বিশ্লেষণ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অদেখা ভুবন কীভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে

কৌশিক বসু

নীতিনির্ধারকদের মানিয়ে নেয়ার নতুন কোনো পথ বের করার আগেই প্রযুক্তি দ্রুততার সঙ্গে বিশ্বকে পরিবর্তন করে চলেছে। ফলস্বরূপ, সমাজে মেরুকরণ গড়ে উঠছে, বৈষম্য বাড়ছে, কর্তৃত্ববাদী শাসনের দেখা মিলছে এবং গণতন্ত্রকে অগ্রাহ্য করে করপোরেশনগুলো কৌশলে বাস্তবের সত্যকে বিকৃত করছে নিজ স্বার্থে।

সাধারণ মানুষের ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে—যেমনটা ওপেনএআইয়ের সিইও স্যাম আল্টম্যান সম্প্রতি বলেছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশাল অগ্রগতি যা শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, যুদ্ধ এবং অন্যান্য ঝুঁকি সম্পর্কে উদ্বেগপূর্ণ ভাবনা বাড়িয়ে তুলেছে, যা সভ্যতার ধারাকে জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক আগেই অস্থিতিশীল করতে পারে। স্যাম আল্টম্যান কৃতিত্ব পাবেন এ জায়গায়, কারণ তিনি এরই মধ্যে আইনপ্রণেতাদের তার এআই শিল্পে আইনি নিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানিয়েছেন।

এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের অবশ্যই দুটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। প্রথমটি হলো, আমাদের দ্রুতগতিতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা। আমরা যদি বেশি সময় নিই, তাহলে অবস্থা অনেকটা ঘোড়া পালানোর পর দরজায় তালা দেয়ার মতো হবে। ১৯৬৮ সালের পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তির ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটেছিল—২৩ বছর পর যা সম্পন্ন হয়। আমরা যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ন্যূনতম কিছু নিয়ম প্রতিষ্ঠা করতে পারতাম তাহলে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হতো। 

আরেকটি উদ্বেগ লুকিয়ে আছে এর গভীর অনিশ্চয়তার ভবিষ্যতে। এটি এমন এক নতুন জগৎ, যেখানে যারা এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করছেন, তারা নিজেরাই জানেন না যে তাদের এ আবিষ্কারগুলো শেষ পর্যন্ত আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে। সর্বোত্তম উদ্দেশ্য নিয়ে প্রণীত আইনও এখানে হিতে বিপরীত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা যখন দেশের সাধারণ মানুষের অস্ত্র রাখা এবং তা বহনের অধিকার প্রদানের জন্য সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর খসড়া তৈরি করেছিলেন, তখন তারা জানতেন না যে ভবিষ্যতে আগ্নেয়াস্ত্র প্রযুক্তি কীভাবে বিবর্তিত হবে, যার ফলে ‘অস্ত্র’ শব্দটির অর্থই পরিবর্তিত হয়। এমনকি তাদের পরবর্তী বংশধররাও অস্ত্রের এমন পরিবর্তন দেখার পরও তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হবে—সে ব্যাপারে তারা হয়তো কোনোদিন কল্পনাও করেনি।

কিন্তু অনিশ্চয়তা কোনোভাবেই নিয়তিবাদী দর্শনকে ন্যায্যতা দেয় না। নীতিনির্ধারকরা এখনো এমন অদেখা জগৎকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, যদি তারা কিছুটা বিস্তৃত চিন্তা ও বিবেচনা নিজেদের মাথায় রাখেন। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে সিনেট কমিটির শুনানির সময় উঠে আসা একটি প্রস্তাব হলো—একটি লাইসেন্সিং সিস্টেম তৈরি করা যার মাধ্যমে কেবল নির্বাচিত করপোরেশনগুলোকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই নিয়ে কাজ করার অনুমতি দেয়া হবে।

যদিও এ পদ্ধতির নিজস্ব কিছু সুস্পষ্ট ঝুঁকি রয়েছে। লাইসেন্সিং প্রায় সময় ক্রোনিজম দিকের একটি পদক্ষেপ হতে পারে। সুতরাং রাজনীতিবিদদের সিস্টেমের অপব্যবহার থেকে বিরত রাখতে আমাদের নতুন আইনেরও প্রয়োজন হবে। উপরন্তু, অতিরিক্ত প্রতিবন্ধকতা দিয়ে আপনার দেশের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের বিকাশকে ধীর করার মানে এই নয় যে অন্যরাও নিজেদের দেশের ক্ষেত্রে অনুরূপ ব্যবস্থা নেবে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে আপনি নিজে এমন প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে পারেন যে ওই ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে যা আপনি এড়িয়ে চলছিলেন। এ কারণেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইকে সর্বোত্তমভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব যদি তা বহুপক্ষীয়ভাবে করা হয়, যদিও আজকের বিশ্বের প্রেক্ষাপটে এর জন্য দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।

