এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যুগে বাংলাদেশ

শামীম রাহমান

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাওলা-বিমানবন্দর অংশ উদ্বোধন করবেন। এ অংশে যানবাহন চলাচল শুরু হবে আগামীকাল সকাল ৬টা থেকে।

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) এক্সপ্রেসওয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে সরকারের সেতু বিভাগের অধীনে। সংস্থার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সার্বিকভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজীকরণ, আধুনিকায়ন করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখবে এ উড়ালপথ। অন্যদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল জানান, ঢাকার যানজট নিরসনে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে এক্সপ্রেসওয়ে।

সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হলে ঢাকা শহরে আরো প্রায় ৪৭ কিলোমিটার নতুন সড়ক যোগ হবে। বিমানবন্দর, কুড়িল, মহাখালী, তেজগাঁও, মানিক মিয়া এভিনিউ, পলাশী, সোনারগাঁও মোড়, অতীশ দীপংকর সড়ক, মতিঝিলসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকার মানুষ এ এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করতে পারবে। যানজটের কারণে বর্তমানে যে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি ও কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে তা অনেকটাই কমে যাবে।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হচ্ছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত। এক্সপ্রেসওয়ের গতিপথের একটি বড় অংশ পড়েছে বিমানবন্দর-কমলাপুর রেলপথ বরাবর। এক্সপ্রেসওয়েটির নির্মাণকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল করিডোরের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। আর এ মূল করিডোরে প্রবেশ এবং বের হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে ৩১টি র‍্যাম্প। এর মধ্যে ১৫টি র‍্যাম্প এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার জন্য। আর নামার র‍্যাম্প বা পথ ১৬টি।

ঢাকার বিমানবন্দর/কুর্মিটোলা, কুড়িল ইন্টারচেঞ্জ, আর্মি স্টেডিয়াম, সৈনিক ক্লাব, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ এভিনিউ, বিজয় সরণি, সোনারগাঁও মোড়, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, শনির আখড়া এবং পলাশী মোড় থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠবে যানবাহন। বিপরীতে বিমানবন্দর/কুর্মিটোলা, কুড়িল ইন্টারচেঞ্জ, সেনানিবাস, আর্মি স্টেডিয়াম, সৈনিক ক্লাব, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ এভিনিউ, সোনারগাঁও মোড়, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, শনির আখড়া, ইন্দিরা রোড এবং পলাশী মোড় দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে যানবাহন বের হবে।

প্রকল্পটি নির্মাণে করা সমীক্ষা অনুযায়ী, পুরোদমে চালু হওয়ার পর প্রতিটি ওঠানামার র‍্যাম্প দিয়ে ঘণ্টায় ৯০০ ইউনিট যানবাহন চলতে পারবে। সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, এ এক্সপ্রেসওয়েতে প্রাইভেট কার-জিপের মতো হালকা যানবাহন, বাস ও ট্রাক চলাচল করবে। দুই ও তিন চাকার যানবাহনকে এক্সপ্রেসওয়েটি ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।

আগামীকাল উদ্বোধন হতে যাওয়া ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাওলা-ফার্মগেট অংশের জন্য টোলহার ঘোষণা করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। কার, ট্যাক্সি, জিপ, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকল, মাইক্রোবাস (১৬ সিটের কম) এবং হালকা ট্রাকের (তিন টনের কম) জন্য ৮০ টাকা টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। মাঝারি ট্রাকের জন্য (ছয় চাকা পর্যন্ত) টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২০ টাকা। বড় ট্রাকের (ছয় চাকার বেশি) টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০০ টাকা। আর সব ধরনের বাসের (১৬ সিটের বেশি) টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬০ টাকা।

কাওলা-ফার্মগেট অংশের যে টোলহার নির্ধারণ হয়েছে তা সাময়িক। পুরো এক্সপ্রেসওয়ে চালুর পর হালকা শ্রেণীর যানবাহনের জন্য সর্বনিম্ন টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ টাকা। এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার পর শেষ পর্যন্ত না গেলে হালকা শ্রেণীর যানবাহন থেকে এ পরিমাণ টোল আদায় করা হবে। অন্যদিকে এক্সপ্রেসওয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যবহার করা হালকা যানবাহন থেকে টোল আদায় করা হবে ১২৫ টাকা। হালকা শ্রেণীর যানবাহনকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল আদায়ের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে। এ ভিত্তি টোলের দ্বিগুণ টোল আদায় করা হবে বাস থেকে। একইভাবে ভিত্তি টোলের চার গুণ টোল নির্ধারণ করা হয়েছে মাঝারি (ছয় চাকা পর্যন্ত) ট্রাকের জন্য। বড় ট্রাকের জন্য (ছয় চাকার বেশি) টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ভিত্তি টোলের পাঁচ গুণ। যদিও এ টোলহার পরিবর্তন হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা।

এক্সপ্রেসওয়ের অর্ধেকের বেশি অংশ চালুর ফলে বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট যাতায়াতে এখন ১০ মিনিট সময় লাগবে বলে মন্তব্য করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গতকাল তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট-তেজগাঁও রেলস্টেশন পর্যন্ত ১০-১১ মিনিটে কভার করবে। এখানে অনেক যাত্রী আসা-যাওয়া করবে। এর সুফল অবশ্যই পাবে রাজধানীবাসী।’

সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ৬৫ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে। এখন যে অংশ উদ্বোধন হচ্ছে না, সেখানেও অনেক কাজ হয়ে গেছে। আমরা আশা করছি, ২০২৪ সালের মধ্যে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পুরোটা চালু করতে পারব।’

তিনটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে নির্মাণ করছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প। এর মধ্যে ইতালথাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেডের ৫১ শতাংশ, চীনা শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপের ৩৪ এবং সিনোহাইড্রো করপোরেশনের শেয়ার ১৫ শতাংশ। এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণ ও নির্মাণ-পরবর্তী পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণে ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (এফডিইই) কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি গড়ে তুলেছে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। নির্মাণ-পরবর্তী সাড়ে ২১ বছর টোল আদায়ের মাধ্যমে মুনাফাসহ বিনিয়োগ করা অর্থ তুলে নেবে প্রতিষ্ঠান তিনটি। চীনা এক্সিম ব্যাংক ৪৬১ মিলিয়ন ডলার এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না (আইসিবিসি) ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে বিনিয়োগকারীদের।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের গতিপথের সিংহভাগই পড়েছে বিমানবন্দর-কমলাপুর রেলপথ বরাবর। এর বাইরেও বিমানবন্দর-বনানী, বনানী-তেজগাঁও ও মগবাজার-কুতুবখালী এলাকায় অধিগ্রহণ করা হয়েছে ২২০ একর জমি। জমি অধিগ্রহণের ফলে যেসব ব্যক্তি ও পরিবার স্থানচ্যুত হয়েছে, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে সরকার। এজন্য সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নামে আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য উত্তরায় ১ হাজার ২৪৮টি ফ্ল্যাট তৈরি করে দেয়া হচ্ছে। ২০২৪ সালের জুনে এ প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

ঢাকা-এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে যুক্ত করে বিমানবন্দর থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত আরেকটি এক্সপ্রেসওয়ে গড়ে তুলছে সরকার। এ দুই এক্সপ্রেসওয়ে পুরোপুরি চালু হলে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কসহ দেশের সবক’টি জাতীয় মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হবে। ঢাকার সঙ্গে ৩০টি জেলার সংযোগ স্থাপনকারী আব্দুল্লাহপুর-আশুলিয়া-বাইপাইল-চন্দ্রা করিডোরে যানজট অনেকাংশে হ্রাস পাবে। সামগ্রিকভাবে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার দশমিক ২১৭ শতাংশ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন