
মূল্যস্ফীতিতে ভুগছে সাব-সাহারা আফ্রিকার ৪৬টি দেশের অর্থনীতি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এতটা বেড়েছে যে এসব দেশে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিবিদরা জানান, মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার দরপতন। খবর বিবিসি।
পাউন্ড, স্টার্লিং ও ডলারের মতো অন্যান্য বৈশ্বিক বাণিজ্য মুদ্রার বিপরীতে বেশির ভাগ সাব-সাহারা আফ্রিকান মুদ্রা দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলে স্থানীয় মুদ্রার মান ও ক্রয়ক্ষমতা দিন দিন কমছে।
বিশ্বব্যাংকের অক্টোবরে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, আফ্রিকার বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ নাইজেরিয়া ও অ্যাঙ্গোলার মুদ্রা মহাদেশের সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে। নাইরা ও কোয়ানজা ডলারের বিপরীতে প্রায় ৪০ শতাংশ মূল্য হারিয়েছে।
বিশ্বব্যাংক জানায়, বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা অপসারণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের ফলে নাইরার মূল্য হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে তেলের দাম কমা ও মোটা অংকের ঋণ পরিশোধের কারণে কোয়ানজার মূল্য বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।
প্রতিবেদনে অন্যান্য আফ্রিকান মুদ্রার মূল্যও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাসের চিত্র দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ সুদান (৩৩ শতাংশ), বুরুন্ডি (২৭ শতাংশ), গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো (১৮ শতাংশ), কেনিয়া (১৬ শতাংশ), জাম্বিয়া ও ঘানা (১২ শতাংশ) এবং রুয়ান্ডা (১১ শতাংশ)।
আফ্রিকার তামার রাজধানী জাম্বিয়ায় ভুট্টা, মাংস, মাছ ও জনপ্রিয় শুকনো কুমড়া পাতাসহ প্রধান খাবারের দাম গত পাঁচ মাসে ১৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে দাম দ্বিগুণ হয়েছে।
দেশটির পরিসংখ্যান সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, ২ কোটি জনসংখ্যার দেশে ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ দরিদ্র। কিছু পণ্যের দাম নাগালের বাইরে চলে গেছে। অনেক মানুষ প্রতিদিন ২ ডলারেরও কম ব্যয় করে বেঁচে আছে।
স্থানীয় মুদ্রার দরপতনের প্রধান কারণ হচ্ছে এ দেশগুলোয় বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে বিশাল ব্যবধান। একবার বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি হলে মানুষকে কালো বাজারের মতো বিকল্প উৎসের দিকে ঝুঁকতে হয়। কালো বাজারের ডলারের মূল্য সর্বদা সরকারি মূল্যের চেয়ে বেশি হয়। তখন এটা কেবল ধনী ব্যক্তি ও কোম্পানিগুলো আমদানি, কাঁচামাল, শিক্ষা, চিকিৎসা ও পর্যটনের জন্য ব্যবহার করতে পারে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে আমদানির ওপর বিশাল নির্ভরতা।
অনেক আফ্রিকান দেশ রফতানির চেয়ে অনেক বেশি তৈরি পণ্য আমদানি করে। পণ্যের মূল্য পরিশোধের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এভাবে স্থানীয় মুদ্রার ওপর নির্ভরতা হ্রাস পায়। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন ডলার বা চীনা ইয়েনের মতো বিদেশী মুদ্রার মূল্য বেড়ে যায়। বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন করতে পারেন না। আমদানিকারকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। অনেকের ব্যবসা তখন বন্ধ হয়ে যায়।
এ রকম একটি উদাহরণ হলো এমিরেটস এয়ারলাইনস। এ কোম্পানি নাইজেরিয়ায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যবসা স্থগিত করে রেখেছে। এমিরেটসকে টিকিট বিক্রয়ের ৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার ফেরত দিতে পারেনি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন জানায়, নাইজেরিয়া সরকারের কাছে উড়োজাহাজ কোম্পানিগুলোর পাওনা ৮১ কোটি ২০ লাখ ডলার আটকে আছে। এ সংখ্যা অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। এটা বিশ্বব্যাপী মোট পাওনার প্রায় অর্ধেক।
নাইজেরিয়া ও অ্যাঙ্গোলার মতো জ্বালানি তেল উৎপাদনকারী দেশে প্রচুর পরিমাণে অর্থ ও বৈদেশিক মুদ্রা থাকার কথা। যেহেতু এরা জ্বালানি তেল মার্কিন ডলারে বিক্রি করে। বাস্তবে এসব দেশের সরকার বিশাল ঋণ পরিশোধ ও পরিষেবা খাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নষ্ট করে ফেলেছে। অনেক দেশ স্থানীয় জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দামে প্রচুর ভর্তুকি দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে। ফলে এ দেশগুলো বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের ঊর্ধ্বগতি থেকে প্রকৃতপক্ষে উপকৃত হয় না।
মূল্যস্ফীতি হ্রাস করতে নাইজেরিয়া, ঘানা, কেনিয়া ও জাম্বিয়ার সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে সরকারগুলো আফ্রিকা মহাদেশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (আফসিএফটিএ) সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। এটা করতে পারলে পরস্পরের সঙ্গে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন করতে পারবে।