নানা সংকটে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

এক দশকেও নির্মাণ হয়নি স্থায়ী ভবন

ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া

রাবিপ্রবি ক্যাম্পাস ছবি: সংগৃহীত

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০০১ সালের ১৫ জুলাই জাতীয় সংসদে ‘রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রাবিপ্রবি) আইন’ পাস করে সরকার। বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম শুরু হয় তারও এক যুগ পর, ২০১৩ সালে। তবে দীর্ঘ ১০ বছর পার হলেও নিশ্চিত করা যায়নি শিক্ষার পরিবেশ। প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়লেও নির্মাণ করা যায়নি প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। নানা সংকটে ভোগা বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছে দুটি অস্থায়ী ভবনে। নিয়োগ দেয়া হয়নি পর্যাপ্ত শিক্ষক-কর্মকর্তাও। বর্তমানে পাঠদানসহ বিভিন্ন কাজ চলছে কেবল ২৮ শিক্ষক দিয়ে।  

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ১১৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকায় ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন; একটি প্রশাসনিক ভবন, দুটি একাডেমিক ভবন, দুটি ছাত্র ও একটি ছাত্রী হল, উপাচার্যের বাংলো, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ডরমিটরি, মেডিকেল সেন্টার, মসজিদ এবং প্রধান ফটকসহ বেশকিছু অবকাঠামো নির্মাণের কথা ছিল। তবে প্রায় ১০ বছরের বেশি সময় পার হলেও ভূমি অধিগ্রহণ ছাড়া কোনো কাজই হয়নি। এমনকি তৈরি হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যানও।  

বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জন্য ১০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ২৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। যদিও ৬৪ দশমিক ৭৭ একর ভূমি অধিগ্রহণ করতেই লেগে গেছে প্রায় ৬৪ কোটি টাকা। এ কারণে অবকাঠামোর সংখ্যা কমিয়ে প্রকল্পের বাজেট বাড়িয়ে ১৪৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা করা হয়েছে। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনতলাবিশিষ্ট একটি প্রশাসনিক ভবন, একটি একাডেমিক ভবন, একটি করে ছাত্র ও ছাত্রী হল নির্মাণের কথা ছিল বর্ধিত মেয়াদ ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে। এ সময়ের মধ্যেও কোনো ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কভিড সংকটসহ নানা কারণ দেখিয়ে আবারো প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।

জানতে চাইলে রাবিপ্রবির পরিকল্পনা দপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল গফুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সমতলে এবং পাহাড়ে সামাজিক ও পরিবেশগত পার্থক্য রয়েছে। এ কারণে ভূমি অধিগ্রহণ করতেই দীর্ঘ সময় চলে গেছে। এর মাঝে করোনার প্রাদুর্ভাব ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্যও তার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ করেছেন, যিনি প্রকল্প পরিচালকেরও দায়িত্বে ছিলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর ছয় মাসের বেশি সময় উপাচার্যের পদ শূন্য ছিল। নতুন উপাচার্য আসার কয়েক মাস পর তাকে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং এটির মেয়াদ বৃদ্ধিসহ পুনরায় সংশোধনের আবেদন জানানো হয়েছে। বর্তমানে মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। প্রকল্পের সংশোধনী অনুমোদন হয়ে এলে সেই মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হবে।’ 

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাবিপ্রবিতে বর্তমানে পাঁচটি বিভাগে শিক্ষার্থী রয়েছেন ৫৮১ জন। কেবল ২৮ শিক্ষক দিয়ে চলছে তাদের পাঠদান ও গবেষণার কাজ। এসব শিক্ষকের অনেককে আবার প্রশাসনিক কাজেও ব্যস্ত থাকতে হয়। নেই কোনো অধ্যাপক কিংবা সহযোগী অধ্যাপক। এমনকি ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসার্চ টেকনোলজি বিভাগে কোনো শিক্ষকই নেই। ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালটি ম্যানেজমেন্ট চালাচ্ছেন কেবল দুই শিক্ষক। আর ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগে শিক্ষক রয়েছেন চারজন।

কোনো শিক্ষক না থাকায় ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসার্চ টেকনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. কাঞ্চন চাকমা, যিনি মূলত বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের শিক্ষক। জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের অবকাঠামোগত সংকটের কারণে মূলত ক্লাসরুম ও ল্যাব সংকট রয়েছে। তবে সাধ্যের মধ্যে যতটা সম্ভব চেষ্টা করছি। ফিশারিজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের কয়েকবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গিয়ে ল্যাব ক্লাস করানো হয়েছে।’ 

শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলেও কাউকে পাওয়া যায় না। তবে এ বিভাগের জন্য শিক্ষক নিয়োগে পুনরায় বিজ্ঞপ্তি দেয়ার বিষয়ে উপাচার্যের সঙ্গে কথা হয়েছে।’

সরজমিনে দেখা গেছে, বর্তমানে রাবিপ্রবির একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছে দুটি অস্থায়ী ভবনে। অবকাঠামোগত সংকটের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রায় প্রতিটি বিভাগেই ক্লাসরুম ও ল্যাব সংকট। শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য নেই প্রয়োজনীয় কক্ষ। এমনকি উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে তাদের দাপ্তরিক কাজ করতে হয় এক রুমে বসেই। তাছাড়া হল না থাকায় রাঙ্গামাটি শহরে দুটি ভবন ভাড়া করে শিক্ষার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপাচার্যের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে স্থানীয় একটি রেস্ট হাউজে।

পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক, ক্লাসরুম ও ল্যাব সুবিধা না থাকলে কখনই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. এম ওয়াহিদুজ্জামান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘একজন শিক্ষক ক্লাসে পাঠদানের বাইরেও পরীক্ষার খাতা, অ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়ন ও প্রেজেন্টেশন নেন। প্রতিদিনের লেকচারের জন্য তার নিজের প্রস্তুতির বিষয় থাকে। কিন্তু যখন শিক্ষকসংখ্যা কম থাকে তখন তাকে অনেক বেশি ক্লাস লোড নিতে হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি লেকচার তৈরি এবং গবেষণায় পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না। ক্লাসে একটা লেকচারের পর সেটি সব শিক্ষার্থী বুঝেছে কিনা সময়স্বল্পতায় সেটি নিশ্চিত হওয়াও তার জন্য কঠিন হয়ে যায়। এসব কারণে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি তৈরি হয়।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘সামাজিক বিজ্ঞান আর মানবিক অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোর সঙ্গে বিজ্ঞান বা ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদভুক্ত বিভাগগুলোর বড় পার্থক্য বিজ্ঞানে পুঁথিগত শিক্ষাই যথেষ্ট নয়। যা পড়া হয় তা ল্যাবে হাতেকলমে শেখাও অনেক বেশি জরুরি। কিন্তু এ ধরনের বিভাগে যদি ল্যাবই না থাকে তাহলে শিক্ষার্থীরা অবশ্যই বড় ধরনের শিখন ঘাটতি নিয়ে বেড়ে উঠবে।’

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার পদও শূন্য। কেবল ২৭ জনকে দিয়ে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম। ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী নিয়োগের নিয়ম থাকলেও রেজিস্ট্রার এবং অর্থ দপ্তরের পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়েছে চুক্তিভিত্তিক, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ভারপ্রাপ্ত। অন্যান্য দপ্তরের পরিচালকের পদ এখনো শূন্য।

অভিযোগ রয়েছে চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত বাজেট পাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়টি। জ্বালানি খাতে অর্থ সংকট থাকায় গত এপ্রিল থেকে সপ্তাহে একদিন সশরীরে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্টদের শঙ্কা, এ সংকট আগামী কয়েক মাসে আরো বাড়তে পারে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. সেলিনা আখতার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আগে আমরা শহরে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে থাকলেও এখন স্থায়ী ক্যাম্পাসে সব কার্যক্রম চলে। তবে আবাসিক ভবনগুলো নির্মাণ না হওয়ায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এখনো শহরেই থাকেন। গাড়ির মাধ্যমে তাদের ক্যাম্পাসে আনা-নেয়া করা হয়। এ কারণে জ্বালানি খরচ কয়েক গুণ বেড়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। এমনকি যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা চাহিদার অর্ধেকও না। এ বছরে যা বাজেট দেয়া হয়েছে তা কয়েক মাস পরই শেষ হয়ে যাবে। এরপর আমরা কীভাবে চলব তা আমি উপাচার্য হয়েও জানি না।’ 

নানা সংকটের কথা তুলে ধরে উপাচার্য বলেন, ‘আমাদের এখানে প্রশাসনিক ভবন নেই, একাডেমিক ভবন নেই, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা নেই, পর্যাপ্ত বাজেট নেই। এসব কারণে সিনিয়র অধ্যাপকদের চুক্তিভিত্তিকও আনতে পারি না। এত বছর পরও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অবস্থা কেন, এ প্রশ্ন আমারও। তবে আমি চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব কাজ করার। আগের উপাচার্য প্রকল্প পরিচালক থাকায় আমাকেও ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্প সংশোধনের আবেদন মন্ত্রণালয়ে আছে। এটি পাস হলে ভবনগুলোর কাজ শুরু হবে। তাছাড়া সার্বিক বিষয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন সর্বাত্মক সহযোগিতার। তাই আশা করছি ভালো কিছু হবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চাহিদার যৌক্তিকতা বিবেচনা করেই পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়া হয় বলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের দাবি। এ বিষয়ে কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. আবু তাহের বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাঙ্গামাটিতে শিক্ষার্থী কম। সে হিসেবে তাদের পর্যাপ্ত বাজেটই দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে সরকারি সব প্রতিষ্ঠানেই জ্বালানির ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচন নীতিমালা অনুসরণ করা হচ্ছে। রাবিপ্রবিকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে ক্যাম্পাসের নিকটবর্তী ভবনে যেন শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করে। তাহলে যাতায়াত ব্যয় অনেক কমে আসবে।’ 

অবকাঠামো নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়টির অস্থায়ী ভবনগুলো ইউজিসির আর্থিক সহায়তায় তৈরি করে দেয়া হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের বাজেটের সঙ্গে আমাদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা নেই। তারা কেন এত বছরেও কোনো স্থায়ী ভবন তৈরি করতে পারল না, এ প্রশ্ন আমাদেরও। আর প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল দায়িত্বটা প্রকল্প পরিচালকের। তাকেই প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি সচেষ্ট থাকতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন