
চিকিৎসা শিক্ষার প্রসার ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিৎসকের সংকট কাটাতে গত দেড় দশকে ২০টি সরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে মোট সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৩৭টি। প্রতি শিক্ষাবর্ষে এসব চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে নতুন চার সহস্রাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন। যদিও এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর জন্য প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম শিক্ষক আছেন। সব মিলিয়ে এসব কলেজে মোট শিক্ষকের পদ প্রায় ৪৫ শতাংশ খালি রয়েছে।
বণিক বার্তায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে বর্তমানে শিক্ষকের পদ রয়েছে পাঁচ হাজার ৬৬৮টি, যার মধ্যে ২ হাজার ৫৪৪টি পদ ফাঁকা রয়েছে। সে অনুযায়ী, সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় মোট পদের বিপরীতে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে ৪৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) জানিয়েছে, একটি মেডিকেল কলেজে বহু বিভাগ থাকে। তবে মেডিকেল কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ন্যূনতম ১১টি বিষয় থাকা বাধ্যতামূলক। বিষয়গুলো হলো অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, কমিউনিটি মেডিসিন, ফরেনসিক মেডিসিন, ফার্মাকোলজি, প্যাথলজি, মাইক্রোবায়োলজি, সার্জারি, মেডিসিন এবং গাইনি ও অবস। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এমবিবিএস (ব্যাচেলর অব মেডিসিন, ব্যাচেলর অব সার্জারি) ও বিডিএস (ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি) ডিগ্রি দেয়া হয়, সেগুলোর একটি সাধারণ নীতিমালা হলো, প্রতি ১০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক থাকতে হবে। আর প্রতি ২৫ শিক্ষার্থীর জন্য ন্যূনতম একজন পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারী শিক্ষক থাকতে হবে। যদিও সরকারি চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ শর্ত পূরণ করতে পারছে না। এতে চিকিৎসা শিক্ষার মান পড়ে যাওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শিখন প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা। এসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপক পদেই শিক্ষকের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি বলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে।
এদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০২১-২২) বলা হয়, চিকিৎসা শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে সরকার প্রতিটি জেলায় একটি করে মেডিকেল কলেজ স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি মেডিকেল কলেজগুলোয় আসনসংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। ২০০৯ সালেও দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ছিল ১৭টি। বর্তমানে এর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৭। অনুমোদন ও প্রতিষ্ঠার অপেক্ষায় আছে আরো বেশ কয়েকটি।
বর্তমানেই যেখানে শিক্ষক সংকট রয়েছে, তার ওপর নতুন মেডিকেল কলেজগুলোয় পর্যাপ্ত শিক্ষক নিশ্চিত করার বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে এসব মেডিকেল কলেজ জনস্বাস্থ্যের জন্য কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হতে পারে। এছাড়া প্রতি শিক্ষাবর্ষে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর আসন পূর্ণ হলেও শিক্ষার্থীদের চিকিৎসাশাস্ত্রে পাঠদানের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষকের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।
মেডিকেল কলেজ পরিচালনায় সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকের পদ বেশি খালি রয়েছে। এতে একাডেমিক কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। বস্তুত অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির পর শিক্ষকদের বিভিন্ন কলেজে বদলি করে দেয়া হয়। এতে একাডেমিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখা কঠিন হওয়ার পাশাপাশি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায়ও সংকট দেখা দেয়। কারণ একাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি শিক্ষকরা কলেজের হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন।
শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বিষয়টিও উঠে এসেছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে বলেও সংশ্লিষ্টরা মত দিয়েছেন। আবার সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় শুধু শিক্ষকের সংকট রয়েছে তা নয়, অবকাঠামো থেকে শুরু করে পরীক্ষাগার-হোস্টেলসহ সবকিছুতেই সংকট রয়েছে। ফলে অধিকাংশ মেডিকেল কলেজেই স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা বেশ দুরূহ হয়ে পড়েছে।
দেশের চিকিৎসা শিক্ষার মান এখন সর্বকালের সর্বনিম্নে। একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের সংকট শিক্ষার্থীদের শিখন পদ্ধতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জনগণের স্বাস্থ্য অধিকারের কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকারের উচিত দ্রুত কলেজগুলোকে মানসম্পন্ন করা। এমনই মত চিকিৎসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের।
তবে শিক্ষক সংকটের বিষয়টি দ্রুত সমাধানের প্রক্রিয়া চলছে বলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এক্ষেত্রে সম্প্রতি অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে অনেকের পদোন্নতি হয়েছে, এমন বক্তব্যও পাওয়া গেছে। আমরা দেশের চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আশাবাদী হতে চাই। এজন্য মানসম্মত চিকিৎসক তৈরিতে মানসম্মত শিক্ষক প্রয়োজন। এর ঘাটতি থাকলে দেশে চিকিৎসা শিক্ষার প্রসার ঘটবে না। এক্ষেত্রে বিদ্যমান সংকট কাটাতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করবে, এটিই কাম্য।