
ড. মসিউর রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। আমি ও মসিউর দুজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ব্যাচের ছাত্র। মসিউর রহমান সরাসরি আমার বন্ধু ছিলেন। তবে আমি ভর্তি হয়েছিলাম সমাজবিজ্ঞান বিভাগে আর মসিউর ইংরেজি বিভাগে। সেই সময়ে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় তার রেজাল্ট ছিল এক কথায় ব্রিলিয়ান্ট। বাগেরহাটের বিখ্যাত সরকারি পিসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় মসিউর রহমান। সেই সময়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়া অনেক কঠিন ছিল। এমনকি অনেক বিখ্যাত (পরবর্তী সময়ে) মানুষ যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হয়েছিলেন তারা কিন্তু তৃতীয় শ্রেণীতে পাস করেছেন এই ইংরেজি বিভাগ থেকে। সেখানে মসিউর দুর্দান্ত রেজাল্ট করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রিতে পোস্ট গোল্ড মেডেলসহ প্রথম স্থান ও এমএ ডিগ্রিতে দ্বিতীয় স্থান নিয়ে পাস করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর পরই মসিউরের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করলেও সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে ছিল তার ব্যাপক আগ্রহ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় থেকে আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা করতাম। সেখানে তৎকালীন পাকিস্তানের অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে মসিউরের বক্তব্যগুলো ছিল সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার ফসল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করার পর মসিউর তার নিজের বিভাগেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পায়। তার আগে সে বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতাও করেছে। আমি নিয়োগ পাই বুয়েটে। সেখানে আমি সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও স্থাপত্য বিভাগে নগর পরিকল্পনা বিষয়ে পড়াতাম। পরে আমিও বুয়েট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হই। আমরা যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়তাম এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম তাদের মধ্যে অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছিলাম। তাদের মধ্যে ইংরেজি বিভাগে মসিউর ছাড়াও অর্থনীতি বিভাগে ড. সামাদ (১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব), ড. লতিফুর রেজা, সমাজবিজ্ঞান বিভাগে আমি ও এমএম রেজা, এছাড়া আহবাব আহমেদ, ড. ওয়ালিউল ইসলামসহ আরো অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক হয়েছিল।
আমরা যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম এবং শিক্ষক হয়েছিলাম সেই বন্ধুদের গ্রুপটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাউঞ্জে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সিনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকের মতো বসে আলোচনা করতাম। মসিউর সে সময়ে দেশের মানুষের মুক্তি, স্বাধীনতা, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি-সংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনায় তুলে আনত। আমরা তখন থেকেই তার যে চিন্তাভাবনা এবং দেশের মানুষের কল্যাণে তার যে পরিকল্পনা আছে সেগুলো আঁচ করতে পারতাম। আমরা সেই সময়ে জুনিয়র শিক্ষকরা একপাশে বসতাম, অন্যপাশে বসতেন প্রফেসর রাজ্জাক, ড. হুদা, ড. আনিসুজ্জামানের মতো শিক্ষক। তাদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা হতো। সেখানে মসিউরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং অর্থনীতিবিষয়ক আলোচনা ও পরিকল্পনাগুলো সব শিক্ষক তা পছন্দ করতেন। মসিউর যখন কথা বলত তখন সবাই মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনতেন। আমি মনে করি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনার দিক থেকে মসিউর অনেকের থেকে আলাদা ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময়ে মসিউর রহমান ১৯৬৫ সালে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে (সিএসপি) যোগদান করে। সিএসপি হলো বর্তমানে যাকে আমরা বিসিএস (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) বলি। মসিউর সেই সময়ে প্রশাসনে যোগদান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দেয়। এই সিএসপিতে মসিউর রহমান সমগ্র পাকিস্তানের মধ্যে পঞ্চম স্থান (সম্ভবত) অধিকার করেছিল। একজন মানুষ কী পরিমাণ মেধাবী হলে পূর্ব পাকিস্তানের মতো জায়গা থেকে সমগ্র পাকিস্তানের এ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় নিজেকে তুলে এনেছে! মসিউর সম্ভবত সেই সময়ের দুই পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিসে যারা যোগদান করেছিল তাদের মধ্যে প্রথমই হয়েছিল। এদিকে একাডেমিক ট্রেনিং শেষে যখন মসিউর সিএসপিতে যোগদান করে তখন সম্ভবত তার র্যাংক পাঁচ থেকে আরো কমে তিন বা চার হয়েছিল। মসিউরের পিতা এমএ জব্বার ব্রিটিশ আমলে খুলনা অঞ্চলের একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামলে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকরি করেছেন বিভিন্ন জায়গায়। তিন ভাই-বোনের মধ্যে মসিউর ছিল একমাত্র ছোট ভাই।