
দেশে দিন দিন ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। বর্তমানে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এ ভাইরাস। চলতি বছর একদিনে সারা দেশের হাসপাতালগুলোয় সর্বোচ্চসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে গতকাল। বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত যতজন ভর্তি হয়েছে তার ৪৪ শতাংশই রাজধানীতে। এমন পরিস্থিতিতে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় না পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগ। মৌসুমি রোগের তালিকায় এটিকে আর দেখানো যাচ্ছে না। বছরের শুরু থেকে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ না করার ফলে এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। প্রতিরোধের বিষয়ে বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। রোগী বৃদ্ধি পাওয়ায় মৃত্যুও বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৬৮৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার মধ্যে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৭৩ হাজার ২৩৩ জন, যা মোট রোগীর ৪৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আর বছরজুড়ে মারা যাওয়া ৮২২ জনের মধ্যে ৫৬৪ জনই রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশেন এলাকার যা মোট মৃত্যুর ৬৯ শতাংশ। সারা দেশে ভর্তি রোগীর বিপরীতে মারা গেছে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ রোগী। রাজধানীতে ভর্তি রোগীর বিপরীতে মারা গেছে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। আর রাজধানীর বাইরে এই হার শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি ১০ হাজার ২৭০ জনের বিপরীতে ১১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি হওয়া ৫ হাজার ৬৩৩ জনের বিপরীতে ১৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
রাজধানীতে ২০টি সরকারি হাসপাতালে এ পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে ৪২ হাজার ৮৬০ জন। এর মধ্যে মারা গেছে ৪০৭ জন। অন্যদিকে রাজধানীর ৫৬টি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৩০ হাজার ৩৭৩ জনের মধ্যে ১৫৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ঢাকায় রোগী ভর্তি ও মৃত্যু বেশি হলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংকটাপন্ন রোগীরা চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে আসছে বলে জানান মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘জনসংখ্যার আধিক্য বেশি থাকায় স্বাভাবিকভাবেই ঢাকায় রোগী বেশি। তবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগীরা ঢাকার হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসার জন্য আসছে। ভর্তির সময় অনেক রোগী নিজ এলাকার ঠিকানা দেয় না। তারা স্থানীয় কোনো আত্মীয়ের ঠিকানা দেয়। সেক্ষেত্রে আমাদের বলা কঠিন, এ রোগী প্রকৃতপক্ষে কোন এলাকা থেকে এসেছে। দেখা যায়, কেউ কেউ আংশিক চিকিৎসা নিয়ে এসেছে। ডেঙ্গু রোগীদের ক্ষেত্রে ফ্লুইড ব্যবস্থাপনা সঠিক না হলে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। আমাদের হাসপাতালে যারা মারা গেছে তাদের ৯৫ শতাংশই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থেকে মারা গেছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর সারা দেশে মোট রোগীর প্রায় ৪৫ শতাংশ ঢাকা জেলার হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিয়েছে। বাকি ৫৫ শতাংশ চিকিৎসা নিয়েছে অন্যান্য জেলায়। ঢাকা ছাড়া অন্য শীর্ষ নয় জেলার মধ্যে চট্টগ্রামে ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ, বরিশালে ৪ দশমিক ২৭, পটুয়াখালীতে ২ দশমিক ৫৫, মানিকগঞ্জে ২ দশমিক ১৬, লক্ষ্মীপুরে ২ দশমিক শূন্য ৫, পিরোজপুরে ১ দশমিক ৯৪, চাঁদপুরে ১ দশমিক ৮৪, কুমিল্লায় ১ দশমিক ৭৭ ও ফরিদপুরে ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ রোগী চিকিৎসা নিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত শনিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রেকর্ড ৩ হাজার ১২২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৮৪৯ জন আর ঢাকার বাইরে ভর্তি হয়েছে ২ হাজার ২৭৩ জন। এর আগে দেশে সর্বোচ্চ রোগী ছিল ১০ সেপ্টেম্বর। ওই দিন রোগী ছিল ২ হাজার ৯৯৩ জন। গতকাল চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগী মারা গেছে ১৮ জন।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ১০ হাজার ৪৩৭ জন চিকিৎসাধীন আছে। ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ৪ হাজার ৬৬ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৬ হাজার ৩৭১ জন ভর্তি রয়েছে। মোট রোগীর মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪২৫ জন।
গত আগস্টে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছিল, বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মহামারী পর্যায়ে চলে গেছে। খুব দ্রুত সরকারের উচিত বহুমুখী পদক্ষেপ নেয়া। সংস্থাটি মূলত সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে মশা নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বিত কার্যক্রম জোরদারের পরামর্শ দিয়েছিল। চলতি মাসের শুরুতেও ডব্লিউএইচওর মহাপরিচালক টেড্রোস অ্যাডহ্যানম গেব্রিয়াসুস উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর ব্যাপক চাপ ফেলেছে।
রোগতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, শুরু থেকেই দেশে ডেঙ্গু মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের ঘাটতি ছিল। মশা নির্মূলই হচ্ছে এ রোগের বিস্তার রোধের প্রধানতম পদক্ষেপ। কিন্তু স্থানীয় সরকার বিভাগ বৈজ্ঞানিক পন্থায় মশা নির্মূলের পদক্ষেপ নিতে পারেনি। ডেঙ্গু প্রতিরোধ এখন সরকারের নির্দিষ্ট কোনো একটি দপ্তরের কাজ নয়। বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া এটি প্রতিরোধ সম্ভব নয়। রোগীর ওপর নজরদারি, মশার ওপর নজরদারি এবং মশা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে কিনা, এসব বিষয়ে নজরদারি জরুরি হলেও সেটি করা হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু এখন সারা দেশে মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার চেয়ে অন্যান্য অঞ্চলে বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে। সরকারের হিসাবে শুধু হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্য রয়েছে। ভর্তি না হলেও অনেকে বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছে। সে তথ্য সরকারের কাছে নেই। রাজধানীর হাসপাতালগুলোয় যেসব রোগী এসে ভর্তি হচ্ছে তাদের অনেকেই ঢাকার নয়। ফলে প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উচিত সঠিক তথ্য নেয়া। এতে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা কার্যক্রম ভালোভাবে পরিচালনা করা যায়।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬, মার্চে ১১১, এপ্রিলে ১৪৩, মে মাসে ১ হাজার ৩৬, জুনে ৫ হাজার ৯৫৬, জুলাইয়ে ৪৩ হাজার ৮৫৪, আগস্টে ৭১ হাজার ৯৭৬ এবং চলতি মাসের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত ৪৩ হাজার ৮৭৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। মৃতদের মধ্যে জানুয়ারিতে ৬, ফেব্রুয়ারিতে ৩, এপ্রিল ও মে মাসে ২ জন করে ৪ জন, জুনে ৩৪, জুলাইয়ে ২০৪, আগস্টে ৩৪২ এবং চলতি মাসের ১৬ দিনে ২২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। মার্চে কোনো রোগী মারা যায়নি।
এদিকে বাইরের ডেঙ্গু রোগীকে ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসার জন্য না আনার বা না পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্রিফিংয়ে গতকাল অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির এ অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, ‘অন্য জেলা থেকে ঢাকায় রোগী আনার সময় শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হতে পারে। ডেঙ্গুর চিকিৎসা সব জেলায়ই সমান। জেলায় চিকিৎসা হবে, ঢাকার হাসপাতালেও একই চিকিৎসা পাবে। ঢাকায় এনে ঝুঁকি বাড়ানোর কোনো মানে হয় না।’
কোনো প্রতিষ্ঠান শিরায় দেয়া স্যালাইন মজুদ করছে কিনা, তা তল্লাশি করতে সিভিল সার্জনদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও জানান অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির। তিনি বলেন, ‘সরকার ডেঙ্গুর সব ধরনের পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। কেউ যেন নির্ধারিত ফির বেশি না নেয়, সেজন্য সিভিল সার্জনদের নজরদারি বাড়াতে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।’
উল্লেখ্য, এর আগে গত বছর দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালে মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের। ২০২০ সালে ৭ জন এবং ২০২১ সালে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়।