‘রেনেসাঁ’ শব্দটির সঙ্গে আমরা সবাই কম-বেশি পরিচিত। পাশ্চাত্যের সমাজ-সংস্কৃতি, সাহিত্য, অর্থনীতি, দর্শন, বিজ্ঞানের মতো শিল্পকলার নবজাগরণ রচিত হয়েছে ইতালির ফ্লোরেন্সকে ঘিরে। তাই ফ্লোরেন্সকে ঐতিহাসিকরা বলেছেন ‘মধ্যযুগের এথেন্স’। ফ্লোরেন্সের পথে-প্রান্তরে, মিউজিয়ামে, গ্যালারিতে সেই ঐতিহাসিক সময়ের নিদর্শন যেন কালের সাক্ষী। তেমনি একটি বিখ্যাত গ্যালারি উফিজি। উফিজি গ্যালারিতে রয়েছে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেল এঞ্জেলো, রাফায়েলের মতো বিখ্যাত শিল্পীদের শিল্পকর্ম, যা নিঃসন্দেহে দর্শককে বিমোহিত করে। তবে বিমোহিত হওয়ার সময় যে চিন্তায় ভ্রু কুঁচকে আসে তা হলো উফিজি গ্যালারির বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলোর শিল্পী কেউই নারী নন। ফ্লোরেন্সের অন্যান্য মিউজিয়াম ও গ্যালারিতে নারী শিল্পীদের শিল্পকর্ম তেমন একটা চোখে পড়ে না। তাহলে কি রেনেসাঁর সময়ে উল্লেখযোগ্য কোনো নারী শিল্পী ছিলেন না? নাকি নারী শিল্পীরা নিজেদের সৃষ্টিকর্মসহ ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে গেছেন?
এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে ২০০৯ সালে অ্যাডভান্সিং উইমেন আর্টিস্ট (এডব্লিউএ) নামক একটি নন প্রফিট সংগঠন অনুসন্ধান শুরু করে। সংগঠনটির পরিচালক লিন্ডা ফেলকন এ বিষয়ে বলেন, ‘আমি নারী শিল্পীদের কোনো শিল্পকর্ম আছে কিনা তা দেখার জন্য মিউজিয়ামের স্টোরেজ ও ছাদের ঘরগুলোয় খুঁজতে শুরু করলাম। তবে অবাক করার মতো বিষয়, রেনেসাঁ যুগের নারী শিল্পী এবং তাদের শিল্পকর্ম নিয়ে এতদিন কেউ তেমন একটা জানতেই চায়নি।’ যা হোক সংগঠনটির আন্তরিক চেষ্টায় ইতালির পাবলিক মিউজিয়াম এবং চার্চের স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার স্টোরেজ থেকে পাওয়া যায় নারী শিল্পীদের আঁকা দুই হাজারের মতো শিল্পকর্ম, যার মধ্য থেকে ৭০টি শিল্পকর্ম সংরক্ষণের জন্য এডব্লিউএ কাজ শুরু করে। শিল্পকর্মগুলোর অধিকাংশই ১৬ থেকে ২০ শতকে আঁকা।
রেনেসাঁর নারী শিল্পীরা সময়ের মঙ্গে ইতিহাসের মধ্যে এতটাই বিস্মৃত যে ১৯১৭ সালে উফিজি গ্যালারিতে যখন রেনেসার বিখ্যাত নারী শিল্পী প্লাতিলা নেলির প্রথম একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী হয় তখন জনসাধারণের মতো শিল্প-ঐতিহাসিকরাও বিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিলেন, প্লাতিলা নেলি কে?
ষোড়শ শতাব্দীতে ফ্লোরেন্সের একজন বিখ্যাত শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও নেলি কীভাবে, কী কারণে ইতিহাসে হারিয়ে গেলেন? শিল্প-সমালোচক ও ঐতিহাসিকরা কেন কিছু জানেন না? আসলেই বিস্মিত করে। তবে কি লিঙ্গ বৈষম্যের কারণেই নারী শিল্পীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। এ বিষয়ে ফেলকনি বলেন, ‘রেনেসাঁ সময়ে নারীদের কোনো নাগরিকত্ব ছিল না। তাই নারীরা নিজ থেকে কোনো মূল্যতালিকা বা রসিদ চালান করতে পারতেন না। আবার পেশা হিসেবে নারীদের শিল্পচর্চার সুযোগও ছিল না। তাছাড়া নারীদের শিল্পচর্চায় নুড স্টাডি ছিল নিষিদ্ধ।’
বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে নারীবাদী সংগঠন গেরিলা গার্লস শিল্পচর্চায় বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, ‘শিল্পের গণ্ডি সবসময়ই পুরুষ শাসিত।’ ইন্টারসেকশনাল নারীবাদী এ সংগঠন তাদের বক্তব্যের সমর্থনে সামাজিক বৈষম্যকে তুলে ধরতে বেশকিছু পোস্টার প্রকাশ করে। তাদের মতে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের শিল্পকর্ম প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ ও গবেষণার অভাবে ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
রেনেসাঁয় শিল্পচর্চা শুধু স্টুডিওভিত্তিক ছিল না। প্রচীন গ্রন্থের বর্ণনা, দর্শন, শরীরসংস্থান বিদ্যা, গণিতবিদ্যাসহ নানামুখী জ্ঞানকে নিয়ে সংগঠিত হয়েছে রেনেসাঁর অগ্রযাত্রা। তবে শিল্পকলাসহ অন্যান্য জ্ঞানচর্চায় নারীদের তেমন কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি। নারীরা ততটুকু শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পেতেন যতটুকু হলে একজন মা ও স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা যায়।
এত বাধা সত্ত্বেও রেনেসাঁয় বেশকিছু নারী নিজেদের শিল্পী হিসেবে প্রমাণ করেন। সে সময় ধর্মীয় উপাসনালয় ও মঠকে কেন্দ্র করে একপ্রকার শিল্পচর্চা বিকশতি হয়, যা নান শিল্প নামে পরিচিত। এ নান শিল্পচর্চায় শিল্পী প্লাতিলা নেলি ফ্লোরেন্টাইনদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এ সময়ে ফ্লোরেন্সের সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর বেশ কয়েকজন নারী অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হন এবং শিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন, যাদের মধ্যে সোফানিস্বা অ্যাঙ্গুইসোলা, লুসিয়া অ্যাঙ্গুইসোলা উল্লেখযোগ্য। আবার কয়েকজন নারী তাদের বাবা শিল্পী হওয়ার কারণে স্টুডিওতে শিল্পচর্চার সুযোগ পান, যাদের শিল্পকর্ম সে সময় বেশ প্রশংসিত হয়। এদের মধ্যে শিল্পী ওরাজিও জেন্টিলেশির কন্যা আর্তেমিসিয়া জেন্টিলেশি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া রয়েছেন লেভিনা টেরলিংক, ক্যাটরিনা ভ্যান হেমসেন, এলিসাবেতা সিরানি, লাভিনিয়া ফন্টানা প্রমুখ। সে সময়ও টিকে থাকার জন্য নারীকে তার ওপর চাপিয়ে দেয়া সব সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে নিতে হয়েছে বিনাবাক্যে। এর ব্যতিক্রম ঘটলেই ধ্বংস হয়েছে নারীদের শিল্পচর্চার সুযোগ, যার উদাহরণ নারী ভাস্কর প্রোপজিয়া দে’রোসি।
রেনেসাঁর পর শিল্পকলার ইতিহাস নিয়ে একাডেমিক আলোচনার শুরুটা হয় আঠারো ও উনিশ শতকে। তখন শিল্প-সমালোচক ও ঐতিহাসিকরা শিল্পীদের নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে পুরুষ শিল্পীদেরই খুঁজে নিয়েছেন। যে কারণে গ্যালারি, মিউজিয়াম, শিল্পকলার বই ও গবেষণায় পুরুষ শিল্পীরাই প্রাধান্য পেয়েছেন। নারীদের শিল্পচর্চাকে দেখা হয়েছে সমাজের প্রচলিত ধারার ব্যতিক্রম হিসেবে। নারী শিল্পীদের নিয়ে কোথাও তেমন একটা আলোচনা না হওয়ায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা হারিয়ে যেতে থাকেন। আর নারী শিল্পীদের মানসম্মত শিল্পকর্মগুলো প্রদর্শনের পরিবর্তে জায়গা পায় মিউজিয়াম ও গির্জার স্টোরেজে। অনেক শিল্পকর্ম স্টোরেজের স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হয়ে গেছে।
অতীতকে পরিবর্তন করা যায় না। কিন্তু বর্তমানে লিঙ্গ বৈষম্যের প্রশ্নে রেনেসাঁর নারী শিল্পীদের নিয়ে পুনরায় আলোচনার শুরু হয়েছে। সে আলোচনায় প্রথমেই আসে রেনেসাঁর বিখ্যাত নারী শিল্পী প্লাতিলা নেলি । তার সবচেয়ে আলোচিত শিল্পকর্মটির নাম ‘সিস্টার ক্যাথরিন উইথ লিলি’। বিশিষ্ট শিল্পী, ঐতিহাসিক জর্জিও ভাসারির বর্ণনা থেকে জানা যায়, রেনেসাঁয় অভিজাত সমাজে প্লাতিলা নেলির শিল্পকর্মের বেশ চাহিদা ছিল। প্লাতিলা নেলির শিল্পকর্ম এত বেশি সংগৃহীত হয়েছে যে সে সম্পর্কে আলোচনা বেশ ক্লান্তিকর। তবে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক নানা প্রতিকূলতার মাঝেও প্লাতিলা নেলি কীভাবে নান শিল্প আয়ত্ত করলেন । যতটুকু জানা যায়, ১৪ বছর বয়সে প্লাতিলা নেলিকে তার পরিবার খ্রিস্টান চার্চে পাঠিয়ে দেয়। কারণ সামাজিকভাবে মেয়েকে চার্চে পাঠিয়ে দেয়া বিয়ের খরচের চেয়ে সাশ্রয়ী। সান্তা ক্যাটারিনা দ্য সিয়ানা চার্চের পরিবেশ নেলিকে ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহী করে তোলে। ধর্মীয় পরিবেশে নান শিল্পের চর্চা তার জন্য উপাসনা না হয়ে ছবি আঁকার সুযোগ হয়ে ওঠে।
ঐতিহাসিক ভাসারি ১৫৫০ সালে ‘লাইভস অব দি আর্টিস্ট’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। যেখানে সে সময়কার ১০০ শিল্পীকে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে আলোচিত চারজন নারী শিল্পীর মধ্যে প্লাতিলা নেলি অন্যতম। ভাসারি শিল্পী প্লাতিলা নেলিকে নিয়ে বলতে গিয়ে ‘নান অ্যান্ড নাউ প্রিয়োরেস’ বলে আখ্যায়িত করেন। বইয়ের বর্ণনায় জানা যায়, নেলি তার ছবি আঁকার শুরুটা করেন বিখ্যাত চিত্রকরদের ড্রইং ও পেইন্টিং অনুকরণের মাধ্যমে। ভাসারির মতে, প্লাতিলা নেলি যদি গণিত ও অঙ্গসংস্থানবিদ্যায় শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পেতেন তবে তার খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু দুঃখের বিষয় ধর্মীয় উপাসনালয়ে থাকা নারীদের জন্য গণিত ও অঙ্গসংস্থানবিষয়ক শিক্ষা ছিল নিষিদ্ধ।
এত সমস্যার মধ্যেও নেলি গির্জা ও বিভিন্ন ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য বড় আকারের কিছু ধর্মীয় চিত্রকর্ম ও পাণ্ডুলিপির অলংকরণ করেন, যার মধ্য থেকে মোটামুটি ১২টি বড় আকারের চিত্রকর্ম সম্পর্কে আমরা এখন জানাতে পারি। চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে ২১ ফুট দৈর্ঘ্য ও সাড়ে ছয় ফুট প্রস্থের বিশাল আকৃতির ‘লাস্ট সাপার’ চিত্রটিও রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে এ লাস্ট সাপার চিত্রকর্ম প্রথম কোনো নারীর আঁকা। কিন্তু রেনেসাঁ-পরবর্তী সময়ে প্লাতিলা নেলির কথা সবাই ভুলেই গিয়েছিল। তবে বর্তমানে শিল্পকর্মটি এডব্লিউএ রেস্টোরেশন করেছে। শিল্পকর্মটি ফ্লোরেন্সের সান্তা মারিয়া নোভিলা মিউজিয়ামে সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত হচ্ছে।
প্লাতিলা নেলির করা ‘লাস্ট সাপার’ নিয়ে এডব্লিউএর লিন্ডা ফেলকন বলেন, ‘ফ্লোরেন্সের শিল্পীদের কাছে লাস্ট সাপারের ছবি আঁকা রীতিমতো ঐতিহ্যের মতো। আর প্লাতিলা নেলির আঁকা ‘লাস্ট সাপার’ শিল্পকর্মটিও বেশ উচ্চমানের। যিশু যখন তার বিশ্বাসঘাতক অনুসারীর নাম বলবেন ঠিক সেই মুহূর্তের আবেগ চিত্রটিতে অনুভব করা যায়। যেহেতু নেলি এমন এক মুর্হূত সুনিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন, সেহেতু ধরেই নেয়া যায়, তার মানুষের প্রতিক্রিয়া বোঝার এবং মনস্তাত্ত্বিক আচরণ চিত্রিত করার ক্ষমতা ছিল।’ লিন্ডা আরো বলেন, ‘চিত্রটিতে অন্যান্য পুরুষ শিল্পীর তুলনায় ব্যতিক্রমভাবে খাবারের ছবি আঁকা হয়েছে। খাবার টেবিলে লেটুস, লবনের চিমনি, ওয়াইনের সারি, শিমের বীজ, রুটি থেকে শুরু করে ছুরি-কাঁটাচামচ প্রভৃতি দেখা যায়। সাধারণভাবে খাবারের টেবিলে যে পরিবেশ থাকে তাকেই যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেলি আঁকতে চেয়েছেন। আর এই সমস্ত সারল্যের জন্যই চিত্রটি অন্য সব “লাস্ট সাপার” থেকে ভিন্ন।’
প্লাতিলা নেলির পর যে নারী শিল্পীর কথা না বললেই নয় তিনি হলেন সোফানিস্বা অ্যাঙ্গুইসোলা, যার জন্ম উত্তর ইতালির ক্রিমোনা অঞ্চলের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। শিল্পী সোফানিস্বা আত্মপ্রতিকৃতি ও পারিবারিক ছবি আঁকার জন্য বেশ সুপরিচিত ছিলেন। রেনেসাঁ সময়ে নারীদের কোনো শিল্পীর অধীনে থেকে স্টুডিওতে অনুশীলনের সুযোগ ছিল না। এক্ষেত্রে সোফানিস্বা বেশ সৌভাগ্যবতী। কারণ সোফানিস্বাকে তার বাবা শিল্পচর্চায় সহযোগিতা করেন। সোফাসিস্বা শিল্পী বার্নাডিনো ক্যাম্পি ও বার্নাডিনো গাট্টির কাছে প্রাথমিকভাবে চিত্রকলা ও নকশা করা শেখেন।
সোফানিস্বা আঙ্গুইসোলার চিত্রকলাশিক্ষা সম্পর্কে আরো জানতে গিয়ে ৭ মে ১৫৫৭-এর একটি চিঠির কথা বলা প্রয়োজন, যা পাওয়া গিয়েছিল ফ্লোরেন্সের মাইকেল এঞ্জেলো বুওনারোতি আর্কাইভ থেকে। চিঠিটির একটি অংশে সোফানিস্বার বাবা মাইকেল এঞ্জেলোর প্রতি লিখেছেন, ‘আপনি আমার কন্যা সোফানিস্বাকে শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে চিত্রকলা অনুশীলনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে যে শ্রদ্ধাজনক ও চিন্তাশীল স্নেহ প্রকাশ করেছেন তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।’ এ থেকে বোঝা যায় সোফানিস্বা রেনেসাঁ সময়ের কিংবদন্তি শিল্পী মাইকেল এঞ্জেলোর কাছে শিল্পশিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন। সোফানিস্বার সহজাত প্রতিভা, দূরদর্শী চিন্তাধারা ও শৈল্পিক দক্ষতার কারণে স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের কোর্টে প্রথম কোনো নারী শিল্পী হিসেবে যোগদানের সুযোগ পান। সে সময় কোর্টে সবচেয়ে ভালো মানের শিল্পীদের নিয়োগ দেয়া হতো। তবে বিভিন্ন সময়ে সোফানিস্বার অনেক শিল্পকর্ম ভুলবশত বিভিন্ন পুরুষ শিল্পীদের নামে পরিচিতি পেয়েছে। যেমন ১৫৬৫ সালে সোফানিস্বার আঁকা রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের একটি প্রতিকৃতির কথা বলা যেতে পারে। প্রতিকৃতিটি কোর্ট শিল্পী জুয়ান পেন্টোজা দেলা ক্রুজের আঁকা বলেই সবাই জানত। তবে ১৯৯০ সালে প্রতিকৃতিটি যে শিল্পী সোফানিস্বা অ্যাঙ্গুইসোলার আঁকা তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়।
সোফানিস্বাই রেনেসাঁ সময়ের প্রথম শিল্পী যিনি আত্মপ্রতিকৃতিকে শিল্পচর্চার বিষয় হিসেবে বেছে নেন। সে সময়ে তার আঁকা ১২টির মতো আত্মপ্রতিকৃতি সম্পর্কে বর্তমানে জানা যায়। পরবর্তী শতকে আরো অনেক শিল্পী আত্মপ্রতিকৃতি নিয়ে কাজ করেছেন। যেমন ষোলো শতকে ডাচ শিল্পী রেমব্রান্টকে আত্মপ্রতিকৃতি নিয়ে প্রচুর ছবি আঁকতে দেখা যায়।
সোফানিস্বা তার জীবদ্দশায় বিখ্যাত হয়েছিলেন। তার পরও অজানা কারণে শিল্পের ইতিহাসে তাকে নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। তবে নারীবাদী আন্দোলনের কারণে ১৯৭০ সালে এ শিল্পীকে নিয়ে পুনরায় আলোচনা শুরু হয়। বর্তমানে সোফানিস্বা অ্যাঙ্গুইসোলা প্রাক-মডার্ন সময়ের শিল্পী হিসেবে আলোচিত হন।
রেনেসাঁয় মিনিয়েচার চিত্রের জন্য যে নারী শিল্পী বেশ পরিচিতি পেয়েছিলেন তিনি হলেন শিল্পী লেভিনা টেরিলিংক। বেলজিয়ামের ব্রুজেসে জন্মগ্রহণকারী এ শিল্পী প্রায় ৩০ বছর ধরে ইংল্যান্ডের টিউডর কোর্টে শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। সে সময় কোর্টে টেরিলিংক ছিলেন সর্বোচ্চ বেতনভুক্ত শিল্পী। বর্তমানে এ বিখ্যাত শিল্পীর মাত্র পাঁচ-ছয়টি চিত্র সর্ম্পকে আমরা জানতে পারি। যার সবই বেশ উন্নত মানের মিনিয়েচার প্রতিকৃতি আর প্রতিকৃতিগুলোর আকার চার থেকে ছয় সেন্টিমিটার। রেনেসাঁয় উপহার কিংবা সংগ্রহের বস্তু হিসেবে মিনিয়েচার প্রতিকৃতির বেশ প্রচলন ছিল। অনেক সময় যা অলংকার কিংবা কানের দুল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। ফটোগ্রাফি আবিষ্কারের আগে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা ঘনিষ্ঠজনদের মিনিয়েচার প্রতিকৃতি উপহার দিতেন। মিনিয়েচার প্রতিকৃতি উপহার দেয়া সে সময়ে বেশ মর্যাদাপূর্ণ বিষয় ছিল। এ কারণে টিউডরের কোর্টের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের চেয়েও সমাজের বিত্তশালীরা বেশি প্রতিকৃতি আঁকিয়েছিলেন। যে কয়েকটি মিনিয়েচার টেরিলিংকের আঁকা বলে জানতে পারা যায় তার মধ্যে লেডি ক্যাথরিন গ্রের প্রতিকৃতিটি বেশ বিখ্যাত।
টেরিলিংক তার সমসাময়িকদের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ মিনিয়েচার ও পুস্তক অলংকরণ শিল্পী ছিলেন। আর এ দক্ষতা অর্জনে সহযোগিতা করেছেন তার পিতা ফ্লেমিশ চিত্রশিল্পী সাইমন বেনিং। বাবার স্টুডিওতেই টেরিলিংকের চিত্রকলাচর্চার সূচনা। লেভিনা টেরিলিংক ইংল্যান্ডের অষ্টম হেনরির কোর্টে ১৫৪৬ সালে ‘রয়েল পেইন্ট্রিক্স’ হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ এডওয়ার্ড, প্রথম মেরি ও প্রথম এলিজাবেথের শাসনকালেও একই পদে কাজ করেছেন। টেরিলিংকের কাজের বিষয় যে শুধু রয়্যাল পরিবারের প্রতিকৃতি তা কিন্তু নয়। কোর্টের নথিবদ্ধ তালিকা থেকে তার আরো অন্যান্য শিল্পকর্ম সম্পর্কে জানা যায়।
এডব্লিউএর শিল্পকর্ম পুনরুদ্ধারের কারণে আরেকজন নারী শিল্পী বর্তমানে বেশ আলোচনায় এসেছেন, তিনি হলেন ভিওলান্তে ফেরোনি। ভিওলান্তের জন্ম ১৭২০ সালে। সে সময় ইতালিতে মেদিচি যুগ প্রায় শেষের দিকে এবং ফ্লোরেন্সে ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তন দেখা যায়। এ সময়টা নারীদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এডব্লিউএর স্বেচ্ছাসেবী লেখক ও গবেষক অ্যান গোলবের মতে, সতেরো শতকের মধ্যবর্তী সময়ে নারীরা আগের চেয়ে বেশ এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং স্বল্প পরিসরে নিজেদের মেধা ও কাজের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করছিল। এ সময়ে শিল্পী ফেরোনি তার প্রতিভার কারণে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ফ্লোরেন্সের একাডেমিয়া দেলা আর্টি দেল ডেসেজনোতে (একাডেমি অব দি আর্টস অব ড্রইং) শিল্প শিক্ষার সুযোগ পান। এর কয়েক বছর পর ১৯৪০ সালে সান জিওভান্নি ডি ডিও হাসপাতালের আর্টিয়ামে সাড়ে ১১ ফুট দৈর্ঘ্য ও আট ফুট প্রস্থের ওভাল আকৃতির দুটি চিত্র আঁকেন। চিত্র দুটির শিরোনাম যথাক্রমে ‘The Saint Heals Plague Victims’ ও ‘Saint Jhon of God gives bread to the poor’। চিত্রের পূর্ণাঙ্গ ফিগারের আধ্যাত্মিকতা ও ঐতিহাসিকতা হাসপাতালে আসা রোগীদের মানসিকভাবে সাহস জোগায়।
শিল্পী মাইকেল এঞ্জেলো, লিওনার্দো, রাফায়েল প্রমুখ নিসন্দেহে রেনেসাঁ সময়ের অন্যতম কিংবদন্তি। কিন্তু রেনেসাঁর শিল্পকলাকে গভীরভাবে জানতে শিল্পী প্লাতিলা নেলি, সোফানিস্বা অ্যাঙ্গুইসোলা, লেভিনা টেরিলিংক, ভিওলান্তে ফেরোনি, প্রোপজিয়া দে’রোসি, আর্তেমিসিয়া জেন্টিলেশিদের মতো বিস্মৃত শিল্পীদের সম্পর্কেও জানা প্রয়োজন। যদিও নারী শিল্পীদের অধিকাংশ শিল্পকর্ম মিউজিয়াম, গ্যালারি ও চার্চের অবহেলায় হারিয়ে গেছে। ঐতিহাসিকরাও নারী শিল্পীদের নিয়ে তেমন একটা অলোচনা করেননি। তবে বর্তমানে রেনেসাঁর নারী শিল্পীদের শিল্পকর্ম পুনরুদ্ধারের যে চেষ্টা তা শিল্পপ্রেমীদের মনে নতুন আগ্রহ সৃষ্টি করছে।
সজীব সেন: দৃশ্যশিল্পী ও লেখক