সওজের ভাঙাচোরা সড়ক ২ হাজার ১৫২ কিলোমিটার

মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হোক

যোগাযোগ অবকাঠামোয় সড়ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক খাতে গৃহীত বেশকিছু প্রকল্প প্রশংসা পেয়েছে। কিন্তু দেশের সড়কগুলোর সার্বিক দৃশ্য বেশ উদ্বেগজনক। বিশেষ করে ভাঙাচোরা সড়কের ফলে জনগণকে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়। সম্প্রতি হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট মডেল (এইচডিএম-৪) সফটওয়্যারের মাধ্যমে করা জরিপ থেকে জানা যায়, দেশে ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ বা ২ হাজার ১৫২ কিলোমিটার সড়ক। এর মধ্যে ৩৭৭ কিলোমিটারের বেশি সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ।

গত বছরের তুলনায় বেহাল সড়কের কোনো উন্নতিই হয়নি। চলতি বছর সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) ভাঙাচোরা সড়কের পরিমাণ কিঞ্চিৎ বেড়েছে। এইচডিএমের জরিপে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ইন্টারন্যাশনাল রাফনেস ইনডেক্স বা আইআরআই অনুসরণ করা হয়। সে অনুযায়ী এ জরিপকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বেহাল সড়ক খাত আমাদের দীর্ঘদিন ধরেই ভোগাচ্ছে। অথচ কয়েক বছর আগেই গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল যে বাংলাদেশে বিশ্বের সর্বোচ্চ অর্থ ব্যয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে। সে হিসাবে আমাদের দেশের রাস্তা কেন দীর্ঘদিন টেকসই হচ্ছে না, সেটি বিবেচ্য বিষয়। অবশ্য সাম্প্রতিক জরিপে সড়ক নির্মাণে প্রত্যাশিত অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ার অভিযোগও উঠেছে। কিন্তু এ অভিযোগ যাচাই করার প্রয়োজনও রয়েছে। কেননা চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সওজের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বিপরীতে সরকার ২৫ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। তবে বিপুল অংকের অর্থ বরাদ্দ পেলেও ভাঙাচোরা সড়ক কমার বদলে উল্টো বেড়েছে।

এ রকম মাৎস্যন্যায় পরিস্থিতি জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক ভূমিকা পালন করে। কেননা পুরো দেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য টেকসই সড়কপথের বিকল্প নেই। উন্নত দেশগুলোর উদাহরণ এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এসব দেশ তাদের সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করেছে। এবং মানসম্মত সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে তারা কার্পণ্য করেনি। এ কারণে দেশগুলোর সড়কে বেহাল পরিস্থিতি লক্ষ করা যায় না। সড়ক মসৃণ থাকলে যানবাহন চলাচলেও সহজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যায়। এভাবে সড়কগুলো একটি দেশের উন্নয়নের সোপান হিসেবে ভূমিকা রাখলেও আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। ফলে জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা সড়কগুলোয় যে বেহাল চিত্র উঠে আসছে তা দুঃখজনক। উল্লেখ্য যে দুর্বল, খারাপ ও খুব খারাপ—তিন শ্রেণীই ভাঙাচোরা সড়ককে নির্দেশ করে।

সড়ক ব্যবস্থাপনার নাজুকতার চিত্র ঈদ উৎসবের সময় তীব্রভাবে ফুটে ওঠে। অথচ সড়ক যখন রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় তখন নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এসব কারণে সড়কের অবস্থা বেহাল হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। এছাড়া অমসৃণ সড়ক নির্মাণ, দেশের কিছু সড়ক ফুলে ওঠা বা ডেবে যাওয়ার মতো সমস্যা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। আর প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ যদি পাওয়া না যায়, তাহলে বিষয়টির সুলুকসন্ধান করে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেয়া হোক—এটিই আমাদের কাম্য। এছাড়া আমাদের দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে যাওয়ার পেছনে দায়ী করা হয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবকে। এক্ষেত্রে সওজের গভীর মনোযোগ প্রয়োজন। দুর্নীতির যে অভিযোগ করা হয়, সেটিও আমলে নিয়ে কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। একটি বিষয় খুব স্পষ্ট, যোগাযোগ খাতে যদি অব্যবস্থাপনা বিরাজ করে তাহলে সরকারের সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডই প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। তাই এক্ষেত্রে কোনো অবহেলা করা যাবে না। এজন্য সড়কে মানসম্মত উপকরণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ভারী যানবাহন চলাচল উপযোগী সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে কিনা তা যাচাই করতে হবে। এছাড়া সড়কের কার্পেটিং ঠিকমতো করা হয়েছে কিনা সেটিও নিবিড় তত্ত্বাবধানের আওতায় আনা প্রয়োজন। পাশাপাশি সড়ক নির্মাণে দরপত্রের প্রতিযোগিতা না হওয়া, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব, সংঘাত ও উচ্চমাত্রার দুর্নীতিকে দায়ী করে বিশ্বব্যাংক নিকট অতীতে যে অভিযোগ করেছিল সেটিরও মূল্যায়ন করতে হবে। এর ফলে প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ার যে বিষয়টি সওজের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সেটির মীমাংসা সম্ভব হতে পারে। কারণ অত্যাধিক দুর্নীতির অভিযোগ যেহেতু রয়েছে, সে হিসেবে সওজের প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্থের জোগান দেয়া হলেই যে সড়কের চিত্র পাল্টে যাবে বিষয়টি এ রকম নয়। এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ও সড়ক নির্মাণ-পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে।

বস্তুত সড়ক নির্মাণে অবহেলা করা যাবে না। কারণ এর সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। জাতীয় উন্নতিকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে হলে যোগাযোগ খাতে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। এজন্য মানসম্মত নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারসহ সড়ক নির্মাণের পুরো প্রক্রিয়া জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন। আমরা প্রত্যাশা করব, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর সড়ক ব্যবস্থাপনার আলোকে দেশের সড়কগুলো ঢেলে সাজাবে। কোনো সড়ককেই অবহেলা না করে জাতীয় ও আঞ্চলিক সব ক্ষেত্রেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য দূরদর্শী পরিকল্পনার আলোকে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হবে, সেটিই আমাদের কাম্য। আমরা সড়কে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির অবসান দেখতে চাই। সড়ক যেন মসৃণ হয় এবং দুর্ঘটনা কমে আসে সেজন্য সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে নিবিড় তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল ভূমিকা সবার কাম্য।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন