ফ্রাঁসোয়া জিলোর দুঃখ ছিলেন পাবলো পিকাসো

ওয়াহিদ সুজন

ফ্রাঁসোয়া জিলো মারা গেছেন সম্প্রতি। ছবিতে তার সঙ্গে পাবলো পিকাসো। ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

চিত্রশিল্পী হিসেবে অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় কাজ করেছেন ফ্রাঁসোয়া জিলো। তার শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে নামী সব গ্যালারিতে। কোটি কোটি টাকা দর পেয়েছে নিলামে। তা সত্ত্বেও আক্ষেপ ছিল, পাবলো পিকাসোর সঙ্গে সম্পর্কের চেয়ে বেশি আলোচিত হয়নি তার কাজ। আর তিনিই একমাত্র বিখ্যাত নারী যিনি এই মাস্টার পেইন্টারকে নিজ ইচ্ছায় ছেড়ে এসেছিলেন। সেই জিলো মারা গেছেন।

কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্কে বসবাস করছিলেন ফ্রাঁসোয়া জিলো। ফুসফুস ও হৃদপিণ্ডের সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে গতকাল মঙ্গলবার (৬ জুন) সেখানকার মাউন্ট সিনাই ওয়েস্ট হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বয়স হয়েছিল ১০১ বছর।

বার্তা সংস্থা এপিকে মায়ের খবরটি নিশ্চিত করেন জিলোর মেয়ে অরেলিয়া এঙ্গেল। বলেন, তিনি অত্যন্ত প্রতিভাবান শিল্পী ছিলেন। আমরা তার রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার, অবিশ্বাস্য চিত্রকর্ম ও কীর্তি নিয়ে কাজ করব।

কৈশোর থেকে নিজের আঁকাআঁকির জন্য প্রশংসা পেয়ে আসছিলেন ফরাসি বংশোদ্ভূত ফ্রাঁসোয়া জিলো। ১৯৪৩ সালে বয়স যখন ২১ বছর, তখন পাবলো পিকাসোর সঙ্গে তার পরিচয়। দুজনের বয়সের ব্যবধান ছিল ৪০ বছর। তাদের সম্পর্ক থেকে দুই সন্তান ক্লদ ও পালোমা পিকাসোর জন্ম।

নিজ স্টুডিওতে ফ্রাঁসোয়া জিলো। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

অরেলিয়া এঙ্গেলের মতে, খুব অল্প বয়স হলেও মুক্ত-স্বাধীন হিসেবে নিজেকে ভালোবাসতেন জিলো। তার ছিল সত্যিকারের শিল্পীর আবেগ।  

২০১৬ সালে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকাকে জিলো বলেন, আমি বন্দি ছিলাম না। নিজের ইচ্ছায় পিকাসোর সঙ্গে ছিলাম। আমি বলেছিলাম, আমি নিজের খুশিতে এসেছি, যখন চাই তখন চলে যাবো। পিকাসো বললেন, আমার মতো লোককে কেউ ছেড়ে যায় না। আমি বললাম, দেখা যাবে।

কিন্তু ইগো সর্বস্ব পিকাসো তা সহজে মেনে নিতে পারেননি। তিনি সবাইকে নিষেধ করে দেন কেউ যেন জিলোর আর্ট নিজেদের গ্যালারিতে না রাখেন।

জিলো বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত লাইফ উইথ পিকাসো। যৌথভাবে লেখা বইটি ১৯৬৪ সালে প্রকাশ হয়। ক্ষুব্ধ পিকাসো বইটি নিষিদ্ধের চেষ্টায় ব্যর্থ হন। তিনবার আদালতে গিয়ে হেরে যান। তৃতীয় হারের পরে পিকাসো ফোন করে জিলোকে অভিনন্দন জানান। আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, বইটি প্রকাশ করলে সন্তানদের মুখ দেখবেন না। কিন্তু জিলোও কম যান না। বই থেকে পাওয়া অর্থ দুই সন্তানের উত্তরাধিকারের জন্য আইনি লড়াইয়ে খরচ করেন তিনি।

১৯২১ সালের ২৬ নভেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসের শহরতলিতে ফ্র্যাঁসোয়া জিলোর জন্ম। পাঁচ বছর বয়সেই শিল্পী হওয়ার অভিপ্রায় জন্মায়। পরে মা-বাবার ইচ্ছা অনুসারে আইন নিয়ে পড়াশোনা করলেও শিল্পের প্রতি আবেগ কখনো কমেনি। ১৯৪৩ সালে তার চিত্রকর্মের প্রথম প্রদর্শনী হয়। সেই বছরই পিকাসোর সঙ্গে এক রেস্তোরাঁয় দেখা। তখন তার সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন প্রেমিকা ডোরা মার। পরিচয়ের পর জিলোর সঙ্গে থাকা বন্ধু জানান তারা চিত্রশিল্পী। কিন্তু পিকাসো বলেন, যে মেয়েরা এরকম দেখতে তারা চিত্রশিল্পী হতে পারে না। এরপর দুজনকে স্টুডিওতে আমন্ত্রণ জানান তিনি, সেখান থেকে পিকাসো-জিলোর সম্পর্কের শুরু। মা-বাবার অমতে পিকাসোর সঙ্গে থাকতে শুরু করেন।

ছবি: নিউইয়র্ক টাইমস

এটা ঠিক যে, মা-বাবার কাছে কখনো নিজের শিল্পী হওয়ার বাসনার যোগ্য মর্যাদা পাননি ফ্রাঁসোয়া জিলো। পিকাসোর সঙ্গে সম্পর্ক অনেক জটিল হলেও সম্ভবত পেশাদার চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্নপূরণে পথ দেখিয়েছিল। শিল্পীর আবেগ পিকাসোর সঙ্গে শেয়ার করতে পেরেছিলেন। এঙ্গেলের মতে, তারা উভয়েই বিশ্বাস করতেন যে শিল্পই জীবনের একমাত্র জিনিস যা করার মতো কিছু।

১৯৫৩ সালে পিকাসোকে ছেড়ে যাওয়ার পর প্রাক্তন বন্ধু শিল্পী লুক সাইমনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠে জিলোর। ১৯৫৫ সালে তারা বিয়ে করেন। তাদেরই মেয়ে এঙ্গেল। ১৯৬২ সালে জিলো ও সাইমনের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। ১৯৭০ সালে পোলিও ভ্যাকসিন নিয়ে কাজের জন্য বিখ্যাত আমেরিকান ভাইরোলজিস্ট ও গবেষক জোনাস সালককে বিয়ে করেন জিলো। তারা ক্যালিফোর্নিয়া ও প্যারিস এবং পরে নিউ ইয়র্কের বসবাস শুরু করেন। ১৯৯৫ সালে সালক মারা যান। ততদিনে শিল্পের শিক্ষকসহ নানা ধরনের দায়িত্ব পালন করেন জিলো।

ফ্রাঁসোয়া জিলোর কাজ শিল্পরসিকদের কাছে ভালোই সমাদর পেয়েছে। সময়ে সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে দামও। ২০২১ সালে একটি শিল্পকর্ম নিলামে ১৩ লাখ ডলার দাম পায়। তার কাজ মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট ও মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টসহ অনেক নামি জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়েছে। জেমস আইভরি পরিচালিত ১৯৯৬ সালের সিনেমা সারভাইভিং পিকাসোতে তার জীবন চিত্রিত হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন