বিভিন্ন জায়গায় দেখা দিচ্ছে প্রাদুর্ভাব

ডায়রিয়া রোগীদের নমুনায় মিলছে কলেরার জীবাণু

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

ডায়রিয়ার প্রকোপে আইসিডিডিআর,বির মহাখালী হাসপাতালে বেড়েছে রোগীর চাপ ছবি: ফাইল/নিজস্ব আলোকচিত্রী

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। চলতি সপ্তাহে রাঙ্গামাটিতে ডায়রিয়ায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিভিন্ন জেলায় যারা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে তাদের মধ্যে কলেরার জীবাণু পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে সারা দেশে কলেরার জীবাণু ছড়িয়ে পড়ায় আশঙ্কা করছেন রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নিয়ন্ত্রণে থাকা কলেরা আবারো মারাত্মক আকার ধারণের শঙ্কা তৈরি করেছে। কোথাও কোথাও প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। 

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ও বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের শুরু থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ডায়রিয়ার রোগী বেড়েছে। গত এপ্রিল ও মে মাসে এটি অস্বাভাবিক হতে থাকে। আইইডিসিআর থেকে রোগতত্ত্ববিদের সমন্বয়ে গঠিত পরিদর্শক দল সেসব জেলা পরিদর্শন করে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর মলের নমুনা সংগ্রহ করে। গত মে মাসে চট্টগ্রাম ও যশোর থেকে পাওয়া নমুনায় কলেরার জীবাণু ভিব্রিও কলেরি পাওয়া যায়।

রোগতত্ত্ববিদরা ডায়রিয়া ও কলেরার পার্থক্যের বিষয়ে বলছেন, ডায়রিয়ার একটি মাত্রা হলো কলেরা, যার জীবাণু সাধারণত অপরিচ্ছন্ন খাবার বা দূষিত পানি থেকে আসে। দৈনিক তিনবার অথবা এর বেশি পাতলা পায়খানা হলে তাকে ডায়রিয়া বলা হয়। যদি ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া ও রোটাভাইরাসের কারণে হয় তাহলে ওই ডায়রিয়ার আলাদা কোনো নাম নেই। ভিব্রিও কলেরি ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকলে তখন তাকে কলেরা বলা হয়। শিগেলা ব্যাকটেরিয়ার কারণে আমাশয় হয়। আবার ডায়রিয়াও হতে পারে। ডায়রিয়া ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের কারণে হলেও ফাঙ্গাসের কারণে হয় কিনা সে তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। কলেরা খুব দ্রুত দেহকে পানিশূন্য করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। মাত্র ২-৩ ঘণ্টায় আক্রান্তের মৃত্যুও হতে পারে। 

যশোর সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর এ জেলায় ৬ হাজার ৮৯৩ জন ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। সাত উপজেলার মধ্যে বাঘারপাড়ায় সর্বোচ্চ দেড় হাজারের মতো রোগী পাওয়া গেছে। রোগীর সংখ্যায় এরপর রয়েছে চৌগাছা ও মণিরামপুর উপজেলা। গত মাসে আইইডিসিআরের রোগতত্ত্ব গবেষণা দল উপদ্রুত অঞ্চল পরিদর্শন করে। তারা জেলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের রোগীদের তথ্য-উপাত্ত যাচাই করেন। ডায়রিয়া ওয়ার্ড থেকে ১৩ জন রোগীর মলের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেন। এসব নমুনার মধ্যে আটটিতে কলেরার জীবাণু ভিব্রিও কলেরি পাওয়া যায়। আইইডিসিআর যশোরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পানীয়জলের নমুনাও সংগ্রহ করে। 

ডায়রিয়া ও কলেরার বিষয়টি আমলে নিয়ে জেলার রোগতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসকের সমন্বয়ে একটি দল প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন যশোরের সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘উপদ্রুত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে খাওয়ার স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসার সব ব্যবস্থা রয়েছে।’

রাঙ্গামাটির সাজেক ইউনিয়নে তিনদিন আগে দুজনের মৃত্যু হয়। জেলার সিভিল সার্জন ডা. বিপাশ খীসা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘একজনের ডায়রিয়া ছিল, তবে অন্যজনের হয়তো বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে। দুর্গম হওয়ায় সাজেক ইউনিয়ন থেকে ওই1এলাকায় হেঁটে পৌঁছতে সময় লাগে দেড়-দুদিন। খবর পাওয়ার পর পরই হেলিকপ্টারে করে একটি দল পাঠানো হয়। দলটি ফিরে এলে বাস্তব চিত্র বলা যাবে। গত কয়েক বছরে ডায়রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে এমনটি রাঙ্গামাটিতে দেখা যায়নি। তাদের কলেরা ছিল কিনা তা পরীক্ষা শেষে বলা যাবে।’

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) ঢাকা হাসপাতালের প্রধান ডা. বাহারুল আলম বণিক বার্তাকে জানান, তার হাসপাতালে সাধারণত দিনে গড়ে প্রায় ৪০০ রোগী থাকে, সেখানে গত মে মাসের শেষ থেকে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে সাতশর বেশি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী আসছে। ১৫ দিন পরপর রোগীদের মলের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। সর্বশেষ পরীক্ষায় ৯ দশমিক ৭ শতাংশের মধ্যে কলেরার জীবাণু পাওয়া গেছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘আক্রান্ত রোগীর ব্যবহৃত বিছানা ও কাপড় থেকে রোগটি ছড়াতে পারে। কয়েক মাস ধরে দেশে অতিরিক্ত তাপপ্রবাহ ও জলাধারে পানি কমে যাওয়ার কারণে কলেরা দেখা দিয়েছে। কোনো জলাধারে কলেরা জীবাণু থাকলে সে পানি কমে গেলে পরবর্তী সময়ে সেখানে জীবাণুর ঘনত্ব বাড়ে। মাটির নিচের পাইপলাইনে ছিদ্র থাকলেও সরবরাহকৃত পানিতে জীবাণু ছড়িয়ে যায়। নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) বলছে, কলেরা হলো একটি তীব্র ডায়রিয়াজনিত রোগ, যা বিষাক্ত ব্যাকটেরিয়া ভিব্রিও কলেরি সেরোগ্রুপ ও১ বা ও১৩৯ দ্বারা অন্ত্রের সংক্রমণের কারণে ঘটে। যারা কলেরায় আক্রান্ত হয় তারা এর জন্য সাধারণত কোনো হালকা বা মধ্যম পর্যায়ের লক্ষণের মধ্যে পড়ে না। তবে খুব অল্প সময়ে গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে। প্রতি ১০ জন রোগীর মধ্যে একজনের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়। এসব ব্যক্তির দ্রুত পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন হয়ে শক বাড়ে। দ্রুত চিকিৎসা দেয়া না হলে মাত্র ১ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হয় কলেরায়।

দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডায়রিয়ার রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং কোথাও কোথাও মৃত্যুর ঘটনাকে প্রাদুর্ভাব বলছেন রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সময়, জায়গা ও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পরিপ্রেক্ষিতে কোথাও অস্বাভাবিক অসুস্থের সংখ্যা বা মৃতের সংখ্যা হলে তাকে আউটব্রেক বা প্রাদুর্ভাব বলা যায়। আউটব্রেক স্থানীয় পর্যায়ে হয়। যদি এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ছড়িয়ে পড়ে তাহলে আমরা এপিডেমিক (জেলা থেকে জেলায় বা দেশের মধ্যে স্থানীয় বৃহৎ পরিসরের সংক্রমণ) বলা যায়। আর দেশ থেকে দেশান্তরি হলে সেটাকে প্যানডেমিক (মহামারী) বলা হয়।

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কলেরা জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় সমস্যা। মহামারী আকার ধারণ করার আশঙ্কাও একেবারে বাদ দেয়া যায় না। অর্থাৎ এটা পরিবর্তিত হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লেই প্যানডেমিক। সময়মতো কলেরা শনাক্ত করতে পারলে মৃত্যু কম হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে মহামারী আকারে কলেরা ছড়িয়েছে। বিশেষ করে আফ্রিকার কয়েকটি দেশে কালেরায় বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশে ওআরএস বা ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট (ওর‍স্যালাইন বা খাওয়ার স্যালাইন) থাকার পরও যদি এটা ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে আমাদের বাসি বা পচা খাবারের উৎস নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। আমাদের সামাজিক পরিবেশ ভালো না, পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়ছে। গত বছরও কলেরা বড় আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল, এর ফলে টিকা দিতে হয়েছিল।’

তার মতে, গভীর নলকূপের পানি মানুষ পান করলেও খোলা স্থানের দূষিত পানি দিয়ে রান্নার কাজ করছে। অজু ও গোসলে ব্যবহার করছে। এভাবে শরীরে রোগ-জীবাণু ঢুকে যাচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায়ে সতর্কতার সঙ্গে সামাজিক ও সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া দরকার। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মানুষকে বাইরের খাবারের ওপর অনেক নির্ভর করতে হয়। যদিও বাইরে খাবার খাওয়াটা বিলাসিতা না, বরং প্রয়োজন। বাইরে যারা খাবার বিক্রি করছে তারা যেন নিরাপদে খাবার তৈরি এবং পরিবেশন করতে পারে সেদিকটা নিশ্চিত করতে হবে।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের কার্যালয় বণিক বার্তাকে জানিয়েছে, চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত জেলায় সাড়ে আট হাজার ডায়রিয়া রোগী পাওয়া গেলেও গত মাসে রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ ছিল। প্রায় পাঁচ হাজার রোগী পাওয়া যায় ওই মাসে। বিশেষ করে জেলার বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা, চন্দনাইশ ও সদরে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। জেলার রোগীদের মলের ৩০টি নমুনা পরীক্ষা করে তার মধ্যে ছয়টিতে ভিব্রিও কলেরি পাওয়v গেছে।

তবে জেলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। তার মতে, স্বাভাবিকের তুলনায় ‍কিছু রোগী গত মাসে বেশি হলেও পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। তবে অন্যান্য উপজেলায় স্বাভাবিক হতে আরো কিছুটা সময় লাগবে। কোনো কোনো বাড়িতে একজন বা দুজন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। কোনো এলাকা বা পাড়ায় অনেক বেশি রোগী আক্রান্ত হলে বিষয়টিকে প্রাদুর্ভাব বলা যেত। 

কলেরার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলেছে, বছরে বিশ্বব্যাপী ১৩ থেকে ৪০ লাখ মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়। যাদের মধ্যে ২১ হাজার থেকে দেড় লাখের মৃত্যু হয়। কলেরা ও অন্যান্য পানিবাহিত রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নিরাপদ পানির অভাবে দেশের কোথাও কোথাও ডায়রিয়া দেখা গেছে। তবে আউটব্রেক হয়নি। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ ও বৃষ্টি না হাওয়ার কারণে নিরাপদ পানির সংকটে এমনটি হয়েছে। যেসব এলাকায় ডায়রিয়ার রোগী পাওয়া যাচ্ছে সেসব এলাকায় বিশেষ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন