
গত ২১ সেপ্টেম্বর দৈনিক ‘বণিক বার্তায়’ ব্যাংকের বন্ধকি সম্পত্তির ওপর একটা খুবই অনুধাবনযোগ্য খবর প্রকাশ হয়েছে। খবরটির শিরোনাম: ‘৯ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বন্ধকি সম্পত্তির বুদবুদের ওপর ব্যাংক, জমিসহ বন্ধকি সম্পদ বিক্রি করে খেলাপি ঋণ আদায় অতিনগণ্য’। খবরটির ভিত্তি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) একটি গবেষণা প্রতিবেদন। প্রতিষ্ঠানটি ভালো সংখ্যক ব্যাংকের তথ্যের ওপর কাজ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। অতএব, এতে সন্দেহ স্থাপন করা যাবে না। বিশেষ করে পরিসংখ্যানের ওপর। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ‘জমি ও রিয়েল এস্টেট’ জামানত রেখে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। ২০১০ সালে মোট ঋণের ৪৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয় জমি ও রিয়েল এস্টেট জামানত রেখে। এর পরিমাণ ২০২৩ সালের জুনে দাঁড়িয়েছে ৬৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ। বৃদ্ধির পরিমাণ যথেষ্ট। টাকার অংকে ২০১০ সালে এ ধরনের ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ লাখ ৪১ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের জুনে এর পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৯ লাখ ২০ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনটি পাঠ করে সবারই চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার কথা। প্রথমত, এসব বন্ধকি সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সম্পত্তির মূল্যায়ন নিয়ে কথা এসেছে। সম্পত্তি বিক্রি হয় না—এ কথা বলা হয়েছে। ব্যাংকের সম্পত্তি কেউ কিনতে চায় না, মামলা-মোকদ্দমায় আটকে পড়েছে বিক্রির প্রক্রিয়া ইত্যাদি বিষয় আছে। এ খবরে যেকোনো পাঠক ক্ষুব্ধ হবেন—এটাই স্বাভাবিক। যারা গবেষক-ছাত্র তারা চিন্তা করার অবসর পাবেন। যারা ভীষণ সমালোচক তারা বলবেন এসব কী হচ্ছে? ব্যাংক খাতে এমনিতেই সমস্যার শেষ নেই। এর মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে খেলাপি ঋণ, যা আদায় হচ্ছে না এবং যার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এদিকে এ খেলাপি ঋণ আদায়ের বড় অস্ত্র হচ্ছে বন্ধকি সম্পত্তি (কোলেটারেল বা মর্টগেজড প্রপার্টি)। নানা আইনি জটিলতা পেরিয়ে ব্যাংক এসব সম্পত্তি বিক্রি করেই খেলাপি ঋণের টাকা আদায় করে। কিছু অবশ্য আদায় হওয়ার কথা প্রাথমিক জামানত (প্রাইমারি সিকিউরিটি) বিক্রি করে। ব্যাংক ঋণের বড় শর্ত দুটি: প্রাইমারি সিকিউরিটি ও কোলেটারেল। ইদানীং আবার ব্যাংকাররা এসবের অভাব দূর করে বড় বড় গ্রাহককে ঋণ দেয়ার জন্য করপোরেট গ্যারান্টি, পার্সোনাল গ্যারান্টি বা সিকিউরিটির পন্থা আবিষ্কার করে নিয়েছেন। এ বিষয়ে কেউ আলোচনা করে না। অনেকের নজরেও নেই বিষয়টি।
প্রথম প্রশ্ন, এ অকেজো জামানতনির্ভর ঋণ বিতরণ ব্যবস্থাটি কি নতুন? না, আদৌ নতুন নয়। এটা চলছে বহুদিন ধরে এবং এ নিয়ে যে ব্যাংকগুলো বড় সমস্যায় আছে তাও জানা ব্যাংকার ও সংশ্লিষ্টদের। তবে বিআইবিএমের বর্তমান গবেষণা এবং বণিক বার্তার খবর প্রকাশের মাধ্যমে দেশবাসী জানল কী হচ্ছে ব্যাংকে। ব্যাংকের ঋণের টাকা যে বুদবুদময় বন্ধকি সম্পত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তা জানা গেল। এখানেই জড়িত আমানতকারীদের স্বার্থ। কারণ বন্ধকি সম্পত্তি যদি বুদবুদের মতো হয় তাহলে খেলাপি ঋণের টাকা, এমনিতে প্রদত্ত ঋণের টাকা আদায় হবে না। আর ব্যাংক কোনো কারণে ‘অবসায়নে’ (লিকুইডেশন) গেলে তাদের আমানতের টাকা পেতে ভোগান্তির শেষ হবে না। আবার এ কারণে ব্যাংকের অর্থনৈতিক শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। বাড়বে পুঁজি রাখার বাধ্যবাধকতা, বাড়বে বেশি বেশি প্রভিশন রাখার বাধ্যবাধকতা। বহু সমস্যা। অথচ সমস্যাটি বহুদিনের পুরনো। এটা স্বাধীনতা-পূর্বকালেও ছিল। উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা বন্ধকি ব্যবস্থায় ঋণ দেয়ায় প্রথাটি পেয়েছি। এর কারণ কী?
অনেক কারণের মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে বন্ধকি সম্পত্তির কোলেটারেল বাধ্যবাধকতা। ব্যাংকের ঋণ দিতে হলে প্রাইমারি সিকিউরিটি (মালামাল, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি) যেমন লাগবে, তেমনি লাগবে কোলেটারেল (বন্ধকি) সম্পত্তি। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম-বিধান। এই নিয়ম-বিধান লঙ্ঘন করা কোনো ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। কোলেটারেল ছাড়া ঋণ দেয়া যেমন নিয়মবহির্ভূত, আবার তা শাস্তিযোগ্য অপরাধও। ‘অডিট’ বিশাল আপত্তি তুলবে, যা দুর্নীতি দমন বিভাগ পর্যন্ত গড়াতে পারে। মুখে সবাই আমরা ভালো গ্রাহকের কথা বলি, তার ব্যবসা দেখার কথা বলি, ব্যবসার লাভপ্রদতার কথা বলি, ক্যাশ ফ্লোর কথা বলি, কিন্তু বাস্তবটা বড় ভিন্ন। মুখে মুখে আমরা নতুন উদ্যোক্তার কথা বলি, অথচ তাদের অনেকেরই মর্টগেজ দেয়ার মতো সম্পত্তি নেই। অর্থাৎ মুখে মুখে যা-ই বলি না কেন মর্টগেজ আবশ্যকীয় বিষয়। খবরের কাগজও মর্টগেজ ছাড়া ব্যবসায় ঋণ দিলে বড় করে খবর ছাপে। বলাই বাহুল্য, এর মূল কারণ কোলেটারেলের বাধ্যবাধকতা। এ ব্যাপারে স্বাধীনতা-উত্তরকালে বহু কথা হয়েছে। স্বাধীনতার পরপর সময়ে বলা হয়েছিল দেশে ব্যবসায়ী নেই, শিল্পপতি নেই, তাদের পুঁজি নেই। ঋণ নেয়ার জন্য উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় কোলেটারেল নেই। অথচ কোলেটারেল ছাড়া ঋণ হবে না। অতএব, এর বাধ্যবাধকতা শিথিল করা হোক। না, তা হয়নি। এক্ষেত্রে মনে হয় একটি চালু কথা কার্যকর ছিল—‘আজ নগদ কাল বাকি। বাকির নাম ফাঁকি’। এই হচ্ছে বাঙালির বিশ্বাস। অতএব, ঋণ দেয়ার আগে ঋণের টাকা আদায়ের কঠোর ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। তা-ই হয়েছে। প্রাইমারি ও কোলেটারেল সিকিউরিটি ছাড়া ঋণ হবে না।
তাহলে বোঝা যাচ্ছে, কোলেটারেল নিয়ে কী হতে পারে। লোকেরা ব্যবসা করতে চায়, ব্যবসা বড় করতে চায়, নতুনভাবে ব্যবসা-শিল্প করতে চায়। অথচ তাদের বন্ধক দেয়ার মতো সম্পত্তি বা দালানকোঠা নেই। এদিকে ব্যাংকের সমস্যা রয়েছে। তারা আমানতকারীদের কাছ থেকে ফান্ড নিয়েছে। এর ওপর বছর বছর সুদ দিতে হবে। তাদের গ্রাহক দরকার। প্রয়োজনে বড় বড় গ্রাহক দরকার। অথচ উভয়েই আটকা পড়েছে আইনে। কী করা যায়? এই কী করা যায়ের উত্তর খুঁজতেই নানা দুর্ঘটনা। কোলেটারেল নিয়ে ঘাপলা। শুধু কোলেটারেল নয়, প্রাইমারি সিকিউরিটিতেও সমস্যা। স্বাধীনতার আগে ও পরপর সময়ে মফস্বলে গরু-ছাগলের বিপরীতে ঋণ দেয়া হতো। এটা কৃষি ঋণ। কৃষি ব্যাংকের একজন ডাকসাইটে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (যিনি প্রয়াত) খায়রুল কবীর সাহেব আমাকে একবার বলেছিলেন, এত লাখ লাখ টাকার, কোটি কোটি টাকার ঋণ দেয়া হয়েছে—এর বিপরীতে গরু-ছাগলগুলো কোথায়? দেশ ভর্তি থাকার কথা গরু-ছাগলে। প্রকৃতপক্ষে গরু-ছাগল দেখিয়ে, নানাভাবে দেখিয়ে, একই গরু-ছাগল বারবার দেখিয়ে গ্রামের কিছু লোক ঋণ নিয়েছে। এ ঘটনার কথা শুনেছি বহুদিন আগে। আজও কি তার পরিসমাপ্তি ঘটেছে? না, নিশ্চিতভাবেই নয়। যাদের টাকার দরকার—ব্যবসার জন্য, শিল্পের জন্য—তারা ব্যাংক থেকে টাকা বের করবেই। ব্যাংকও টাকা নিয়ে বসা। কীভাবে তা হবে। স্বাধীনতার পরপর সময়ে, এমনকি আরো আগে গেলে বলা যায়, কার কী সম্পত্তি ছিল? ১৯৪৭ সালের পর অবস্থাপন্নরা দেশত্যাগ করে। তাদেরই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছিল সহায়-সম্পত্তি, জমিজমা যা কোলেটারেল হিসেবে ব্যাংকে দেয়া যায়। ১৯৭১ সালের পর পাকিস্তানিরা দেশত্যাগ করে। শহুরে সম্পত্তির বেশির ভাগই ছিল তাদের। তখনকার ঢাকার নবাবপুর রোড, ইসলামপুর, নিউমার্কেট, বায়তুল মোকাররম, স্টেডিয়াম মার্কেট, মতিঝিলের সহায়-সম্পত্তির মালিক আমরা ছিলাম অতি নগণ্য। এ সূত্রে হয় পরিত্যক্ত প্রচুর সম্পত্তি। অনেক সম্পত্তি হয় শত্রু সম্পত্তি (অর্পিত সম্পত্তি)। এসবের কয়টা আইনসিদ্ধভাবে ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। এরপর রয়েছে খাল-বিলের সম্পত্তি, খাসজমি, নবাববাড়ি, ভাওয়াল রাজাদের সম্পত্তি। মতিঝিল থেকে জয়দেবপুরের সম্পত্তির কতটুকু কীভাবে হস্তান্তর হয়েছে তার কি কোনো হিসাব আছে? সেগুনবাগিচা, পুরানা পল্টন, শান্তিনগর, সিদ্ধেশ্বরী অঞ্চলে শত শত, হাজার লোকে ফ্ল্যাট কিনেছেন—এখন সরকার খাজনা নেয় না, অথচ এসব সম্পত্তি ভূতের মাধ্যমে রেজিস্ট্রি হয়েছে। ইজারাকৃত সম্পত্তি সরকারের অনুমোদন ছাড়াই বিল্ডিংয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। এই যে মালিকানা সমস্যা তার কথা কি আমরা ভেবে দেখেছি।
এক্ষেত্রে অপ্রিয় একটি সত্যি কথা বলতে হয়। যদি ব্যাংকগুলো স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত সময়ে জমির সত্যিকার মালিকানা, জমির অবস্থা দেখে ঋণ দিত তাহলে কয়জন ঋণ পেত? যদি ওই সব জমির সত্যিকার অর্থে মূল্যায়ন করে ঋণ দেয়া হতো তাহলে কত টাকার ঋণ বিতরণ হতো? এই তো কয়দিন আগে দেখলাম, প্রয়াত এক সংসদ সদস্য খাসজমিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করেছিলেন। ব্যাংক তাতে ঋণ দেয়। তাহলেই প্রশ্ন, মালিকানার কী হলো, ব্যাংক কী করল। কী করে শক্তিশালী লোকেরা ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করলেন? মালিকানার তালেগোলে পড়ে, নানা পন্থা আবিষ্কার করে আইনজ্ঞদের, ব্যারিস্টার সাহেবদের আইনি অনুকূল মতামত নিয়েও যখন হচ্ছিল না তখন আবিষ্কার হলো ‘করপোরেট গ্যারান্টি’, ‘পার্সোনাল গ্যারান্টি’; যেসব কার্যত কোনো সিকিউরিটি বা গ্যারান্টিই নয়। বড় বড় গ্রাহক বড় বড় ঋণ নেয়ার জন্য ঝামেলাপূর্ণ সম্পত্তি দিয়েও তখন কুলোতে পারছিলেন না, তখন তাদের জন্য ‘করপোরেট গ্যারান্টি’ আবিষ্কৃত হয়। এসব বিচারে বলাই যায়, ব্যাংক ঋণের প্রায় পুরোটা বুদবুদসম জামানতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বিআইবিএম যেসব সমস্যার কথা তুলে ধরেছে তার মধ্যে অসত্য কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখন দরকার মূল সমস্যার সমাধান। কোলেটারেল নিয়ে সিরিয়াসলি চিন্তাভাবনা করা দরকার। এ ব্যবস্থা কার্যত অনুপযোগী একটা ব্যবস্থা। এর ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ব্যবসা এবং গ্রাহকের ওপর নির্ভর করা দরকার।
ড. আর এম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক