ট্রাক-পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষ

সিলেটের সড়কে প্রাণ গেল ১৫ নির্মাণ শ্রমিকের

আরো তিন জেলায় নিহত ৫

বণিক বার্তা ডেস্ক

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে গতকাল দুর্ঘটনায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া ট্রাক ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার নাজিরবাজারে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। আহত হয়েছেন অন্তত আরো ১২ জন। সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের কুতুবপুর এলাকায় গতকাল ভোরে আলুবোঝাই ট্রাক ও যাত্রী বহনকারী একটি পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে এ দুর্ঘটনা ঘটে। হতাহতদের সবাই নির্মাণ শ্রমিক, যাদের বেশির ভাগেরই বাড়ি সিলেটের পাশের জেলা সুনামগঞ্জে। একই দিন আরো তিন জেলায় সড়কে প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচজন। 

পুলিশের বরাত দিয়ে বণিক বার্তার সিলেট প্রতিনিধি জানান, সিলেট শহর থেকে ৩০ জন নির্মাণ শ্রমিক নিয়ে ভোরে ওসমানীনগরের উদ্দেশে রওনা হয় একটি পিকআপ ভ্যান। দক্ষিণ সুরমার নাজিরবাজারের কুতুবপুর এলাকায় সিলেটগামী আলুবাহী একটি ট্রাকের সঙ্গে এর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে পিকআপে থাকা ১১ নির্মাণ শ্রমিক ঘটনাস্থলেই নিহত হন। পরে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরো চারজন। সব মিলিয়ে এ ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন।

নিহতদের মধ্যে ১৪ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের মো. সি‌জিল মিয়া (৫৫), এক‌লিম মিয়া (৫৫), হা‌রিছ মিয়া (৬৫), সৌরভ ‌মিয়া (২৭), সাজেদুর (৬০), বাদশা মিয়া (৩০), সাধু মিয়া (৫০), রশিদ মিয়া (৫০) ও মেহের (২৫); শা‌ন্তিগঞ্জ উপজেলার শাহীন মিয়া (৪০), দুলাল মিয়া (২৬) ও আওলাদ হোসেন (৫০); হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের আমিনা বেগম (৪৫) এবং নেত্রকোনার বারহাট্টার আওলাদ মিয়া (৪০)।

সিলেট মহানগর পুলিশের দক্ষিণ সুরমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শামসুদ্দোহা জানান, মুন্সিগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী একটি আলুবোঝাই বড় ট্রাকের সঙ্গে ও শ্রমিকদের বহনকারী পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে ১১ জন মারা যান। আহত ১৫ জনকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে আরো চারজনের মৃত্যু হয়।

এ দুর্ঘটনায় আহত রবিউল ইসলাম বলেন, ‘হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে একটি ট্রাক এসে আঘাত করলে আমাদের পিকআপটি উল্টে যায়। ট্রাকটি সড়কের ডান পাশে চলে এসেছিল। একটি বিকট শব্দ হয়। এরপর আর কিছু বলতে পারিনি। এ দুর্ঘটনায় আমি আর আমার বাবা আহত হলেও প্রাণে বেঁচে আছি। তবে আমার বড় চাচা মারা গেছেন।’

দুর্ঘটনার খবর পেয়ে উপপরিচালক মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি টিম ঘটনাস্থলে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করে। জানতে চাইলে সিলেট ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম ভূঞা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নির্মাণ শ্রমিক বহনকারী পিকআপটি ওসমানীনগরের উদ্দেশে যাচ্ছিল। নাজিরবাজার এলাকার কুতুবপুরে পৌঁছলে ঢাকা থেকে সিলেটগামী ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের পর শ্রমিক বহনকারী পিকআপটি সড়কের পাশে পড়ে যায় এবং বড় ট্রাকটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়।’

এদিকে হতাহতদের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। স্বজনদের কেউ ছোটেন মর্গে, কেউবা ওয়ার্ডে। ভাইকে হারিয়ে মর্গের সামনে আহাজারি করছিলেন দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শের ইসলাম। জানতে চাইলে বলেন, ‘হঠাৎ করে বিপরীতমুখী একটি ট্রাক আমাদের দিকে ছুটে এসে ধাক্কা দেয়। মুহূর্তেই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সবকিছু। আমি বেঁচে গেলেও আমার ভাই সাজেদুর বাঁচতে পারেনি।’ 

পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে। সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইমরুল হাসান এ বিষয়ে জানান, মরদেহ দুপুরেই স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মরদেহগুলোর কোনো ময়নাতদন্ত হয়নি। 

স্বামী মেহের মিয়ার মরদেহ নিতে এসে মর্গের পাশে বসে আহাজারি করছিলেন চাঁদনী বেগম। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘সকালে ডিম রান্না করে দিয়েছিলাম। কিন্তু সে না খেয়েই চলে যায়। এখন আমার বাচ্চাগুলো এতিম হয়ে গেল। আমি টাকা চাই না। বাচ্চাদের বাবাকে চাই। গরমে কাল রাতে ঘুম আসছিল না। রাত ২টার দিকে সে আমারে ডাক দেয়, বলে, তোর জন্য একটা ফ্যান কিনে দেব।’

হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন নিহত দুলাল মিয়ার ফুপাতো ভাই মো. শাহীন। তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন পাশে থাকা স্বজনরা। মো. শাহীন জানান, দুলালের বড় ভাই হেলাল আহমদ প্রায় তিন মাস আগে নৌ দুর্ঘটনায় মারা যান। তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান রেখে যান। মাস খানেক আগে পরিবারের লোকজন হেলালের স্ত্রী শারমিন বেগমকে বিয়ে দেন দুলাল মিয়ার সঙ্গে। বিয়ের দুই সপ্তাহ পর কাজের জন্য সিলেটে আসেন দুলাল। থাকতেন আম্বরখানা সাপ্লাই এলাকার ভাড়া বাসায়। গতকাল দুলালও দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন।

দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ইলিয়াছ শরীফ দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, ‘পিকআপে করে যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ। তার পরও মহাসড়কে পিকআপে করে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। এ কারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকব।’ 

সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান সিলেট সফররত নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তার সঙ্গে ছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। এ সময় আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দেন। জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘তাৎক্ষণিকভাবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে এবং আহতদের ১০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে।’ 

এদিকে রাজশাহীতে এক আত্মীয়র জানাজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে সিএনজিচালিত অটোরিকশার সঙ্গে ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন বাবা-ছেলে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে মা-মেয়েসহ তিনজন। মঙ্গলবার রাতে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার দাশুড়িয়া ইউনিয়নের তেঁতুলতলা এলাকায় পাবনা-ঈশ্বরদী মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চাঁদপুর গ্রামের মাহবুবুর রহমান (৪০) ও তার দেড় বছর বয়সী ছেলে আবদুর রহমান। স্থানীয়দের বরাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন পাকশী হাইওয়ে পুলিশের ওসি আশীষ কুমার স্যানাল।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর খাইয়ারায় ডিমবোঝাই একটি পিকআপ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার বিভাজকের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে চালক ও হেলপার প্রাণ হারান। গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিহতরা হচ্ছেন পিকআপচালক মো. সোহাগ (৩০) ও তার সহকারী জহির আহাম্মদ (২৬)। ফেনীর মুহুরীগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশের ওসি মো. রাশেদ খান চৌধুরী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। 

বগুড়ার আদমদীঘিতে যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় নিহত হয়েছেন বাইসাইকেল আরোহী রফিকুল ইসলাম অপু (৫২) নামে এক ব্যক্তি। তিনি উপজেলার ছাতিয়ান গ্রাম ইউপির পশ্চিম সিংড়া গ্রামের রইচ উদ্দিনের ছেলে। আদমদীঘি থানার ওসি রেজাউল করিম রেজা জানান, সান্তাহার পূর্ব ঢাকা রোড তিনমাথা মোড়ে মঙ্গলবার বাসের ধাক্কায় অপু আহত হলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বিকালে তার মৃত্যু হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন