এডিস মশা দমনে সীমাবদ্ধতা ও করণীয়

এডিস মশা দমনে সীমাবদ্ধতা ও করণীয়

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

এডিস মশার আক্রমণে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা মৃত্যুহার লাগামহীনভাবে বাড়ছে। ২০০০ সালে যখন এডিস ডেঙ্গুর আবির্ভাব হয়েছিল তখন থেকেই যদি আইভিএম বা সমন্বিত বাহক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো তাহলে এমন ভয়াবহ দিন দেখতে হতো না। জেনে নিন এডিস নামক একটি ক্ষুদ্র পতঙ্গ দমনে আমরা কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি এবং সেগুলোর সময়োপযোগী সমাধান কী হতে পারে?

. ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অতিদ্রুত নগরায়ণ হয়েছে। সময়ে নির্মাণাধীন ভবনের নিচে জমে থাকা পানি যেভাবে এডিসসহ অন্যান্য মশার প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে তার তুলনায় মশক ব্যবস্থাপনা শুধু অপ্রতুলই নয়, বরং খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার সমতুল্য।

. যেকোনো জনসংযোগস্থলে খাবারের জন্য ব্যবহৃত প্লাস্টিকের প্যাকেট পানীয় ক্যান ব্যবহারের পর যেনতেনভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখার অভ্যাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থাপনা একেবারেই ঠুনকো স্বল্প। তাই সিডিসির বর্ষাপূর্ব জরিপে প্লাস্টিক প্যাকেট ক্যান এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্রের তালিকায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

. ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অধীন সব থানা, পুলিশ স্টেশনে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে আইনের গ্যাঁড়াকলে আবদ্ধ পুরনো ডাম্পিং গাড়ি এডিস মশার অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যময় প্রজননস্থল। এসব জায়গায় বিগত দুই যুগের ব্যবধানে এডিস মশা শুধু বংশ বৃদ্ধিই করেনি, হয়ে উঠেছে অনেক হৃষ্টপুষ্ট আক্রমণাত্মক।

. ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত যতগুলো ড্রেনেজ ডিচেস বন্ধ করে ইমারত তৈরি করা হয়েছে তার বেশির ভাগই পানি জমার স্থান বাড়িয়ে দিয়েছে। বন্ধ করে দিয়েছে পানি চলাচলের চ্যানেল। এগুলো লেকের পানিতেও দূষণ তৈরি করে জন্ম দিয়েছে অসংখ্য রোগজীবাণুর। মারাত্মকভাবে প্রকৃতির খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে সৃষ্টি করেছে সাংঘাতিক পরিবেশ দূষণ।

. বিগত দুই যুগে ঢাকা শহরে যে পরিমাণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই তুলনায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কতটা প্রশস্ত হয়েছে? এর ফলেও মশাসহ অন্যান্য জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পোকামাকড় জীবাণুর অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে।

. যদি সঠিক পরিমাণে, সঠিক স্থানে সঠিক সময়ে কীটনাশকের ব্যবহার না হয় তাহলে তার প্রভাব যে কত বড় হতে পারে তা এখন আমরা টের পাচ্ছি। উপর্যুপরি কীটনাশক ব্যবহারে এডিস মশা প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। কীটনাশক পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব তৈরি করে, প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে বাড়াচ্ছে পরিবেশ দূষণ। এমনকি এভাবে কীটনাশকের ব্যবহার মানুষসহ অন্যান্য জীবের ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হ্রাস করে সৃষ্টি করছে ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ এমনকি ক্যান্সারের মতো স্থায়ী রোগ।

. বর্ষাকালে এডিস মশার প্রজননস্থল সম্প্রসারণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে রাস্তা কাটাকাটি, পাইপ বসানো বা সুয়ারেজ লাইনের কাজ।

. বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানা কত দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে তা আমাদের অজানা নয়। শিল্পের বর্জ্য আশপাশের জলাশয়ে পড়ে ভয়ংকরভাবে পানি দূষিত করে চলেছে।

. দ্রুত নগরায়ণের ফলে একদিকে বনায়ন ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে নগরায়ণের কারণে সৃষ্টি হওয়া বায়ুদূষণে অসুস্থ হচ্ছে অনেকে। এর ফলে মশাসহ রোগজীবাণু বহনকারী পোকামাকড়ের অভয়ারণ্য তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন।

মশা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এগুলো হচ্ছে আমাদের চ্যালেঞ্জ। সেগুলো কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে সেগুলোও আলোচনায় আনতে হবে।

. তথ্য বিশ্লেষণ করে পরিসংখ্যান অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে নির্মাণাধীন ইমারতের নিচতলায় কেমন মশক নিধন পদ্ধতি প্রয়োজন হবে। প্রয়োজন হলে রিহ্যাবের সঙ্গে সমন্বয় করে অ্যাডাল্টিসাইড, লার্ভিসাইড প্রয়োগের পাশাপাশি গাপ্পি মাছ, ব্যাঙ ইত্যাদি প্রাকৃতিক জীব চাষ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

. জনসংযোগ, সেমিনার, জনসভা প্রভৃতিতে ব্যবহৃত প্লাস্টিক প্যাকেট ক্যান অবশ্যই একত্র করে ধ্বংস করতে হবে।

. যেসব পরিত্যাক্ত গাড়ি এডিস মশার উৎপত্তিস্থল হিসেবে কাজ করছে সেগুলো অতিদ্রুত অপসারণ করতে হবে। তা সম্ভব না হলে নিয়মিত লার্ভিসাইড অ্যাডাল্টিসাইড প্রয়োগ করে এবং জমে থাকা পানি পরিষ্কার করে এডিসমুক্ত রাখতে হবে।

. ঢাকা শহরের দখল হয়ে যাওয়া খাল পুনরুদ্ধার করে পানি চলাচলের সুব্যবস্থা করতে হবে।

. অতি ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সঠিক যথাযথভাবে করতে হবে। বর্জ্য অপসারণ কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রোগজীবাণু ছড়ানো এর ভয়াবহতা সম্পর্কে পরিষ্কার জ্ঞান করণীয় শিক্ষা দিতে হবে। সম্ভব হলে শহর থেকে অনেক দূরে নিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে। এক্ষেত্রে বায়োপ্লান্ট স্থাপন করে রি-সাইক্লিং পদ্ধতিতে বায়োফার্টিলাইজার তৈরি করে দেশের চাষের মাটির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে এবং অতিরিক্ত বায়োফার্টিলাইজার প্যাকেটজাত করে বিদেশে রফতানি করা যেতে পারে।

. কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার না করে সমন্বিত বাহক ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী দিয়ে সঠিক স্থান, পরিমাণ সঠিক সময়ে প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি নিয়মিত মনিটর করতে হবে।

. সরকারের উন্নয়মূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান সমন্বিতভাবে কাজ করলে মশা উৎপাদনের জন্য পানি জমে থাকবে না, তেমনি জনদুর্ভোগ লাঘব হবে।

লেখক: অধ্যাপক বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ

জাতীয় প্রতিষেধক সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) মহাখালী, ঢাকা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন