এক বছরের ব্যবধান

পেট্রোবাংলার কোম্পানিগুলোর বকেয়া বেড়েছে ৬২%

আবু তাহের

দেশে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে গ্যাসের বকেয়া বিল। পেট্রোবাংলার আওতাধীন উৎপাদন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর পাওনা ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অথচ ২০২২ সালের এপ্রিলেও তা ছিল ১১ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে ৬২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে বকেয়ার পরিমাণ। বিপুল পরিমাণ এ অর্থ আদায়ে গ্যাস কোম্পানিগুলোর জোরালো তৎপরতা থাকলেও খুব বেশি কাজে আসছে না। এমনকি বেড়ে চলেছে জীবাশ্ম জ্বালানি কয়লার বকেয়া বিলও। 

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, গ্যাস উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ এবং কয়লা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে মোট ১২টি কোম্পানির ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বকেয়া পাওনা ছিল ১১ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। চলতি বছরের এপ্রিলে তা বেড়ে ১৮ হাজার ২৪৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বকেয়া বেড়েছে ৬ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর পাওনাই সবচেয়ে বেশি, মোট ১৪ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। গত বছরের এপ্রিলেও এর পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। এসব বকেয়ার বড় অংশই আটকে আছে সরকারি-বেসরকারি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানাগুলোও পরিশোধ করছে না বিপুল অংকের বিল। 

এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আদায় হচ্ছে না এমনটি নয়, তবে সেটা হচ্ছে ধীরগতিতে। গ্যাস বিল না দেয়ায় কোম্পানিগুলোকে কঠোর হওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সেটা করা যায় আবার অনেক ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন কঠিন। মূলত মামলাজনিত কারণে বকেয়া আদায়ে বিলম্ব হয়। আবার সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্যাস বিল পরিশোধে নানা জটিলতার কারণে বকেয়া বাড়ছে। জোরালো তৎপরতা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে এসব অর্থ আদায় সম্ভব হচ্ছে না।’

গ্যাস কোম্পানিগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছয়টি কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল)। গ্রাহক শীর্ষে থাকা কোম্পানিটি বকেয়ায়ও প্রথম অবস্থানে। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত তিতাসের বকেয়া ৮ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। এছাড়া বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের বকেয়া ১ হাজার ৭৬৮ কোটি, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ১ হাজার ১১৫ কোটি, জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমস লিমিটেডের ২ হাজার ২০৪ কোটি, সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের ৪৮৬ কোটি ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড তাদের গ্রাহকদের কাছে ২৩৩ কোটি টাকা পাওনা। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত তিতাস গ্যাস সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে ১ হাজার ৩৭ কোটি, বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে ২ হাজার ১৬৭ কোটি, সরকারি সার কারখানার কাছে ২৪৫ কোটি, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে ২ হাজার ৮১ কোটি ও বেসরকারি শিল্প-কারখানার কাছে ১ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা পাওনা। এছাড়া আবাসিক গ্রাহকের কাছে ১ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে বণিক বার্তার পক্ষ থেকে তিতাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। 

তিতাসের মতো বাখরাবাদ গ্যাসেরও সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে ৮৮৫ কোটি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে ১৪২ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এছাড়া সার কারখানায় ৩৬৪ কোটি, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ২৬ কোটি, শিল্প-কারখানায় ২৫ কোটি ও আবাসিক গ্রাহকের কাছে বকেয়া ২৪৬ কোটি টাকা। বাকি বিতরণ কোম্পানিগুলোর বকেয়ারও বড় অংশ সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ক্যাপটিভ পাওয়ার ও আবাসিক গ্রাহকের কাছে পাওনা। বিপুল এ অর্থ আদায়ে বিতরণ কোম্পানিগুলো বিভিন্ন সময়ে অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদ, জরিমানাসহ নানা ধরনের কার্যক্রম চালালেও বকেয়ার পরিমাণ কমেনি বরং বেড়েছে।

দেশে গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল), সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফসিএল) ও বাপেক্স। তিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মূলত বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর কাছে গ্যাস বিক্রি করে। গ্রাহকের কাছ থেকে পাওনা আদায় করতে না পারায় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বকেয়া পরিশোধ করতে পারছে না বিতরণকারী কোম্পানিগুলো।

পেট্রোবাংলার হিসাবে, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বিজিএফসিএলের বকেয়া ৫১৬ কোটি টাকা, যা গত বছরের এপ্রিলে ছিল ৪০২ কোটি টাকা। এসজিএফসিএলের বকেয়া ৬৬১ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ৮৭২ কোটি টাকা। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত বাপেক্সের বকেয়া ৮১৯ কোটি টাকা, যা গত বছরের এপ্রিলেও ছিল ৫৭৯ কোটি টাকা। 

দেশে গ্যাস সঞ্চালন কোম্পানি হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। কোম্পানিটির বকেয়াও ৮৭২ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এছাড়া বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএমসিএল) বকেয়া বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১৫ কোটি টাকায়। কোম্পানিটি দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ার খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের পাশাপাশি বিক্রিও করে। 

দেশে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে সরকার বিভিন্ন সময়ে উচ্চমূল্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে এ গ্যাস সরবরাহ দিলেও সঠিক সময়ে টাকা আদায় করতে পারেনি বিতরণ কোম্পানিগুলো। এলএনজি আমদানির জন্য নানা সময়ে অর্থের সংস্থান করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে জ্বালানি বিভাগকে। যদিও গ্যাসের বকেয়া আদায়ে এখন কঠোর অবস্থানে রয়েছে জ্বালানি বিভাগ। গ্যাস বিল না দিলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন, অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদসহ জরিমানা আদায় কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এর পরও বকেয়া বেড়ে চলার পেছনে যথাযথ তদারকির অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, বকেয়া আদায়ে কঠোর অবস্থান ও জোরালো অভিযান থাকলে এ অর্থের অনেকটাই আদায় করা সম্ভব।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বকেয়া বিল আদায়ে গ্যাস কোম্পানিগুলোর অনীহা, একই সঙ্গে সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। এছাড়া বকেয়ার বড় অংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আওতায়। এ বিল আদায়ে রয়েছে পদ্ধতিগত জটিলতা। গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বড় সংকট অর্থ। ফলে বকেয়া আদায়ে আরো কঠোর হওয়া উচিত। তাহলে কোম্পানিগুলোও আর্থিকভাবে শক্তিশালী হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন