টিয়ার গ্যাস ও ফ্ল্যাশ ব্যাং গ্রেনেড কিনছে পুলিশ

নিহাল হাসনাইন

অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কিংবা যেকোনো সহিংসতা ঠেকাতে সাউন্ড গ্রেনেডের পাশাপাশি রাসায়নিকযুক্ত মাল্টি ইমপ্যাক্ট টিয়ার গ্যাস গ্রেনেড ও ফ্ল্যাশ ব্যাং গ্রেনেড কিনছে পুলিশ। এর মধ্যে টিয়ার গ্যাস গ্রেনেডে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি থাকায় এর ব্যবহার নিয়ে বিশ্বজুড়েই রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য তৈরি ফ্ল্যাশ ব্যাং গ্রেনেডও স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আতঙ্ক তৈরির এসব অস্ত্র মানুষকে রক্তাক্ত না করলেও অন্ধত্বের ঝুঁকি বাড়ায়। হ্রাস পেতে পারে শ্রবণশক্তিও।

সাউন্ড গ্রেনেড, মাল্টি ইমপ্যাক্ট টিয়ার গ্যাস গ্রেনেড এবং ফ্ল্যাশ ব্যাং গ্রেনেড কেনার জন্য সম্প্রতি আন্তর্জাতিক দরপত্র প্রকাশ করে বাংলাদেশ পুলিশ। সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক (আর্মস ও অ্যামুনেশন) মো. মনিরুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে তিনটি প্যাকেজে এ দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে প্রথম প্যাকেজে কেনা হবে ৩০ হাজার সাউন্ড গ্রেনেড। এর দাম ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৯০০ ডলার বা ১৯ লাখ ৬৯ হাজার টাকা (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ধরে)। দ্বিতীয় প্যাকেজে একই মূল্যে কেনা হবে ১৫ হাজার মাল্টি ইমপ্যাক্ট টিয়ার গ্যাস গ্রেনেড। আর তৃতীয় প্যাকেজে সাত হাজার ফ্ল্যাশ ব্যাং গ্রেনেড কেনা হবে ৯ হাজার ডলারে বা প্রায় ১০ লাখ টাকায়। এলসি (ঋণপত্র) খোলার ১২০ দিনের মধ্যে এসব বিস্ফোরক ডিভাইস বাংলাদেশ পুলিশের কাছে সরবরাহ করবে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। 

বিশ্লেষকরা জানান, কয়েক ধরনের রাসায়নিক যৌগের একীভূত রূপ ক্লোরোপিকরিন দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে মাল্টি ইমপ্যাক্ট টিয়ার গ্যাস গ্রেনেড। এতে ক্ষারজাতীয় রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি থাকায় বিস্ফোরণের পর চোখে প্রচণ্ড জ্বালা-যন্ত্রণা অনুভব হয়। সাময়িকভাবে মাল্টি ইমপ্যাক্ট টিয়ার গ্যাস গ্রেনেডের প্রভাবে সর্বোচ্চ ৪৫ মিনিট পর্যন্ত চোখ ঝাপসা হয়ে যেতে পারে। এ অস্ত্র মূলত দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ ও বিক্ষুব্ধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। বিশেষায়িত এ গ্রেনেড থেকে একই সঙ্গে কয়েক রঙের ধোঁয়া, বিকট শব্দ এবং উজ্জ্বল আলোর ঝলকানির সৃষ্টি হয়ে থাকে, যা মুহূর্তের মধ্যে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে।

ফ্ল্যাশ ব্যাং গ্রেনেডও একটি বিস্ফোরক ডিভাইস। এটি শত্রুর ইন্দ্রিয়কে সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত করতে ব্যবহৃত হয়। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের বাংকার খালি করার জন্য। প্রথম ১৯৭০ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এ ফ্ল্যাশ ব্যাং গ্রেনেডের ব্যবহার করে। তবে সম্প্রতি বিভিন্ন দাঙ্গা ও বিক্ষোভ দমনেও এ বিস্ফোরক ডিভাইসের ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে। একটি ফ্ল্যাশ ব্যাং গ্রেনেড থেকে ১৭০ ডেসিবলের ওপরে শব্দ উৎপন্ন হয়ে উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি তৈরি করে। এর রাসায়নিক থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া, আলো ও বিকট শব্দ জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। এতে সহজেই যেকোনো জনসমাগম ছত্রভঙ্গ করে দেয়া যায়।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, রাসায়নিক অস্ত্র হিসেবে পরিচিত মাল্টি ইমপ্যাক্ট টিয়ার গ্যাসের প্রভাবে চোখের কর্নিয়ার স্নায়ুগুলো আক্রান্ত হয়। ফলে অঝোর ধারায় কান্না, ব্যথা, এমনকি অন্ধ হয়ে যাওয়ারও সমূহ আশঙ্কা থাকে। আর ফ্ল্যাশ ব্যাং গ্রেনেড বিস্ফোরণ থেকে উৎপন্ন ১৭০ ডেসিবল শব্দ শ্রবণশক্তি হ্রাস করে। পাশাপাশি এর থেকে উৎপন্ন আলোক ঝলকানি সাময়িক অন্ধত্ব তৈরি করে। স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনায় তাই এ ধরনের বিস্ফোরক ডিভাইস ব্যবহার বন্ধ করেছে ইউরোপের দেশগুলো। 

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে সেটা যেন কখনো জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি না করে। শৃঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে ক্ষতিকর কোনো বিস্ফোরক ডিভাইস ব্যবহার করা হলে সেটা যেমন দেশের আর্থিক ক্ষতির কারণ, পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি হতে পারে। কেননা এ ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হলে এর থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেক ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, যা ব্যয়বহুল।’

এর আগে গত ১১ মে পুলিশের পক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পৃথক চারটি অনাপত্তিপত্র দেয়। এর একটিতে ১ কোটি ৯২ লাখ ৫৬ হাজার টাকায় ১০ হাজার কালার স্মোক গ্রেনেড কেনার কথা জানানো হয়। এগুলো সরবরাহ করছে রাজধানীর দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকার কমার্স ক্যাভ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। আরেকটি অনাপত্তিপত্রে ৫ কোটি ১৮ লাখ ৯৪ হাজার টাকায় ২০ শতাংশ ভেরিয়েশনের ২৮ হাজার ৫০০ সাউন্ড গ্রেনেড কেনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো সরবরাহ করবে বারিধারার প্রতিষ্ঠান তাসনীম-ই-ফেরদাউস স্প্রিং স্পার্ক। অন্য দুটি অনাপত্তিপত্রে ১ লাখ ৯৬ হাজার কাঁদানে গ্যাসের শেল কেনার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। ২২ কোটি ৯২ লাখ ৯৬ হাজার টাকায় এসব কাঁদানে গ্যাসের শেল সরবরাহ করবে দিলকুশার কমার্স ক্যাভ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আট হাজার সেমি অটো রাইফেল, শটগানের ১৫ লাখ কার্তুজ, ছয় লাখ ব্ল্যাংক কার্তুজ, দুই লাখ কাঁদানে গ্যাসের শেল, ৩৯ হাজার সাউন্ড গ্রেনেড, সার্ভিলেন্স যন্ত্রপাতি এবং স্পাই ক্যামেরা কেনার জন্য পৃথক দরপত্র দেয়া হয়। এর বাইরে ২৪ হাজার সাউন্ড গ্রেনেড এবং ১৫ হাজার মাল্টি ইমপ্যাক্ট কাঁদানে গ্যাসের শেল কেনার দরপত্র আহ্বান করা হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া সেলের প্রধান ও সহকারী মহাপরিদর্শক মনজুর রহমান এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এটি পুলিশের রুটিন কেনাকাটা। এগুলো বিশেষ কিছু নয়, স্বাভাবিক আমদানি।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন