
বেশ কিছুদিন আগে কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতায় পড়েছিলাম, মাকে টোকিও শহরটা কিনে দিতে ইচ্ছে হয়, কত দাম পড়বে কে জানে?
জিনিসপত্রের যা দাম বেড়েছে,
এক পোয়া রসুনের দাম কুড়ি টাকা
বাবা রেগে বাজারে যান না...
হ্যাঁ সত্যি আজকাল বাজারে জিনিসপত্রের যা দাম বেড়েছে রাগ করে বাজারে না যেতে পারলেই বরং ভালো হতো। কিন্তু পেট কি আর দামের দোহাই মানে।
আগে নাটকে-সিনেমায় দেখাত মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তাটি মানে বাবা যখন বাজারে যাচ্ছেন তার পকেটে অল্প কিছু টাকা। তিনি ইলিশ মাছ কিনতে না পারেন অন্তত পাঙাশ মাছ কিনে ঘরে ফিরছেন। আবার দেখা যাচ্ছে নায়ক পরিবারের অমতে বিয়ে করেছে। বউকে খাওয়াবে কী, শেষমেশ ডিম ভাজি করে পার করে দিচ্ছেন দুপুর আর রাতের খাবার। কিন্তু বর্তমানে পাঙাশ এবং ডিমও ক্রমেই সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। পাঙাশ ও ডিমের বাজারে যে অস্থিরতা সেখানে স্বস্তির কোনো খবর নেই।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং করোনা মহামারী-পরবর্তী সময়ে খাদ্যপণ্যসহ নিত্যব্যবহার্য সব পণ্যের দাম বেড়েছে এ কথা সত্য। কিন্তু হঠাৎ একটিমাত্র রাতের ব্যবধানে কাঁচামরিচের কেজি ১৬০০ টাকায় আর ডিমের হালি ৫৮ টাকায় বিক্রি হয়। বাজার মনিটরিংয়ের তথ্য বলছে, মাত্র দুই দিনে ভোক্তার পকেট থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন ডিম ব্যবসায়ীরা।
কাঁচামরিচ, রমজানের সময় তরমুজ, ডেঙ্গুর প্রকোপে স্যালাইন কিংবা ডাব সব ব্যাপারেই একই চিত্র।
দুই দিন পরপর পত্রিকার শিরোনাম নিয়ন্ত্রণে নেই অমুক জিনিসের বাজার। বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন, সবটা নিয়ন্ত্রণ করা আসলে সম্ভবও নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাস্তবতা আসলে তাই, কেননা দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। দুই দিন পরপর ভোক্তা অধিদপ্তরের ভিডিও ক্লিপ জনমানুষের সামনে আসে। সেখানে দেখা যায় অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতেনাতে ধরে জরিমানা করা হচ্ছে। কিন্তু আদতে এ অভিযানের ফলে বাজার ব্যবস্থার কোনো উন্নতি ঘটছে কি?
সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে হাজার হাজার টাকা পকেটস্থ করা কেবল আইনবহির্ভূতই নয়, বরং অনৈতিকও বটে।
সমাজের প্রচলিত ধারণা হলো ব্যবসার একমাত্র এবং কেবলমাত্র উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন করা। প্রখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ্যার জনক অ্যাডাম স্মিথ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যাপারে ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তার মতে, প্রত্যেকে যদি নিজের স্বার্থকে গুরুত্ব দেয় তবে সামগ্রিকভাবে সমাজের সবাই উপকৃত হবে। ব্যক্তিস্বার্থ আর সমাজের স্বার্থকে সমন্বয় করতে তিনি অদৃশ্য হাত তত্ত্বের অবতারণা করেন। অর্থনীতিশাস্ত্রে এ অদৃশ্য হাত তত্ত্ব বহুল চর্চিত। অ্যাডাম স্মিথ এ অদৃশ্য হাতের মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করেন। তার মতে, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এ অদৃশ্য হাতের মাধ্যমে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বর্তমানে বাজারে অদৃশ্য হাতের বিপরীতে কালো হাতের উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারের পরিবর্তে একচেটিয়া বাজার বিরাজমান।
নিত্যপণ্য সবকিছুর হঠাৎ বেড়ে যাওয়া দামের এ প্রেক্ষাপটে সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিসের দাম বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু এ দামে বাজারে পণ্য বিক্রি হচ্ছে না।
সমস্যার সমাধান হয়তো রাতারাতি মিলবে না। কেননা অসাধু ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া বাজার দখলের ফলে ক্রেতারা ব্যবসায়ীদের কাছে একপ্রকার জিম্মি। বিরাজমান এ সংকট মোকাবেলায় ব্যবসা নীতিবিদ্যা নামক বিষয়টি বিবেচনায় আনা যেতে পারে।
জ্ঞানের পৃথক শাখা হিসেবে ব্যবসা নীতিবিদ্যার যাত্রা গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে। ব্যবহারিক নীতিবিদ্যার শাখা হিসেবে গত কয়েক দশকে ব্যবসা নীতিবিদ্যা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে বিস্তর। যদিও ব্যবসা ও নীতিবিদ্যাকে আপাতদৃষ্টিতে বিরোধাত্মক বলে প্রতীয়মান হয় কিন্তু উত্তর-আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে টেকসই সমাজের জন্য টেকসই ব্যবসার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আর টেকসই ব্যবসা তখনই সম্ভব যখন ব্যবসা ও নীতিবিদ্যা পাশাপাশি সহাবস্থান করবে।
ব্যবসা নীতিবিদ্যা বলতে সাধারণ অর্থে ব্যবসাসংক্রান্ত বিষয়াদির নীতিবিদ্যক আলোচনাকে বোঝায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ দাউদ খান তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভে ব্যবসা নীতিবিদ্যার সংজ্ঞায় উল্লেখ করেন, ‘ব্যবসা নীতিবিদ্যা হলো প্রায়োগিক নীতিবিদ্যার একটি বিশেষ শাখা, যেখানে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত মানুষের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির ঔচিত্য-অনৌচিত্য, ন্যায়ত্ব-অন্যায়ত্ব, ভালোত্ব-মন্দত্ব প্রভৃতি মূল্যায়ন করা হয়।’
অর্থাৎ ব্যবসার ক্ষেত্রে ভালো ব্যবস্থাকে গ্রহণ এবং মন্দ ব্যবস্থাকে বর্জন করাই ব্যবসা নীতিবিদ্যা। সঠিক মাপে পণ্য দেয়া, ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি করা, ক্রেতার সঙ্গে উত্তম আচরণ করা প্রভৃতি বিষয়ও ব্যবসা নীতিবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত।
আমেরিকার বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক থিওডর লেভি বলেন, ‘ব্যবসায়ের কেবল একটি দায়বদ্ধতা রয়েছে এবং তা হলো ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি ব্যবহারিক আদর্শ যেমন সততা, উত্তম বিশ্বাস প্রভৃতির ওপর গুরুত্ব প্রদান করবেন।’
নীতিবিদ্যার ধ্রুপদি তত্ত্বগুলো পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে ব্যবসায় সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতাকে ব্যাখ্যা করা যায়।
প্রথমত উপযোগবাদ। নৈতিকতার অন্যতম একটি আলোচনার বিষয় উপযোগবাদ। ব্রিটিশ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল ও জেরেমি বেন্থাম এ তত্ত্বের প্রবক্তা। উপযোগবাদী তত্ত্ব অনুসারে সমাজে এমন কাজ পরিচালনা করা উচিত যেন অধিকসংখ্যক মানুষের সর্বোচ্চ পরিমাণ সুখ নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু বর্তমানে ব্যবসার ক্ষেত্রে উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে কেবল আত্মস্বার্থমূলক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ব্যবসা পরিচালনা করলে অধিকাংশ মানুষ উপকৃত হবে। মরিচ কিংবা ডাবের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধিতে লাভবান হয়েছে গুটিকয়েক লোক অথচ উৎপাদনকারী এবং ভোক্তার হয়েছে লোকসান।
দ্বিতীয়ত অধিকারবিষয়ক নৈতিক তত্ত্ব। সমাজে আইনি অধিকার সম্পর্কে আমরা অবহিত থাকলেও নৈতিক অধিকার সম্পর্কে খুব একটা অবগত নই। সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি আইনি ও নৈতিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই জনসাধারণের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে।
জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের নীতিদর্শন অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষের কিছু নৈতিক দায়িত্ব ও অধিকার রয়েছে। কান্টের অধিকারসংক্রান্ত মত বিশ্লেষণ করে আমেরিকার সান্তা ক্লারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা নীতিবিদ্যার অধ্যাপক ম্যানুয়েল জি ভেলাসকুয়েজ চার ধরনের অধিকারকে চিহ্নিত করেন। এর মধ্যে সত্য জানার অধিকারটি অধিকতর প্রাসঙ্গিক।
সত্য জানার অধিকার মতে, আমাদের প্রত্যেকের সত্য জানার অধিকার রয়েছে। ব্যবসার ক্ষেত্রে ভোক্তার রয়েছে পণ্যের গুণগত মান ও মূল্যবিষয়ক সত্য জানার অধিকার। অথচ বাজারে হঠাৎ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে ভোক্তার কাছে সঠিক কোনো তথ্য সরবরাহ করা হয় না।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বর্তমানে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিজনিত সংকট মোকাবেলায় নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত সবাইকে নৈতিক ও দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। কেননা আমাদের ভুললে চলবে না যে মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে বসবাসরত প্রত্যেক মানুষের অন্যের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। ব্যবসার ক্ষেত্রে মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি নৈতিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতাকে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। টেকসই সমাজ ও টেকসই ব্যবসা পরিচালনার জন্য নৈতিকতা তাই অপরিহার্য।
তাবাসসুম আক্তার: প্রভাষক, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