ব্র্যাক বিজনেস স্কুলে দীর্ঘদিন চাকরির সুবাদে যেসব অনবদ্য ও গর্ব করার মতো অভিজ্ঞতা আমাদের সঞ্চয়ে এসেছে তার মধ্যে অন্যতম নিশ্চয়ই সহকর্মী হিসেবে অধ্যাপক এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, অধ্যাপক সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং প্রয়াত অধ্যাপক আকবর আলি খানের মতো সম্মানিত ব্যক্তিদের সান্নিধ্য লাভ। তারা প্রত্যেকেই নিজ গুণে গুণান্বিত এবং উচ্চশিক্ষার আলয়ে তাদের বিদ্যা, এবং কর্মবলয়ে তাদের কর্মযজ্ঞের জন্য দেশব্যাপী সুপরিচিত। তবে দুটি অনন্য বৈশিষ্ট্য তাদের সবার মধ্যেই লক্ষণীয়; আর তার একটি হলো প্রিয় স্বদেশের প্রতি তাদের চূড়ান্ত দায়িত্ববোধ তথা দেশপ্রেম; অন্যটি হলো কর্মক্ষেত্র ব্র্যাক বিজনেস স্কুলে তাদের সুদীর্ঘ অবদান। সহকর্মী হিসেবে তারা সর্বদা অন্য সবাইকে সহায়তা দানে তৎপর এবং প্রচণ্ড বন্ধুবৎসল।
এ ক্ষুদ্র পরিসরে অধ্যাপক মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের বহুমুখী প্রতিভার সম্যক ধারণা প্রদান করা সম্ভব নয়। তার পরও তার অনন্যসাধারণ গুণাবলি এবং কর্মস্পৃহা সম্পর্কিত কিছু বিষয় বয়ানের দাবি রাখে। তার চিন্তার প্রসারতা এবং বুদ্ধির গভীরতার প্রমাণ আমরা পেয়েছি তার শক্তিশালী বিশ্লেষণী ক্ষমতার মাঝে। বিশেষত বিবিধ বিষয়ে তার যৌক্তিক ও সমালোচনামূলক বিশ্লেষণে। যেকোনো বড় ও জটিল সমস্যার যে সুন্দর সমাধান তিনি স্বল্প সময়ে প্রদান করেন তা তার এ শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার মধ্যেই নিহিত।
একজন শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপক ইসলাম একজন অতি দায়িত্ববান ও নিবেদিতপ্রাণ বিদ্যানুরাগী। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে উনি বিভিন্ন একাডেমিক ও পেশাদারি পরিসরে, হাজার হাজার ছাত্রের সঙ্গে তার বহুদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ কর্মজীবন ও শিক্ষাজীবনে প্রাপ্ত জ্ঞান ভাগাভাগি করে নিয়েছেন।
উনি শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের সময় ছাত্রছাত্রীদের সক্রিয় এবং সরব অংশগ্রহণের ওপর খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। শ্রেণীকক্ষে ছাত্র-শিক্ষক অংশীজন হিসেবে পরস্পরের কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করবে এবং একে অন্যকে আলোচনা ও পর্যালোচনা দ্বারা সমৃদ্ধ করবে—শিক্ষা গ্রহণের এ ধারণার ওপর তিনি খুবই আস্থাশীল। শিক্ষার মান এবং শিক্ষার উদ্দেশ্য অনুযায়ী উপযোগী তথা উন্নতমানের শিক্ষা উপকরণের ব্যাপারে অধ্যাপক মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আপসহীন। স্বনামধন্য শিক্ষক হিসেবে লম্বা পথপরিক্রমায় উনি বহু শিক্ষার্থীর জীবন গড়ে দিয়েছেন। আজ তার অনেক শিক্ষার্থী নিজ নিজ ক্ষেত্রে অতি উচ্চ আসনে আসীন, দেশে ও বিদেশে সর্বোচ্চ পেশাদারি ও কর্মকুশলতার পরিচয় দিচ্ছে।
কর্মক্ষেত্রে এবং ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় অধ্যাপক ইসলাম বহুবার বলেছেন যে ভালো মানের শিক্ষালাভের অন্যতম শর্ত হলো সঠিকভাবে তাত্ত্বিক জ্ঞান লাভ, বিষয়ভিত্তিক ধারণা লাভ এবং এসব তত্ত্ব ও ধারণার প্রায়োগিক দিক সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা অর্জন করা। তদুপরি, বিদ্যা অর্জনে কঠোর পরিশ্রম, সততা এবং নিয়ম-নীতিতে কঠোরতার ওপরও তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। ড. ইসলাম মনে করেন নীতিবর্জিত আচরণ ও সততাবিহীন শিক্ষা ভবিষ্যতের কর্মজীবনে উন্নতির অন্তরায় হবে এবং সফলতার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।
এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম একজন নিবেদিত এবং নিরলস পাঠক। ওনার সঙ্গে আলাপচারিতায় তার ব্যাপক পঠন-পাঠনের পরিচয় পাওয়া যায় এবং সেই পাঠলব্ধ আলোচনা থেকে ঋদ্ধ হওয়া যায়। পঠন-পাঠনের চর্চার দ্বারা উনি বাংলাদেশ ও বিশ্বের অর্থনীতি, সমাজ, বিশেষত বর্তমান বিশ্বের নানা নতুন নতুন সমস্যা ও সুযোগ সম্পর্কে অবগত থাকেন। ওনার সঙ্গে যেকোনো বিষয়ে গল্প জুড়ে দেয়া যায় এবং এ ধরনের সব বৈঠক থেকেই আমরা যুগপৎ আনন্দ ও চিন্তার খোরাক পেয়েছি। অধ্যাপক ইসলাম কর্তৃক ক্লাসে প্রদত্ত লেকচার কিংবা পত্রিকায় প্রকাশিত কোনো সুপাঠ্য লেখা অথবা কোনো টিভি সাক্ষাৎকারে প্রদত্ত অভিমত—এগুলো সবই বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষকে করেছে সমৃদ্ধ, দেখিয়েছে দেশবাসীকে নানা সমস্যা ও সংকট থেকে উত্তরণের রাস্তা।
অধ্যাপক এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের আরেকটি মূল্যবান অবদান হলো ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের একজন জ্ঞানী অভিভাবক হিসেবে এর শত শত শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং পরিচালনায় থাকা ব্যক্তিদের মূল্যবান পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান। তার এ অপরিমেয় অবদান কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক সংস্কারেই সীমাবদ্ধ নেই। শিক্ষায়তনের বাইরে, দেশের নানা নীতিনির্ধারক, ব্যাংক-বীমা ও করপোরেট ব্যবসার উন্নয়ন এবং দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি-বিষয়ক অগ্রগতি বিষয়েও তিনি প্রচুর অবদান রেখেছেন। ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের বিবিএ, এমবিএ এবং ইএমবিএ প্রোগ্রাম কমিটি, স্কুলের স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং কমিটি এবং নিয়োগ কমিটিতে তিনি প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবে সক্রিয় ও গুরুত্ববহ ভূমিকা পালন করছেন।
অধ্যাপক এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ দেশের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ এবং এর প্রধানতম প্রাক্তন অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারক হিসেবে সুবিদিত। কেবল একজন নামকরা অর্থনীতির শিক্ষক নয়, বরং একসময়ের বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রাক্তন প্রধান হিসেবে এ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয়ে জানার জন্য নীতিনির্ধারক ও সাংবাদিকরা তার শরণাপন্ন হন। ব্র্যাক বিজনেস স্কুলে টিভি ক্যামেরা ও মাইক হাতে অধ্যাপক ইসলামের সাক্ষাৎকার নিতে আসা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকদের আগমনের দৃশ্য একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ও ভবিষ্যৎ বিষয়ে ড. ইসলামের প্রণিধানযোগ্য মতামত যেন শেষ কথা! বাংলাদেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে অথবা অস্থির আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে—সে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধই হোক কিংবা হোক তা আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার বিষয়—দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণে, অধ্যাপক ইসলামের বিশ্লেষণই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা। তার অর্থনীতিবিষয়ক মতামত এবং ভবিষ্যদ্বাণী পুরো জাতির আস্থা অর্জন করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন একটি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে ব্র্যাক বিজনেস স্কুল মনে করে যে এর সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে জনগণকে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী বিষয়ে অবহিত করার। আমাদের স্কুলের প্রধান চিন্তাবিদ ও চিন্তানায়কদের সমন্বয়ে আমরা তাই বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পাবলিক সভা ও সেমিনারের আয়োজন করি। বলা বাহুল্য যে এসব সেমিনারে আমাদের প্রধান চিন্তানায়ক হিসেবে উপস্থিত থাকেন অধ্যাপক মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। কয়েক বছর ধরে সংসদের বাজেট অধিবেশন শেষে বাজেট উপস্থাপনের পরের দিবসে আমরা ‘বাজেট প্রতিক্রিয়া ও পর্যালোচলা’ শীর্ষক একটি সেমিনার পরিচালনা করে আসছি। অনুষ্ঠানটি দেশে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে এবং গণমাধ্যমে এখানে উল্লেখিত বাজেট প্রতিক্রিয়া ও মতামত ঢালাওভাবে প্রচারিত হয়ে থাকে। অধ্যাপক এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ সেমিনারের প্রধান বক্তা এবং মূলত তার বাজেট প্রতিক্রিয়া এবং মূল্যায়নই বাজেট পাসের পরবর্তী দিনগুলোর পত্রিকার হেডলাইন হিসেবে সারা দেশে দৃশ্যমান হয়। এগুলোই হয় বাজেট নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কের প্রধান বিষয়। অধ্যাপক ইসলামের দেশব্যাপী খ্যাতি ও মনীষা নিঃসন্দেহে ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের জন্য এক বিরাট প্রাপ্তি, আমাদের জ্ঞান অন্বেষণ ও শিক্ষা প্রসার প্রকল্পের এক অতি উপকারী সহায়ক।
পরিশেষে বলতে হয় যে অধ্যাপক ইসলামের শিক্ষক হিসেবে যে পেশাদারিত্ব ও ক্ষমতার পরিচয় আমরা পেয়েছি তা তুলনারহিত। সময়নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিটি ক্লাসের কার্যক্রম শুরু করা থেকে শুরু করে আমাদের স্কুলের পরিচালনা ও ভবিষ্যৎ নিরূপণের বিভিন্ন কমিটিতে পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষাধর্মী পরামর্শ প্রদান—প্রতি বিষয়েই লক্ষণীয় এক কর্মযোগী পুরুষ, যিনি দায়িত্বে সচেতন, নিজেকে সম্পূর্ণ কর্মে নিবেদনে সদা প্রস্তুত এবং প্রতিটি কাজে ত্রুটিহীন। কার্যালয়ে তার দ্বার সদা উন্মুক্ত। ধৈর্যশীল ড. ইসলাম একজন ভালো শ্রোতাও বটে! নবীন কিংবা প্রবীণ শিক্ষকদের যেকোনো সমস্যার সমাধানে আন্তরিক ও তৎপর অধ্যাপক ইসলামের বিজ্ঞ পরামর্শ অনেকের ভবিষ্যতের পাথেয় হয়েছে।
ব্র্যাক বিজনেস স্কুলে এ কর্মযোগীর উপস্থিতি আমরা অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে উদযাপন করি। ওনার দেশব্যাপী সম্মান ও পরিচিতি, পেশাদারি, মনীষা ও প্রজ্ঞা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যবান সম্পদ। ব্র্যাক বিজনেস স্কুল তথা তৎসংশ্লিষ্ট সব অংশীজন অধ্যাপক এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের গুণগ্রাহী। আমরা অধ্যাপক ইসলামের সহকর্মী হিসেবে নিজেদের ভাগ্যবান মনে করি এবং দেশ ও আন্তর্জাতিক তার ব্যাপক কর্মকাণ্ড, দীর্ঘ অবদানের অংশ হিসেবে গর্ববোধ করি।
মোহাম্মদ মুজিবুল হক: অধ্যাপক এবং অ্যাসোসিয়েট ডিন (অ্যাকটিং ডিন), ব্র্যাক বিজনেস স্কুল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
শামীম এহসানুল হক: সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিজনেস স্কুল
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়