
বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজকে সুবিধা দিতে গিয়ে রফতানি পণ্য পরিবহনে জটিলতা দেখা দিয়েছে। ওয়েবার সনদপ্রাপ্তিতে বিদেশী পতাকাবাহী জাহাজগুলো ভোগান্তিতে পড়ছে, করা হচ্ছে জরিমানাও। এমন পরিস্থিতিতে দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকরা পণ্য রফতানিতে কালক্ষেপণ, ব্যয় বৃদ্ধি ও ক্রেতা অসন্তোষের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে গতকাল নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) স্ট্যান্ডিং কমিটি অব পোর্ট অ্যান্ড শিপিংয়ের পক্ষ থেকে পাঠানো চিঠিটিতে এ সংকটের প্রতিকার চাওয়া হয়েছে।
তৈরি পোশাক রফতানিকারকরা জানান, রফতানি পণ্যের শিডিউল মিস হলে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে থাকা বড় জাহাজ (মাদার ভেসেল) মিস হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। মাদার ভেসেল মিস করলে ইউরোপ-আমেরিকার গন্তব্যে সঠিক সময়ে পণ্য পৌঁছানো অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তখন রফতানি পণ্যের মূল্য পরিশোধ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়।
বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) আইন, ২০১৯ অনুসারে, জাহাজের মাধ্যমে পরিবহনকৃত মোট পণ্যের ৫০ ভাগ দেশের পতাকাবাহী জাহাজে বহন বাধ্যতামূলক। তবে অভ্যন্তরীণ জাহাজে জায়গা না থাকা সাপেক্ষে বাকি পণ্য বহনে বিদেশী শিপিং এজেন্টদের বাধ্যতামূলক ছাড়পত্র নিতে হয়।
বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) বিধিমালা-২০২৩ অনুসারে, বিদেশী জাহাজের মালিক বা তাদের প্রতিনিধিদের পণ্য লোড করার আগে বাধ্যতামূলক ওয়েবার সনদের জন্য নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তর অফিসে অনলাইনে আবেদন করতে হয় এবং চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগের আগে ছাড়পত্র নিতে হয়। কিন্তু সম্প্রতি এই সনদ সংগ্রহ নিয়ে জটিলতা তৈরি হওয়ায় এমভি এসওএল প্রমিজ এবং এমভি এক্সপ্রেস লোটসি নামের দুটি জাহাজকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
সাধারণত জরিমানা করা হলে ৩০ দিনের মধ্যে আপিলের নিয়ম আছে। তবে এ-সংক্রান্ত আইন সংশোধনে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়েছে।
বিজেএমইএ নেতারা বলছেন, যে জাহাজ দুটিকে জরিমানা করা হয়েছে সেগুলো চট্টগ্রাম-কলম্বো রুটে কনটেইনার পরিবহন করে। এভাবে জরিমানা করা হলে বিদেশী কার্গোবাহী জাহাজগুলোর বাংলাদেশে পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হবে। আমাদের পোশাক খাতেও এর প্রভাব পড়বে।
বিজিএমইএর ভাইস প্রেসিডেন্ট রকিবুল আলম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশে বিদেশী পতাকাবাহী কার্গো কম আসছে। তবে কিছুদিন আগে দুই বিদেশী পতাকাবাহী জাহাজকে প্রায় ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তর। এভাবে বিদেশী পতাকাবাহী জাহাজগুলোকে জরিমানা করা হলে আমাদের কার্গো সংকট আরো বাড়বে। কারণ জরিমানা করা হলে কনটেইনারবাহী কার্গোগুলো দেশে পণ্য পরিবহনে আগ্রহী হবে না। ফলে আমাদের তৈরি পোশাক খাতের রফতানি ব্যয় আরো বাড়বে।’
বিজিএমইএর পোর্ট অ্যান্ড শিপিং স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান হাসান আব্দুল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের যারা পণ্য রফতানি করে তাদের ৯১ শতাংশই বিদেশী জাহাজের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে বাংলাদেশের যেগুলো আছে সেগুলো মাত্র ৯ শতাংশ পর্যন্ত নিতে পারে। বাংলাদেশ থেকে যেসব পণ্য যায়, সেগুলো এখান থেকে সিঙ্গাপুর বা কলম্বো যায়। তারপর সেখান থেকে ইউরোপ, আমেরিকা বা যুক্তরাজ্যে যায়। জাহাজের যে ভাড়া তার তুলনায় অবশ্যই জাহাজের পণ্যের ভ্যালু (দাম) অনেক বেশি। দেশী কোম্পানিগুলোর জাহাজের ভাড়ার কথা চিন্তা করে যেটি করা হচ্ছে তাতে করে আমার রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের কোনো বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজ মালিকের কতটি জাহাজ, তার বিস্তারিত অবশ্যই আমরা (রফতানিকারকরা) বিবেচনা করি। তবে সেটার সুরক্ষায় আইনে বিদেশী জাহাজগুলোকে ৫ লাখ, ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হচ্ছে। ফলে বিদেশী জাহাজগুলো এখানে আসার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হচ্ছে।’
দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বন্দরে ওয়েবার সনদ জটিলতায় আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সনদ জটিলতার কারণে শিপিং কোম্পানি এবং অন্য স্টেকহোল্ডাররা প্রায়ই তাদের কার্গো না নিয়ে বন্দর ছাড়ছে বা বিলম্বের শিকার হচ্ছে এবং একই সঙ্গে গুনছে জরিমানা। ফলে ক্ষতির মুখে পড়ছেন পণ্য রফতানিকারকরা। ওয়েবার সার্টিফিকেটসংক্রান্ত জটিলতায় ১৪ অক্টোবর কলম্বোগামী একটি জাহাজের যাত্রার সময়সূচি একদিন পিছিয়ে যায়। ফলে জাহাজটি একদিন পর প্রায় ৪০০ কনটেইনার কম নিয়ে রওনা করে।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানি এক্স-প্রেস ফিডার এক বিবৃতিতে জানায়, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্য কার্গো পরিচালনার অনুমতি দেয় এবং ১২ অক্টোবর সকাল ৮টার পর রফতানি কার্গো লোডিং স্থগিত করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে (সিপিএ) অবহিত করে। "চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান সক্ষমতা বিবেচনায় বেঁধে দেয়া ২৪ ঘণ্টা সময়সীমার মধ্যে এ পরিমাণ কনটেইনার লোড ও আনলোড করার বাস্তবতা নেই। এই সময়ের মধ্যে জাহাজটিতে মাত্র ১১০ টিইইউএস রফতানি কার্গো লোড সম্ভব হয়েছিল। বাকি প্রায় ৬০০ টিইইউএস বাদ পড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।