ঈদের একদিন আগে ছোট মামা পৌঁছলেন আমাদের বাসায়, সঙ্গে আলাউদ্দিনের মিষ্টি ও বিচিত্রা ঈদ সংখ্যা।
বয়স তখন কত?
বয়স যা-ই হোক বই উল্টে ছবি দেখতে পারি, বানান করে কিছু পড়তেও পারি। আলাউদ্দিনের মিষ্টির প্যাকেটটি ঠাকুরগাঁও বা দিনাজপুরের মিষ্টির দোকানের প্যাকেটের মতো নয়, আর ‘রিসাইকেল’ ব্যাপারটি মায়ের সহজাত, তো মিষ্টির প্যাকেটটি মায়ের টুকিটাকি জিনিস রাখার বাক্স হয়ে গেল, আর আমার মাঝে মাঝে নেড়ে দেখার, মানে নকশাটি দেখার। ঢাকা থেকে মামা এনেছে বলে, না নকশাটি ভিন্ন বলে প্যাকেটটার প্রতি এ আগ্রহ?
ওই যে বই-পত্রিকা উল্টে দেখতে পারি, বানান করে পড়তে পারি। তো এক ফাঁকে মামার আনা পত্রিকাটি উল্টে দেখতে গিয়ে দুই কি তিন পাতার ছবি-গল্প পড়তে শুরু করলাম, আলাউদ্দিনের মিষ্টির গল্প। সেখানেই রনবী নামটির সঙ্গে পরিচয়। পরিচয় টোকাইয়ের সঙ্গেও।
সেই বিচিত্রায়ই রফিকুন নবী নামের সঙ্গেও পরিচয়, গল্পের ফাঁকে ফাঁকে সাদা-কালো রেখায় আঁকা ছবিগুলো যতই দেখি ততই মুগ্ধ হই।
আরেকটু বড় হলে, বাসার বইগুলো পড়ার অধিকার জন্মালে ‘নওফেল ও হাতেম’ বইটিতে রফিকুন নবীকে আরেকবার আবিষ্কার করা গেল, এর ক’দিন পরই ‘এক যে ছিল নেংটি’ বইয়ের রফিকুন নবী আমার অন্যতম পছন্দ হয়ে উঠল।
আমি ঠিক নিশ্চিত নই কিশোর বাংলার আফজাল হোসেন, না বন্দে আলী মিয়ার বর্ণ পরিচয়ের হাশেম খান, না বিচিত্রার রফিকুন নবী আমাকে বেশি মুগ্ধ করেছিল!
তবে নির্মলেন্দু গুণের ‘কালো মেঘের ভেলা’র রফিকুন নবী, আবদুল্লাহ আল-মুতীর ‘সাগরের রহস্যপুরী’র রফিকুন নবীকে আমি বৈশ্বিক বিচারেই অনন্য বলে ঘোষণা দিতে চাই।
বই ও পত্রিকার পাতার বাইরে রফিকুন নবীকে প্রথম দেখি এ কৈশোর ছুঁই ছুঁই শৈশবেই বাসার দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারে। ছয় পাতার ক্যালেন্ডারে ছয়টি ছবি, জলরঙে আঁকা বাংলাদেশের ছবি। এ ছবিগুলোর অনন্যতা নিয়ে আসলে দীর্ঘ আলোচনা দরকার।
সম্ভবত এর কিছুদিন পর আরেকটি ক্যালেন্ডারের পাতায়ই Fine Artist রফিকুন নবীর সঙ্গে পরিচয়, প্যাস্টেল ও কাঠ খোদাই মাধ্যমের ছয়টি ছবির অনুলিপি। কাঠ খোদাইয়ে করা ‘কবি’ নামের একটি ছবি এতটাই ভালো লেগে গেল যে বারবার দেখি পৃষ্ঠা উল্টে।
এরও কিছু পরে হাতে পেলাম এক দুর্দান্ত জিনিস। শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত রফিকুন নবীর একক প্রদর্শনীর প্রকাশনা। জলরঙে আঁকা বড়কাটরা, ফেরি নৌকা, কাঠ খোদাই, ছাপাই, ছবি ছাপাই ২, একা, দুই নারী, সমুদ্রসৈকত আমাকে অন্য এক জগতের সন্ধান দিয়েছে সেই ১৩-১৪ বছর বয়সে।
এর ঠিক এক বছর পরে স্কুলের ১০০ বর্ষের অনুষ্ঠানে রশীদুন নবী নামের এক প্রাক্তন ছাত্রের ছোট ছোট ভাস্কর্য দেখে মুগ্ধ। কে এই রশীদুন নবী? স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র, পুলিশ কর্মকর্তা ও রনবীর পিতা। রনবীর পিতা শোনার পর সবার এ ভাস্কর্য দেখার আগ্রহ জানান দিল ‘টোকাই’ ও ‘রনবী’ সাধারণের কাছে কী!
চারুকলার ভর্তি পরীক্ষায় ভাইভা বোর্ডে টেবিলের অপর পারে যে তিনজন তার একজন রফিকুন নবী, বিচিত্রায় প্রকাশিত তার সাক্ষাৎকারের সুবাদে, আনন্দ বিচিত্রায় তারই আঁকা তার কার্টুনের সুবাদে তার চেহারা চিনি। সেদিন আবিষ্কার করা গেল সেলিব্রিটির সামনে ভক্তের কী অবস্থা হয়। কী প্রশ্ন করা হয়েছিল আর কী উত্তর দিয়েছিলাম মনে নেই, তবে এটা মনে আছে আমি আমাতে ছিলাম না। সম্ভবত তাতেই সে বছর আর চারুকলার ছাত্র হওয়া হয়নি।
আরেকটি ঘটনা মনে পড়ছে। ’৮৭ ব্যাচের এক ছাত্র আত্মহত্যা করল, সে নিয়ে উত্তাল চারুচত্বর, তখন স্বৈরশাসনের কাল, সমস্যা সমাধানে ‘খুঁজে বের করো কালপ্রিটদের, তারপর তাদের বহিষ্কার করো’ নীতিতে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়। মুখোমুখি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও ছাত্ররা, পরিচালকের কক্ষের সামনের বারান্দায় চলছে বচসা, আমি দাঁড়িয়ে রেলিং ধরে, দর্শক হিসেবে সহপাঠীদের লড়াই দেখছি, দর্শকসারিতে কিছু দূরে রফিকুন নবী ও আরো ক’জন চারুকলার শিক্ষক। কর্তৃপক্ষ সম্ভবত কিছু একটা বলেছে, যা আমার পছন্দ হয়নি, দর্শকাসন থেকে চিৎকার করে সৈনিক-খেলোয়াড় হতে ছুট লাগালাম, কিন্তু গলায় টান পড়তে থেমে যেতে হলো, কলার ধরে কেউ পেছনে টানছে, কানের কাছে কারো কণ্ঠ বেজে উঠল—এ তুমি কী করছ? তুমি শিল্পী হবে, বহিষ্কারের তালিকায় পড়লে শিল্পী হবে কী করে?
আমার সেদিন ফ্রন্টের সৈনিক হওয়া হয়নি, তবে তবে আমি সেদিন ‘জেনারেল’ হয়ে গেলাম, ক’জন মিলে পুরো লড়াইয়ের স্ট্র্যাটেজি প্ল্যান তৈরি করলাম অল্প সময়ে।
এই যে ছাত্রদের বুঝতে পারা এবং ছাত্রদের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্যটি পৌঁছে দেয়া, এটাই রনবী। শুনেছি এবং পরে নিজে দেখেছি আরো তার এ আচরণ। একজন মানুষ দোষে ও গুণে মিলেই, তাকে নিয়ে তাই আমার অসংখ্য অভিযোগও আছে, সেটা ব্যক্তি রফিকুন নবীকে নিয়ে, শিল্পী রফিকুন নবীকে নিয়েও।
আমি প্রায় ৪৫ বছরের অধিককাল ধরে শিল্পী রফিকুন নবীকে অনুসরণ করছি। এ অনুসরণের পরিপ্রেক্ষিতেই বলতে পারি তিনি বাংলাদেশের, উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীদের একজন। হয়তো তার মনোযোগ Fine Art-এর চেয়ে ইলাস্ট্রেশন, ক্যালেন্ডার আর্ট, ব্যঙ্গচিত্রেই বেশি, তারপরও তার Fine Art-এর কাজগুলো দেশের ও উপমহাদেশের সেরাদের তালিকায়ই আছে।
বিষয়, রঙ ব্যবহার, অংকন তথা সার্বিক বিন্যাসে রফিকুন নবীর চিত্রকর্ম পশ্চিম ইউরোপের চিত্রকলার উত্তরসূরি হয়েও ইউরোপীয় নয়, আবার বাংলার লোক বলতে আমরা যা বুঝি তাও নয়, এমনকি পূর্ব ইউরোপেরও নয়। কাইয়ুম চৌধুরী ও তার ছবি আলোচনা করতে গেলে আসলে নতুন এক নন্দন ভাষা তৈরি জরুরি, কিউবিজম আলোচনা করতে যেমন ইউরোপকে নতুন নন্দন ভাষা আবিষ্কার করতে হয়েছিল, অবন ঠাকুরের ‘প্রাচ্যকলা’, রবীন্দ্র চিত্রকলা আলোচনা করতে যেমন নতুন নন্দন ভাবনা প্রয়োজন পড়ে, তেমন।
ক্যালেন্ডার আর্টে তার জলরঙ বাংলার যে রূপ তুলে ধরে, তা চিত্রকলার ছাত্রদের জন্য অবশ্য শিক্ষণীয় বলেই আমি মনে করি।
বাংলাদেশের পত্রিকা ও প্রকাশনায় উপন্যাসের তথা গদ্যের চিত্রায়ণে তার মতো শক্তিমান দ্বিতীয়টি নেই, জয়নুল ও কাইয়ুম চৌধুরীর কথা মাথায় রেখেই বলছি। দৈনিক পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার প্রচ্ছদে রফিকুন নবীর অনন্যতা শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক আলোচনাতেই অনন্য।
ও হ্যাঁ, একটি প্রশ্ন আসলে করাই হয়নি, তবে প্রশ্নটি ছিল যে মনে মনে তা আজ এ লেখা লিখতে বসে টের পেলাম—আলাউদ্দিনের মিষ্টির প্যাকেটের নকশা কি রফিকুন নবীর করা?
হলে বলব ব্র্যান্ডিংয়ে রফিকুন নবীর প্রতিভার কোনো ব্যবহারই হয়নি, হলে বাংলাদেশের ‘ব্র্যান্ডিং’-এর চেহারা অন্য রকম হতো।
তার ৮০তম জন্মদিনের অগ্রিম শুভেচ্ছা।
নাজিব তারেক: দৃশ্যশিল্পী ও লেখক