স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে কৃষিপণ্য রফতানির হারে পিছিয়ে বাংলাদেশ

উৎপাদনশীলতা ও গুণগতমান নিশ্চিত করে কৃষিপণ্যের রফতানি বাড়াতে হবে

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ এবং এ দেশের মাটি, আবহাওয়া ও পরিবেশ অত্যন্ত কৃষি উপযোগী। একসময় দেশের বেশির ভাগ মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও এক-দুই দশক আগেও আমাদের কৃষি খাত এতটা উন্নত অবস্থানে ছিল না। কিন্তু কৃষিতে প্রযুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন ও আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের কারণে আমাদের কৃষি আজ অনেক এগিয়েছে। এছাড়া কৃষিক্ষেত্রে শিক্ষিত তরুণ-যুবকের অংশগ্রহণ বাড়ায় কৃষিক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য আগের তুলনায় বর্তমানে দেশের কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে। অতীতে শুধু শীতকালে শাকসবজি পর্যাপ্ত পাওয়া গেলেও গ্রীষ্ম এবং বর্ষাকালে তেমন শাকসবজি খুব একটা পাওয়া যেত না। কিন্তু বর্তমানে কৃষিতে অগ্রগতির ফলে সারা বছর ধরে পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি পাওয়া যায়। আধুনিক ও উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদের কারণেই শাকসবজির উৎপাদন এভাবে বেড়েছে। তবে দেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিদেশে ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে রফতানি করতে পারছি না। সাম্প্রতিক বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে কৃষিপণ্য রফতানির হারে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়া, অ্যাঙ্গোলা, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ও দক্ষিণ আমেরিকার গায়ানা এবং তার পরই বাংলাদেশের অবস্থান। অর্থাৎ রফতানি আয়ে কৃষিপণ্যের অবদানের তালিকায় সর্বশেষ পাঁচটি দেশের একটি বাংলাদেশ। রফতানি সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমাদের কৃষিজাত পণ্য রফতানি করতে গিয়ে রফতানিকারকদের নানা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তাছাড়া কৃষিজাত পণ্যকে বিমানে বা অন্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা ধরনের জটিলতা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ কৃষিজাত পণ্য রফতানি করে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। এশিয়ার ভারত, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, চীনসহ অনেক দেশ কৃষিজাত পণ্য নিয়মিত রফতানি করে।

দেশের কৃষিপণ্যের বিশ্ব বাজারের সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেছিলেন, সরকার বিশ্ব বাজারে কৃষিপণ্য রফতানি বাড়াতে নানা ধরনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশী কৃষিপণ্যের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তবে করোনা-পরবর্তী সময়ে কৃষিজাত পণ্যের চাহিদা কিছুটা বাড়লেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব কমবেশি সর্বক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়েছে। রফতানি শৃঙ্খলা ভাঙনসহ বৈশ্বিক মন্দার কারণেও কৃষিজাত পণ্যের রফতানি বাজার কিছু খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) এবং বাংলাদেশ ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন (বিটিএফ) থেকে প্রকাশিত ‘ইমপ্লিকেশন অব এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন ফর এগ্রিকালচারাল এক্সপোর্টস ফ্রম বাংলাদেশ: ইস্যুজ অ্যান্ড পলিসি অপশনস’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয়েছে ৫২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি পণ্য। এর মধ্যে কৃষি ও মৎস্য পণ্য ছিল ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের মতো। সেটা মোট রফতানিতে কৃষিপণ্যের অবদান মাত্র ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যা কিনা যথেষ্ট নয়। প্রতি বছরের মতো এবারো কৃষিপণ্যের মধ্যে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের রফতানি আয়ের হিস্যাই বেশি। রফতানিকারকরাও মনে করেন অবকাঠামোগত সহায়তা পাওয়া গেলে আগামী বছরগুলোয় কৃষিপণ্যে রফতানি দ্বিগুণ করা সম্ভব হবে।

বণিক বার্তার প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশে রফতানির ক্ষেত্রে এলডিসি সুবিধা পেয়ে থাকে। এজন্য অনেক দেশেই দিতে হয় না কোনো ধরনের শুল্ক। তবে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেসব ট্যারিফ হার যুক্ত হবে। এতে সার্বিক রফতানির পাশাপাশি কৃষিপণ্য রফতানিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ধারণা করা হচ্ছে, ট্যারিফ হার সংযুক্ত হলে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি কৃষিপণ্য যায় এমন সাতটি দেশে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ১১ দশমিক ১ শতাংশ পর্যন্ত রফতানি কমে যেতে পারে। তাই এখন থেকেই আমাদের কৃষিপণ্যের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি গুণগতমান নিশ্চিত রাখার উদ্যোগ নেয়া উচিত। অন্যথায় এলডিসি উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। 

চাষাবাদে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে উৎপাদন বেড়েছে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুসারে, উল্লেখযোগ্য কৃষিজাত রফতানিপণ্যের মধ্যে রয়েছে শাকসবজি, চা, ফুল, ফলমূল, নানা ধরনের মসলা, তামাক, শুকনা খাবার ইত্যাদি। ইদানীং আমাদের দেশে দেখা যায়, ফলের মৌসুমে আম, কাঁঠাল, আনারস, মাল্টা, লিচুসহ আরো অনেক ফল চাহিদার তুলনায় অধিক পরিমাণে উৎপন্ন হচ্ছে। তাছাড়া বর্তমানে সারা বছর ধরে পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি পাওয়া যায়। আধুনিক ও উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করায় শাকসবজির উৎপাদন বেড়েছে। মৎস্য ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। চাষের কারণে মাছের উৎপাদন বহু গুণ বেড়েছে। ডেইরি শিল্পেও অনেকটা পথ এগিয়েছি আমরা। তবে এত কিছুর মধ্যে আমাদের অভাব রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র এবং সংরক্ষণ ব্যবস্থার। এগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকায় হাজার হাজার টন কৃষিপণ্য প্রতি বছর পচে নষ্ট হচ্ছে।

আমাদের কৃষিপণ্য রফতানিতে অন্যতম একটি প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করছে ‘ফিট ফর হিউম্যান কনজাম্পশন’ সার্টিফিকেট বিষয়টি। দেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব প্রতিষ্ঠা করে এ-জাতীয় সার্টিফিকেট দেয়া সম্ভব হলে রফতানি বাড়িয়ে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যেত। কিন্তু এ ধরনের সার্টিফিকেট দেয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বাংলাদেশে নেই। মান নিশ্চিত করে সার্টিফিকেট ইস্যু করার মতো কোনো অ্যাক্রেডিটেড ল্যাবও নেই দেশে। সঠিকভাবে মাননির্ধারণ ছাড়া রফতানির কারণে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ভারী ধাতুর উপস্থিতি পেয়ে পূর্বে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পান, রাশিয়া আলু, চীন কাঁকড়া ও কুঁচিয়া এবং খাদ্যে শূকরের হাড় ও মুরগির বিষ্ঠার উপস্থিতির কারণে সৌদি আরব মিঠা পানির মাছ আমদানি বন্ধ করেছিল। আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানের কারো ক্রেতা রাষ্ট্রগুলোর নির্ধারিত প্যারামিটার অনুযায়ী ‘ফিট ফর হিউম্যান কনজাম্পশন’ সার্টিফিকেট ইস্যুর সক্ষমতা নেই। এ অবস্থায় রফতানির বিশাল সম্ভাবনা কাজে লাগানোর পাশাপাশি দেশে কৃষিপণ্যের অপচয় রোধ ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অ্যাক্রেডিটেড ল্যাব স্থাপনসহ মাননির্ধারণী বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি একক ‘হেলথ সার্টিফিকেশন অথরিটি’ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে আসছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। এ-জাতীয় সার্টিফিকেট দেয়া সম্ভব হলে কৃষিজাত ও খাদ্যপণ্য রফতানি প্রায় ১০ গুণ বেড়ে প্রতি বছর ১৩ বিলিয়ন ডলার মতো বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি চরম মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেক অর্থনীতিবিদের মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই অন্যতম বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয়। আমরাও এ বিশ্ব অর্থনীতির বাইরে নই। এমন পরিস্থিতি এবং আগামীর রফতানি বাণিজ্যে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই এখনই কৃষির উৎপাদন বাড়ানোর প্রতি জোর দেয়া প্রয়োজন। এতে দেশে চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও জায়গা তৈরি করে নিতে হবে। যদিও আমাদের কৃষিমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ইউরোপীয় দেশ বা অন্যান্য দেশে রফতানির ক্ষেত্রে আমরা যেসব সুবিধা পেয়ে থাকি, এলডিসি উত্তরণের ফলে তা রফতানিতে তেমন প্রভাব ফেলবে না। তার পরও নিজেদের কৃষিপণ্যের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক মানের সার্টিফিকেশনসহ গুণগতমান নিশ্চিতের ব্যাপারে জোর দিয়ে কাজ করে যেতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে কৃষি অর্থনীতিতে একটি শক্ত ভিত্তি নির্মাণ করতে সক্ষম হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন