গাজীপুরের
কাশিমপুর উপজেলার সারাবো এলাকার আবু বকর, পেশায় একজন কৃষক। জমিতে ফসল ফলিয়েই একসময় চলত তার জীবন-জীবিকা। ধানের পাশাপাশি শীতের মৌসুমে ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলাসহ নানা ধরনের সবজিও চাষ করতেন, কিন্তু আশপাশের ডায়িং কারখানার ইটিপিবিহীন কেমিক্যাল ও বর্জ্য মেশানো
পানি এসে পড়ছে কৃষিজমিতে। নষ্ট করছে জমির ফসল, পুকুর ও খালের মাছ,
শিশুদের খেলার মাঠ। ডায়িং কারখানার এ বিষাক্ত পানিতে
আজ যেন ‘কালছে’ হয়ে
গেছে আবু বকরের মতো অর্ধশতাধিক কৃষকের স্বপ্নও! অনেকেই কৃষিকাজ হারিয়ে করছেন দিনমজুরি।
পরিবেশ আইন অমান্য করে বিষাক্ত বর্জ্য সরাসরি ফসলি জমিতে ফেলার অভিযোগ উঠেছে কাশিমপুরের বেশ কয়েকটি ডায়িং কারখানার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি সরজমিনে দেখা গেছে, সিটি করপোরেশনের ৪ নং সারদাগঞ্জ ওয়ার্ডের সারাবো এলাকায় স্থানীয় জোড়া ব্রিজের নিচ দিয়ে বসানো হয়েছে মোটা পাইপলাইন। জিএমএস কম্পোজিট লিমিটেড ও মেগা ইয়ার্ন ডায়িং লিমিটেড নামে দুটি কারখানার বিষাক্ত কালো পানি ওই পাইপলাইনে করে ফেলা হচ্ছে সরাসরি কৃষি জমিতে। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে উপজেলা কারখানা কর্তৃপক্ষ ও কৃষি বিভাগসহ স্থানীয় প্রশাসনের কাছে আবেদন জানানো হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
কৃষক আবু বকর বলেন, ‘আমরা কৃষক মানুষ, আমাদের আয়ের একমাত্র উপার্জন কৃষি। কিন্তু ১০-১২ বছর হলো কারখানাগুলো কেমিক্যালমিশ্রিত পানি সরাসরি আমাদের জমিতে ফেলছে। এ কারণে আর চাষাবাদ করতে পারছি না। বর্তমানে আমি দিনমজুরের কাজ করে কোনো রকমে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে জীবন-যাপন করছি।’ একই কথা জানান, স্থানীয় কৃষক ফারুখ, আফতাব উদ্দিন, নজরুল ইসলাম, আবুল হোসেন, নুরুল ইসলামরাও। তাদের জমিতে এক সময় বিঘাপ্রতি ৩০-৩৫ মণ পর্যন্ত ধান হতো বলেও জানান।
কৃষক মমিন বলেন, ‘১০-১২ বছর আগে আমরা বোরো মৌসুমে বিঘাপ্রতি ৩০-৩৫ মণ ধান পেতাম। কিন্তু কারখানার কালো রঙের বর্জ্যপানি ফসলি জমিতে সরাসরি চলে আসায় ফলন কমে যায়। প্রথম কয়েক বছর বিঘাপ্রতি ধান পাওয়া গেছে সাত থেকে আট মণ। লোকসানের কারণে অনেকে চাষাবাদ বন্ধ করে দিয়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য দিনমজুরের কাজ করে কোনোরকম বেঁচে আছেন।’ অনেকেই আবার অন্য পেশার কাজ না জানায় ক্ষতির মুখে বাধ্য হয়ে চাষাবাদই করে যাচ্ছেন বলে জানান এ কৃষক।
স্থানীয় বাসিন্দা অ্যাডভোকেট আখতার হোসেন বলেন, ‘আমাদের এলাকার প্রায় কয়েক হাজার বিঘা ফসলি জমি কারখানা থেকে নির্গত কেমিক্যালমিশ্রিত বর্জ্য পানির কারণে নষ্ট হচ্ছে। আমরা এ নিয়ে একাধিকবার কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা ব্যবস্থা নেবে বলেও আশ্বস্ত করেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার কোনো প্রতিকার হয়নি।’
দুর্গন্ধযুক্ত কাদামাটির আধিক্যে খেতে হালচাষসহ স্বাভাবিক কাজ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। ডা. আবুল হোসেন বলেন, ‘আমাদের প্রায় ১৫ বিঘা জমি রয়েছে। কারখানার কেমিক্যালমিশ্রিত বর্জ্যপানির কারণে ১০-১২ বছর ধরে সে জমিতে আর চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। এভাবে যদি দিন দিন ফসলি জমি নষ্ট করা হয় তাহলে টাকা দিয়েও আর খাদ্যশস্য মিলবে না।’
এলাকাবাসী জানান, একসময় খালে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ এসে এখানে মাছ ধরত। কিন্তু কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যালমিশ্রিত পানির কারণে মাছ দূরের কথা, খালে এখন কোনো জলজ প্রাণীও চোখে পড়ে না। এছাড়া কারখানার ঝুট বয়লারের বিষাক্ত ধোঁয়ায় চর্ম ও শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এলাকাবাসী।
অভিযোগের বিষয়ে মেগা ইয়ান ডায়িং লিমিটেডের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) শরিফ মো. এ হোসেইন বলেন, ‘আমাদের কারখানার পানি শোধনাগারের (ইটিপি) মাধ্যমে দূষণমুক্ত করে ছাড়া হয়। তার পরও যেহেতু আমাদের নামে অভিযোগ এসেছে বিষয়টি সরজমিনে দেখা হবে।’ এ ব্যাপারে জিএম এস কম্পোজিট লিমিটেড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে টঙ্গী জোন সার্কেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘ডায়িং কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে বলে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’