যশোরে কমেছে বৃষ্টিপাত আমন চাষে ব্যয় বেড়েছে

আব্দুল কাদের, যশোর

যশোরে চলতি বছর বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে আমন ধান উৎপাদনে। আশ্বিন মাসে কিছু বৃষ্টির দেখা পাওয়া গেলেও তার আগেই সেচ দিয়ে আমন খেত প্রস্তুত করতে হয়েছে কৃষককে। এরই মধ্যে ডিজেল ও সারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে আরেক দফা। জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে সেচ দেয়া, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি সব ক্ষেত্রেই বাড়তি খরচের বোঝা টানতে হচ্ছে কৃষককে।

আমন আবাদ বৃষ্টিনির্ভর হলেও চলতি বছর (সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) যশোরে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে মাত্র ৪৬৬ মিলিমিটার। মে মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা ৮০ মিলিমিটার; যেখানে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৭ দশমিক ৩ মিলিমিটার। জুনে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা ৪৫০ মিলিমিটারের ওপরে। কিন্তু জুনের ২১ দিনে ১৬ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সাধারণত জুলাইয়ে বৃষ্টিপাত বেশি হয়। কিন্তু গত পাঁচ বছরে জুলাইয়ে ৪৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ৩০০ মিলিমিটারের মতো। এছাড়া গত পাঁচ বছরের ধারাবাহিকতায় আগস্টে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা ৩৭০ মিলিমিটার; হয়েছে ২৫০ মিলিমিটার। বছরে কাঙ্ক্ষিত গড় বৃষ্টিপাত ১১০০-১২০০ মিলিমিটার ধরা হলেও ২০২২ সালে যশোরে বৃষ্টি হয়েছিল ৬৯৮ দশমিক ৫৭ মিলিমিটার। ২০২১ সালে ১ হাজার ৬২ দশমিক ৫৭ মিলিমিটার, ২০২০ সালে ১ হাজার ৬৯ দশমিক ৬১ মিলিমিটার এবং ২০১৯ সালে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৯৪০ দশমিক ৯৬ মিলিমিটার।

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বল্লা গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলাম জানান, তিনি এবার চার বিঘা জমিতে রোপা আমন আবাদ করেছেন। বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় প্রথমে বিঘাপ্রতি সেচ দিতে হয়েছিল প্রায় ২ হাজার টাকার। তবে এখন বৃষ্টি হওয়ায় ফসলের রঙ ভালো হচ্ছে।

জুলাইয়ের শুরু থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত ধরা হয় আমন মৌসুম। আমন ধানের চারা রোপণের সময়কাল মধ্য জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। জমি প্রস্তুত করার সময় টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সার দিতে হয়। চারা রোপণের পর জুলাই ও আগস্টে ইউরিয়া ব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশি। তবে কেজিপ্রতি ৬ টাকা মূল্য বৃদ্ধির ফলে কেবল ইউরিয়া সারেই ব্যয়টা বেশি হচ্ছে কৃষকের।

যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের ভূগোল বিভাগের সাবেক প্রধান ছোলজার রহমান বলেন, ‘কম বৃষ্টিপাতের কারণে কৃষকদের সেচ খরচ বেড়েছে। আবার সার ও ডিজেলের দাম বাড়তি। সব মিলিয়ে কৃষককে ফসল উৎপাদনে বেগ পেতে হচ্ছে।’

যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জেলায় রোপা আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার ৪৬০ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯৪৭ হেক্টরে। গত বছর রোপা আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯৪৭ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৭০০ হেক্টরে।

মূলত সার ও ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে কৃষি অর্থনীতিতে দুই ধরনের চাপ সৃষ্টি হতে পারে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের ন্যায্য দাম পেতে গেলে বেশি দামে বিক্রি করতে হবে। আবার বাজারে চালের দাম বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের খরচ বাড়বে, যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে পারে।

গত বছরের ১ আগস্ট ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ৬ টাকা বাড়িয়ে ডিলার পর্যায়ে সর্বোচ্চ খুচরা দাম প্রতি কেজি ২০ এবং কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ২২ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এর চারদিন পরই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনাবৃষ্টি। সব মিলিয়ে আমন উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে।

কৃষকরা বলছেন, গত বছর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় ধান উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে। জমি প্রস্তুতের জন্য পাওয়ার টিলার কিংবা ট্রাক্টর দিয়ে তিন চাষে আগে ৭৫০ টাকা নেয়া হতো, এখন নেয়া হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকা। অনাবৃষ্টির কারণে এ বছর সেচ দিয়ে ধান আবাদ করতেও বিপাকে পড়েছেন কৃষক। ডিজেলচালিত ইঞ্জিনে আগে প্রতি ঘণ্টায় ১০০-১২০ টাকা নেয়া হতো, এখন নেয়া হচ্ছে ২০০ টাকা। এক বিঘা জমিতে একবার সেচ দিতে বাড়তি প্রায় ২০০ টাকা খরচ পড়ছে।

ঝিকরগাছা উপজেলার মাটিকুমড়া গ্রামের কৃষক গোলাম মোস্তফা জানান, তিনি পাঁচ বিঘা জমিতে আমন আবাদ করেছেন। এবার বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় সেচ দিয়ে জমি প্রস্তুত করছেন। ডিজেলের দাম বাড়ায় সেচ ও চাষে খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। গত বছর তার সব মিলিয়ে এক বিঘা জমিতে ১৪ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছিল। এবার অবস্থা খারাপ। এক বিঘা জমিতে ২০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে এবার ৬-৭ হাজার টাকা বিঘাপ্রতি খরচ বেড়েছে।

বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগ্রামের এক কৃষক বলেন, ‘এবার আমি দেরিতে আমন আবাদ করেছি। তার পরও সেচ দেয়া লেগেছে। চার বিঘা জমি আবাদে প্রতি বিঘায় কমপক্ষে ২২ হাজার টাকা লেগেছে। শুধু সেচ বাবদ খরচ পড়েছে ২ হাজার টাকা। গত বছরের চেয়ে এবার বিঘায় খরচ বেড়েছে কমপক্ষে ৮ হাজার টাকা।’

এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আবু হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চলতি মৌসুমে বৃষ্টিপাত অনেক কম হয়েছে। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষকের সেচ খরচ লেগেছে। তবে এখন বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে করে আর সেচ দেয়া লাগছে না।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন