির পণ্য এবং বিদেশে তৈরি পণ্যের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশীয় পণ্য বিদেশী পণ্যের তুলনায় ভালো। বরং দেশে তৈরি ইলেকট্রনিক পণ্যের ক্ষেত্রে দেশের আবহাওয়ার কথা এবং গ্রাহকদের কাঙ্ক্ষিত প্রয়োজনের সঙ্গে মানানসই করে প্রস্তুত করা হয়। ফলে দেশের পরিবেশ, ক্রেতাদের আর্থিক সক্ষমতা, প্রযুক্তির ব্যবহারের দক্ষতা এবং এলাকা ভেদে চাহিদার ভিন্নতা বিবেচনায় বিদেশে তৈরি পণ্যের তুলনায় আমাদের দেশে উৎপাদিত পণ্যগুলো অনেক ভালো।

এ খাতের রফতানি বাজার নিয়ে আপনারা কোনো চিন্তা করছেন কিনা?

বর্তমানে দেশে উৎপাদিত ইলেকট্রনিক পণ্য দেশেই বিক্রি হচ্ছে। শিগগিরই আমরা নিকটবর্তী দেশগুলোয় রফতানির পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। বর্তমানে এ খাতের জন্য সরকারের নীতিমালা ইলেকট্রনিকস শিল্পে বিনিয়োগ ও কারখানা স্থাপনের জন্য যথেষ্ট অনুকূল বলেই আমরা বিশ্বাস করি। এছাড়া ২০২২-২০৪১ সালের মধ্যে চারটি পাঁচ বছরের পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ শিল্পায়নের মাধ্যমে উচ্চ আয়ের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্য রয়েছে। এ উদ্যোগ বাংলাদেশ থেকে রফতানি বিকাশের জন্য উৎপাদন ক্ষমতা সম্প্রসারণ এবং মানব পুঁজি উন্নয়নে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে। ফলে এ খাতের জন্য সরকারের নীতিসহায়তা দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে অব্যাহত থাকলে গার্মেন্টস ও অন্যান্য রফতানিমুখী শিল্পের সঙ্গে মেড ইন বাংলাদেশ ট্যাগ লাগিয়ে এ খাতও একটি রফতানিমুখী নতুন শিল্প খাতে পরিণত হবে বলে আশাবাদী।

হাইটেক পার্কগুলোয় কিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আসছে, কিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আসছে না। এখানে বিনিয়োগ সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?

হাইটেক পার্কগুলোয় বিদেশী বিনিয়োগ আসবে। কিন্তু বিগত বছরগুলোয় সরকারের সহযোগিতার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে, শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এখন যদি নতুন করে আবার হাইটেক পার্কে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় তাহলে বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে। এরই মধ্যে সবাই অনেক বড় বিনিয়োগ করে ফেলেছে, নতুন কোনো নীতি এলে তা আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

জুনেই ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সংসদে উপস্থাপন করা হবে। সরকারের কাছ থেকে আপনাদের প্রত্যাশা কী?

প্রতি বছর বছর মেয়াদি কর অব্যাহতি বা সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। যদি সেটি বছর মেয়াদি না করে দীর্ঘমেয়াদি করে দেয়া হয় তাহলে এ খাতে আরো বিনিয়োগ বাড়বে। বছর মেয়াদি ট্যাক্স হার নির্ধারণ করা হলে নতুন বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করবে। বছর মেয়াদি হলে সবাই চিন্তা করে আমি আগামী বছর এ সুযোগ-সুবিধা পাব কিনা, যদি না পায় তাহলে ব্যাংক ঋণ, সুদহার, ব্যাংকের দায় পরিশোধ করা, ব্রেক ইভেনে আসা, সবকিছু একটি ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে দাঁড়ায়। সেজন্য সরকারের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে ২০২৪ সালে যেটা শেষ হয়ে যাবে তা যেন দীর্ঘমেয়াদি ২০৩৫ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি সুযোগ-সুবিধা দেয়া হোক। পাশাপাশি শুল্কনীতিগুলো সহজীকরণ করা হয়, রাজস্ব নীতি ব্যবসাবান্ধব হয় তার প্রত্যাশা থাকবে।

ডলার সংকট ইলেকট্রনিকস শিল্প খাতে প্রভাব কেমন রাখছে?

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজায় ইসরায়েলি হামলা, মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এসব ঘটনায় বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইন অনেকটা বাধাগ্রস্ত। ডলার সংকটের কারণে দেশের ইলেকট্রনিকস খাতে কাঁচামাল ও অন্যান্য খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি বেশকিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলো এলসি প্রদানে বিলম্ব হওয়ায় যথাসময়ে কাঁচামাল নিশ্চিত করে উৎপাদন প্রক্রিয়া বারংবার বিঘ্নিত হচ্ছে। তবে বাজার চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করে কাঁচামাল আমদানির মাধ্যমে উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রমসংক্রান্ত এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার চেষ্টা করা হচ্ছে।

এবারের বাজেটে আপনারা কী রকম সুযোগ-সুবিধা চান?

সরকার কয়েক বছর ধরে এ খাতের উন্নয়নে নানা ধরনের সহযোগিতা প্রদান করে আসছে। বার্ষিক ভিত্তিতে সরকার ২০২৪ সাল পর্যন্ত এ খাতে অব্যাহতি সুবিধা দিয়েছে। আমরা সরকার ভ্যাট-ট্যাক্সের এ সুবিধাকে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা এবং কাস্টমস শুল্কায়ন ও ভ্যাট বিভাগের রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়ার সব নীতিমালা সহজীকরণের আবেদন করছি। তাহলে এ খাতের বাজার আরো বেশি বিকশিত হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। স্বল্পমেয়াদি নীতির কারণে বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ থাকে কখন এটি পরিবর্তন হয়ে যায়। এতে নতুন করে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে অনেক বেশি সময় নেয়। ফলে এ খাতে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ আসে না। স্বল্পমেয়াদি নীতি সহায়তা খুব বেশি ফলপ্রসূ হয় না। কোনো শিল্প-কারখানা করা হলে সেখান থেকে ব্রেক ইভেনে পৌঁছতে কমপক্ষে ১০-১৫ বছর সময়ের প্রয়োজন। বিনিয়োগের এক বছর পর নতুন নিয়ম এলে বা নীতি পরিবর্তন হলে বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে পড়েন এবং দীর্ঘমেয়াদি ব্যাংক ঋণের দায় নিয়ে তাদের বিনিয়োগ বোঝা হয়ে ওঠে এবং একসময় শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি বন্ধ/দেউলিয়া হয়ে যায়। সেজন্য সহজে কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না। এছাড়া শিল্পের কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে দ্রুত এলসি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্ধারিত হারে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ডিজেল সরবরাহ করার ব্যবস্থা করার অনুরোধ করছি।

অবৈধ পণ্য দেশে ব্যবসার পরিবেশে কেমন প্রভাব ফেলছে? কার্যকর কোনো পদক্ষেপ আছে এক্ষেত্রে? 

সরকারি প্রশাসনের দৃঢ় পদক্ষেপ, কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও দক্ষ মনিটরিংয়ের কারণে বর্তমানে অবৈধ পণ্য দেশে আসার কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া দেশে স্টিকার যুক্ত করে নকল পণ্য সরবরাহের জন্য সৃষ্ট বাজার মনিটরিং কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন, যাতে ক্রেতা ও ভোক্তারা প্রতারিত ও বঞ্চিত না হয়। ফলে দেশের ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজার অবৈধ/নকল পণ্য দ্বারা প্রভাবিত হবে না।

ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তি নিয়ে বড় কোনো জটিলতা আছে?

বর্তমানে ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তিতে বেশকিছু জটিলতা ও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে ঋণ প্রদান অনাগ্রহ প্রকাশ করে। এছাড়া বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অংকের মধ্যে ঋণ সুবিধা প্রাপ্তি। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সহযোগিতায় বিনিয়োগকারীরা কয়েক বছর ধরে এ সুবিধা ভোগ করে আসছে। বর্তমানে এটি আবার প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়ে বাড়ছে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প ক্ষেত্রে এর প্রভাব ব্যাপক আকারে থাকবে এবং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে আসবে, যা উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তা পর্যায়ে সবাইকে প্রভাবিত করবে। ফলে আমাদের দাবি বৃহৎ শিল্পের বিনিয়োগ খাতে ঋণের সুদহার এক অংকের সুবিধাটি আরো যেন ৭-১০ বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয় এবং ঋণ প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজীকরণ করা।

স্থানীয় বাজারে বিদেশী পণ্য ও দেশীয় উৎপাদকদের মধ্যে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রটি এখন কেমন?

কয়েক বছর ধরে ইলেকট্রনিকস খাতকে এগিয়ে নিতে সরকার শুল্ক, কর, ভ্যাট অব্যাহতিসহ নানা সুবিধা দিয়ে আসছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঠিক ও যোগ্য নেতৃত্বে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শতভাগ বিদ্যুতায়িত হওয়ায় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজারটা অনেক বেশি বিকশিত হচ্ছে। ফলে দেশে এ খাত বর্তমানে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পথে। দেশে ইলেকট্রনিক পণ্যের চাহিদার ৮০-৮৫ শতাংশ চাহিদা স্থানীয় উৎপাদকরাই সরবরাহ করে যাচ্ছে। ফলে এ খাতে স্থানীয় উৎপাদকদের মধ্যেই তীব্র প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ফলে পণ্যের গুণগত মানও উন্নতি লাভ করছে এবং দামও ক্রেতাদের আর্থিক সক্ষমতার মধ্যে আসছে। প্রতিযোগিতায় বিদেশী ইলেকট্রনিক পণ্য খুব একটা নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন