
দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে না। এতে খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির আঘাত, সে সঙ্গে ভবিষ্যতে খাদ্য ব্যবস্থাপনায় সংকটের শঙ্কা দেখা দিচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ফসলের উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। সেই সঙ্গে মধ্যস্থতাভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষক যেন ফসলের ন্যায্যমূল্য পান সেটিও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি কৃষকের জন্য ভর্তুকি মূল্যে হলেও সারের ব্যবস্থা করতে হবে।
বণিক বার্তায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, দেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে সে অনুপাতে খাদ্যশস্য উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। কোনো কোনো ফসলের ক্ষেত্রে এ হার নেতিবাচক। উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের অভাব, কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এবং সে অনুপাতে কৃষকের আয় না হওয়াসহ নানা কারণ কৃষি উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এ পরিস্থিতি বজায় থাকলে বৈশ্বিকভাবে কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে, তখন দেশের খাদ্য ব্যবস্থাপনায় বড় ধাক্কা আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও কভিডকালে কৃষি খাত ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানেও নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষকে বেশ ভোগাচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি।
বস্তুত ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির কারণে দেশে আবাদি জমি বেড়েছে। সে কারণে কৃষিতে উৎপাদনও বেড়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে খাদ্যের উৎপাদনশীলতা খুব বেশি বাড়ছে না। এজন্য নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি জলবায়ুসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ চীন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের উৎপাদনশীলতা অনেক বেশি। দেশগুলো কীভাবে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে আমাদের দেশে তা অনুসরণ করা উচিত। তাছাড়া ফসলের নিবিড়তা তো আর খুব বেশি বাড়ানো যাবে না। সে কারণে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে মনোযোগ দিতে হবে। আবার খাদ্য উৎপাদন বাড়লেও আমাদের আমদানিনির্ভরতা কমছে না। এটিকে আমলে নিতে হবে। অন্যদিকে উৎপাদনের সার্বিক তথ্যও যথাযথ ফুটে ওঠে না। ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তথ্যে বড় ধরনের গরমিল দেখা যায়। যে কারণে সঠিক নীতি গ্রহণে প্রভাব পড়ে।
এছাড়া প্রধান খাদ্যশস্য চালের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া হলেও এর বাইরের শস্যগুলোর দিকে কম নজর দেয়া হচ্ছে। এতে পুষ্টিকর খাদ্যের উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণকারী খাদ্য গম, আলু, ডাল, সবজি, মাংস, ডিম ও মিঠাপানির মাছ উৎপাদন চাহিদা অনুযায়ী বাড়ছে না। তবে চাল আমদানি শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার পরিকল্পনা হলেও তা পরবর্তী সময়ে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। কৃষি খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের ফসলি জমি কম। ফলে সব ধরনের খাদ্যশস্য উৎপাদনে সমানুপাতিক উন্নতি হবে না। কিছু খাদ্য আমদানি করতে হবে। কিন্তু আমদানি কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, সে লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণও জরুরি।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু জমিস্বল্পতায় প্রধান ফসলের বাইরে একটির উৎপাদন বাড়লে অন্যটির উৎপাদন কমবে, এটি খুব স্বাভাবিক। তবে এর উপকারিতাও মিলছে। আগে বিভিন্ন সবজি শুধু শীতকালেই পাওয়া যেত, এখন সারা বছরই পাওয়া যায়।
কৃষি খাতে প্রণোদনা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এত দিন দেশের কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি চালনির্ভর ছিল। সরকারের সব প্রণোদনা ও অবকাঠামোগত সহায়তা ছিল চালমুখী। ফলে চালের উৎপাদন বেড়েছে। পাশাপাশি সবজি, ফল ও মাছের উৎপাদন বাড়লেও তা চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। কারণ, এ খাতে সরকারের সহায়তা কম মিলেছে।
খাদ্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি পর্যায়ক্রমেই কমেছে। তাই দেশের কৃষি উৎপাদনের বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যতে তা কী দাঁড়াবে, তার পূর্বাভাস আমলে নিয়ে করণীয় ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে। আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চফলনশীল ভালো ভালো জাত উদ্ভাবন করছে, এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। কৃষি ক্ষেত্রে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে কৃষকবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। কোনো কৃষক যেন ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত না হন সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে কৃষির অবদান বাড়াতে হবে। এজন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি ও প্রণোদনা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) তথ্যমতে, বাংলাদেশ একটি স্বল্প ভূমির দেশ যেখানে মাথাপিছু আবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ মাত্র ১৫ শতক। পাশাপাশি প্রতি বছর প্রায় ১ শতাংশ হারে কৃষিজমি অকৃষিজ জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। যদি এ হারে কৃষিজমি অকৃষিজ কাজে ব্যবহার অব্যাহত থাকে তাহলে তা নিশ্চিতভাবেই কৃষি খাতের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে এবং ভবিষ্যতে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্যনিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে। কৃষিজমির এরূপ অকৃষিকাজে ব্যবহার হওয়ার বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে কী কী কারণে এ ধরনের রূপান্তর ঘটছে তা খতিয়ে দেখা উচিত। এক্ষেত্রে বিগত বছরগুলোয় পরিচালিত বিভিন্ন কৃষিশুমারি ও জরিপ হতে প্রাপ্ত তথ্যগুলোর নিরিখে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। আমরা প্রত্যাশা করব কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে কৃষি খাত সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। এজন্য খাদ্যনিরাপত্তা জোরদারে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, সেটিই সবার কাম্য।