আরেকটি বড় উদ্বেগের বিষয় হলো শ্রম। ঠিক যেমন অতীতের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি শ্রমিকদের কায়িক শ্রমের চাহিদা কমিয়েছে, তেমনি চ্যাটজিপিটির মতো নতুন প্রোগ্রাম প্রচুর পরিমাণের হোয়াইট-কলার কর্মচারীদের (এমন কর্মচারী যারা পেশাদার, ডেস্ক, ম্যানেজারিয়াল বা প্রশাসনিক কাজ করে থাকে) চাহিদা কমিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এর সম্ভাব্যতা নিয়ে এত উদ্বেগী হওয়ার দরকার নেই। আমরা যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে উৎপাদিত সম্পদ ও আয়কে সমানভাবে সবার মধ্যে ভাগ করে দিতে পারি তাহলে অনেক কর্মপদ হারিয়ে যাওয়ার সমস্যাটি কোনো বড় বিষয় হবে না। তখন দেখা যাবে, কাজ না করে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পরিবর্তে সামন্ত প্রভুদের অবকাশের পরিমাণ বেড়েছে। 

মূলত সমস্যা হচ্ছে, বেশির ভাগ মানুষ জানে না কীভাবে তাদের অবসর সময় ব্যবহার করতে হয়। যেমন পেনশনভোগীরা প্রায়ই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন, কারণ তারা জানেন না যে তাদের হাতে থাকা অজস্র সময়ে তাদের কী করতে হবে। এখন একবার ভেবে দেখুন, এমনটা যদি বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঘটে তাহলে কী হবে? সঠিকভাবে নজর না থাকলে অপরাধ, সংঘাত ও উগ্রবাদীর সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে। এমন পরিণতি এড়ানোর জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে যাতে মানুষের অবসরকালীন সঞ্চিত শক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। অনেকটা পূর্ববর্তী যুগের মতো, যেখানে শিক্ষার অর্থ ছিল শৈল্পিক সত্তার বিকাশ ঘটানো, শৌখিন মনন তৈরি করা এবং সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তাভাবনার মাধ্যমে কীভাবে জীবন উপভোগ করতে হয় তা শেখানো। 

অন্যতম প্রধান উদ্বেগের বিষয়টি মিডিয়া ও সত্যের সঙ্গে জড়িত। নোবেল বিজয়ী সাংবাদিক মারিয়া রেসার তার ‘হাউ টু স্ট্যান্ড আপ টু আ ডিক্টেটর’ শিরোনামের বইয়ে আফসোস করে বলেছেন যে আজকাল মিথ্যা খবর প্রচারের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। আমাল ক্লুনি বইটির মুখবন্ধে বলেন, স্বৈরাচারী নেতারা আজ অনলাইন বট সেনাদের ওপর এতটাই নির্ভর করতে পারেন যে তারা চাইলে প্রতিটি গল্পের কেবল একটি দিক রয়েছে—এমন ধারণা মানুষের মাঝে সৃষ্টি করতে সক্ষম। 

এটি খুব বড় চ্যালেঞ্জ যা বেশির ভাগ মানুষই উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভুল তথ্য প্রচার নিষিদ্ধের আইন পাস করলেও এটি সহজে মিলিয়ে যাবে না। যা অমর্ত্য সেন ৪০ বছর আগেই বলেছিলেন, মূলত পুরো বর্ণনার মধ্যে আমাদের নিজেদের পছন্দ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আসলে বাস্তবতা এতটাই জটিল যে আমরা কী অন্তর্ভুক্ত করব এবং কী বাদ দেব সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত না নিয়ে কোনো কিছুকে উপস্থাপন করা যায় না। এমন একটি বিশ্বে যেটি ইন্টারনেট নামক তথ্যের সাগরে ডুবে আছে সেখানে অনলাইনে প্রভাবশালীদের নতুন করে বানোয়াটি ভুয়া বা মিথ্যা সংবাদ তৈরি করার দরকার পড়ে না; তারা কেবল পক্ষপাতদুষ্ট রিপোর্ট করলেই যথেষ্ট প্রভাব খাটাতে সক্ষম। সংবাদমাধ্যমগুলো সূক্ষ্ম ও স্পষ্ট উভয়ভাবে ভোটারদের মতামতকে প্রভাবিত করতে পারে। এখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেনের ছবি নির্বাচনের তুলনার ঘটনাকে যাচাই করে দেখুন—কোনটি ফক্স নিউজ চ্যানেল বেছে নিয়েছে। 

ভুয়া বা মিথ্যা খবরকে নিষিদ্ধ করে কর্তৃত্ববাদীদের প্রভাবের সমাধান করা যাবে না। আমাদের সবচেয়ে বড় আশার জায়গা হচ্ছে শিক্ষা। আমাদের আরো ভালোভাবে কাজ করে যেতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষের বিচক্ষণতা বৃদ্ধি পায় এবং তারা ম্যানিপুলেশনের পদ্ধতিগুলোর প্রতি কম প্রতিক্রিয়াশীল হয়। 

অবশ্যই শিক্ষার পাশাপাশি আইন ও নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী মানসিকতাকে এগিয়ে নিতে হবে এবং প্রযুক্তির উদ্ভাবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা এক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। 

কৌশিক বসু: বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ; ভারত সরকারের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের অনাবাসিক জ্যেষ্ঠ ফেলো

ভাষান্তর: আবিদ মঈন খান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন