
চিকিৎসাসেবায় নার্সিং খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একজন চিকিৎসক সবসময় রোগীর পাশে থাকতে পারেন না। এ সময় নার্সকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। যে কারণে চিকিৎসাসেবার সহায়ক বিষয়গুলোয় নার্সদের উপযুক্ত দক্ষতা অর্জন আবশ্যক। দেশে নার্সিং শিক্ষার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোয় মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে কিনা তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
বণিক বার্তায় প্রকাশ, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি এবং সমমানের ডিগ্রি সম্পন্নকারীদের পেশাগত জীবনে প্রবেশের জন্য নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল থেকে এ নিবন্ধন দেয়া হয়। এজন্য কাউন্সিল কর্তৃক আয়োজিত কম্প্রিহেনসিভ (লাইসেন্সিং) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। গত ২৯ সেপ্টেম্বরের লাইসেন্সিং পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৮০ শতাংশ অকৃতকার্য হয়েছে। যদিও ৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় এ হার ছিল ১২ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তবে এবার ফল বিপর্যয়ের জন্য প্রশ্নের ধরন পরিবর্তনকে সংশ্লিষ্টরা দায়ী করছেন।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, পরীক্ষায় সাধারণত শিক্ষার্থীদের কোর্স সিলেবাস, ব্যবহারিক ও সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় থেকে প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে ন্যূনতম ৫৯ দশমিক ২০ নম্বর পেতে হবে। শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে কোর্সের কারিকুলাম সম্পন্ন করলে পাস নম্বর পাওয়ার কথা। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফলে প্রায়ই বিপর্যয় দেখা যাচ্ছে। বিশেষত ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি ও ডিপ্লোমা ইন পেশেন্ট কেয়ারে সবচেয়ে বেশি ফল বিপর্যয় ঘটে।
এক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিতভাবে নার্সিং ইনস্টিটিউটের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণেই ফল বিপর্যয় ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করেই অনেক প্রতিষ্ঠান শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ফলে শিক্ষার্থীরা তিন বা চার বছরের কোর্স সম্পন্ন করেও পরীক্ষায় পাস করছেন না।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রকাশিত ২০২২ সালের শিক্ষা পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে সরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউট রয়েছে ৬৮টি। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৬০। গত পাঁচ বছরের শিক্ষা পরিসংখ্যানের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৮ সালে নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল ৭১টি, শিক্ষার্থী ছিলেন ৪ হাজার ৪২৬ জন। সে হিসাবে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২২-এ দেশে নার্সিং ইনস্টিটিউট বেড়েছে ছয় গুণ আর শিক্ষার্থী বেড়েছে নয় গুণেরও বেশি।
তবে দেশে নার্সিং ইনস্টিটিউটের সংখ্যা বাড়লেও অনেক ইনস্টিটিউট পর্যাপ্ত শিক্ষকসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করছে না। ফলে শিক্ষার্থীরা কারিকুলাম অনুযায়ী শিখতে না পারায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এজন্য মানসম্মত নার্সিং শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে যেসব ইনস্টিটিউটে পর্যাপ্ত শিক্ষক, সুযোগ-সুবিধা নেই তাদের ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ রাখার পক্ষে মত দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
মূলত পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষার্থীসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলেই একটি ইনস্টিটিউটকে ভর্তির অনুমতি দেয়া উচিত। এমনটিও দাবি সংশ্লিষ্টদের।
নার্সিং প্রায়োগিক শিক্ষা। পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজির ফল বিপর্যয়ের বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো কোর্সকে ইকুইভ্যালেন্ট ঘোষণা করার আগে সে কোর্সের কারিকুলাম ও কোর্স পরিচালনাকারী ইনস্টিটিউটের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। লাইসেন্সিং পরীক্ষায় ফল খারাপ হওয়া কারিকুলাম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সবকিছু না শিখতে পারার প্রতিফলন হিসেবেই গণ্য হয়।
বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের পক্ষ থেকে পরীক্ষার প্রশ্নে এ বছর মূল বই ও ব্যবহারিক শিক্ষার জ্ঞানকে গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি বলা হয়েছে। বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন গাইড বই পড়ে পরীক্ষায় ভালো ফল করা সম্ভব নয় বলেও মত কর্তৃপক্ষের। এক্ষেত্রে যারা মূল বই ভালোভাবে পড়েছেন, মৌলিক জ্ঞান ও ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জন করেছেন তারাই পরীক্ষায় ভালো করবেন।
এক্ষেত্রে নার্সিং শিক্ষার মানকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য কারিকুলামসহ প্রশ্নপদ্ধতি সবকিছুতেই পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) ভাষ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান নার্সিং শিক্ষার সঙ্গে জড়িত। ছাত্রছাত্রীরা সার্টিফিকেট পাওয়ার পর সাধারণত মেডিকেল সেন্টারগুলোয় চাকরি পান। এসব চাকরিতে সনদের মান মুখ্য ভূমিকা রাখে না। কিন্তু সরকারি চাকরির জন্য লাইসেন্সিং সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়। আর এ পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোয় মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
রোগীর সেবার ক্ষেত্রে নার্সদের খুব সচেতন হতে হয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দক্ষতা না থাকলে তা নেতিবাচক ঘটনার জন্ম দিতে পারে। এজন্য রোগীদের যথাযথ সেবা-শুশ্রূষার প্রয়োজনেই দক্ষ নার্স প্রয়োজন। আর নার্সদের দক্ষতা নিশ্চিতে মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। নার্সিং শিক্ষার ক্ষেত্রে যত্রতত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে না তুলে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা, যোগ্য শিক্ষকের ব্যবস্থা করে তবেই শিক্ষাদান করা উচিত।
নার্সিংয়ের বিষয়টি মোটেও হেলাফেলা করার বিষয় নয়। এজন্য এ পেশার গুরুত্ব বিবেচনা করে মৌলিক জ্ঞান অর্জনের প্রতি জোর দিতে হবে। বাজারে যেসব গাইড বই পাওয়া যায়, তার ওপর ভিত্তি করে পড়াশোনা করলে শিক্ষার্থীদের অনেক কিছুই অজানা থেকে যাবে। এজন্য মূল পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান ও ব্যবহারিক শিক্ষায় দক্ষ হওয়ার বিকল্প নেই।