সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি

মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় ভাতার পরিমাণ বাড়ানো ‍উচিত

অসহায় ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান বাড়ানোর জন্য সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করে। প্রতি বছর এসব ভাতার উপকারভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় প্রদত্ত ভাতা কতটুকু কাজে লাগছে তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এছাড়া এ অর্থ মানুষকে কর্মক্ষম করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রণোদনা হিসেবে ব্যয় করা যায় কিনা সেটিও বিবেচনার প্রসঙ্গ উঠেছে। যেহেতু সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতার পরিমাণ বাড়লে উপকারভোগীর সংখ্যাও বাড়ে, তাই এ কর্মসূচির সর্বোচ্চ সুফল নিশ্চিত করতে হবে।

বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় বর্তমানে একজন বয়স্ক ব্যক্তি মাসে ৬০০ টাকা ভাতা পান। একজন বিধবা ও নিগৃহীতা নারী পান ৫৫০ টাকা। তবে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির প্রভাবে যৎসামান্য এ ভাতায় এসব জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদার সামান্যই পূরণ হয়। ভাতার অর্থে বয়স্ক ও বিধবারা বর্তমানে মাসে সর্বোচ্চ ১১ কেজি চাল বা আলু কিনতে পারেন।

সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আশির দশকে বিভিন্ন ভাতা চালু করেছিল সরকার। মূলত সামাজিক নিরাপত্তাবলয় সুসংহত করার মাধ্যমে জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নই ছিল এ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য। এর আওতায় বিভিন্ন ধরনের ভাতা দিচ্ছে সরকার। প্রতি বছর এসব ভাতার উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে জনপ্রতি টাকার অংকে এ আর্থিক সহায়তার পরিমাণ খুবই কম। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণীতে রয়েছে বয়স্ক, বিধবা ও নিগৃহীতা নারী এবং প্রতিবন্ধীরা। এ তিন শ্রেণীর ভাতাভোগীর সংখ্যা বর্তমানে ১ কোটি ১২ লাখ ৭৬ হাজার। বর্তমানে ভাতাপ্রাপ্তদের মধ্যে বয়স্করা প্রতি মাসে ৬০০, বিধবারা ৫৫০ ও প্রতিবন্ধীরা পাচ্ছেন ৮৫০ টাকা। এ অর্থে এসব জনগোষ্ঠীর মাসিক চাহিদার কতটুকু পূরণ হয় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তার ওপর ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি ও টাকার অবমূল্যায়নের প্রভাবে ভাতার অর্থের মূল্য আরো সংকুচিত হয়ে পড়ছে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী, রোববার ঢাকার বাজারে এক কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৫০-৫২ টাকা। কেজিপ্রতি আলুর দাম ছিল ৪৫-৫০ টাকা। আর এক কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল ৭৩০-৭৫০ টাকা। ফলে ৬০০ বা ৫৫০ টাকা মাসিক ভাতায় একজন বয়স্ক ব্যক্তি কিংবা বিধবার পক্ষে এক মাসে সর্বোচ্চ ১১ কেজি মোটা চাল কিংবা আলু কেনা সম্ভব। তবে তারা চাইলেও এ টাকা দিয়ে এক কেজি গরুর মাংস কিনতে পারবেন না।

বয়স্ক জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছর থেকে ভাতার কার্যক্রম চালু করা হয়। বিধবা ও স্বামী কর্তৃক নিগৃহীতা দুস্থ নারীদের পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের প্রতি সরকারের সাংবিধানিক ও আইনগত প্রতিশ্রুতি পূরণ, অসচ্ছল, দুস্থ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য প্রতিবন্ধী ভাতা চালু করে সরকার। আবার সরকারি কর্মচারীদের পেনশনের অর্থও সামাজিক সুরক্ষার আওতাভুক্ত করে আকার বাড়ানো হয়েছে। 

গত পাঁচ বছরে ভাতার পরিমাণ যে হারে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে তার চেয়েও বেশি। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখিতার সঙ্গে তুলনা করে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতাভোগীদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। অন্যদিকে সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে দুর্বলতার কারণে সামাজিক সুরক্ষা খাতে প্রয়োজন অনুসারে ব্যয় করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য রাজস্ব আহরণের দুর্বলতাকে দায়ী করা হচ্ছে। কারণ কর আহরণের দুর্বলতার কারণে সম্পদ বণ্টনেও অন্যায্যতা থেকে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে কর খেলাপি সংস্কৃতি দূর করার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সম্পদ আহরণের পরিমাণ বাড়ানো গেলে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা বাড়বে। তাহলেই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ানোর আশা করা যেতে পারে।

মূলত সামাজিক সুরক্ষার ভাতাকে জীবনযাপনের একমাত্র আয়ের উৎস কিংবা অবলম্বন হিসেবে মনে করছে না সরকার। বরং এটিকে সহায়তা কিংবা প্রণোদনা হিসেবেই সংশ্লিষ্টরা বিবেচনা করতে চান। এর মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের অভিঘাত মোকাবেলায় কিছুটা সহায়তা করা হচ্ছে বলেও মনে করছেন তারা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় ভাতার টাকা খাদ্যের পেছনেই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে খাবার কেনার পর উৎপাদনশীল কোনো কাজে বিনিয়োগ করা কঠিন।

তবে অতীতের মতোই ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে প্রকৃত অসহায় ব্যক্তিরা যেন ভাতা পান, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা প্রত্যাশা করব, যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি শুরু হয়েছিল, তার সর্বোচ্চ সুফল নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন