যুগপূর্তিতে ধন্যবাদ

দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বণিক বার্তা এক যুগ পূর্ণ করে আজ ১৩ বছরে পদার্পণ করল। আমাদের লক্ষ্য ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, রাজনৈতিক অর্থনীতি, নীতি বিশ্লেষণের মতো বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করা। আমরা সাংবাদিকতার কেন্দ্রে রাখতে চেয়েছি অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, অন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ, উন্নয়ন, ইতিহাস, সংস্কৃতির মতো বিষয়কে। একই সঙ্গে আমরা পাঠকের জন্য নির্ভুল তথ্য ও প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ নিশ্চিত করতে চেয়েছি। নতুন ধারার একটি সংবাদপত্র হিসেবে বণিক বার্তার সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল, যার অনেকগুলো অন্যদের তুলনায় ভিন্ন ধরনের। এর সঙ্গে ছিল বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে ছাপা সংবাদপত্রের জন্য তৈরি হওয়া কঠিন পরিস্থিতি। এক যুগ পেরিয়ে আমরা আজ বিনয়ের সঙ্গে বলতে পারি, সুসাংবাদিকতার মাধ্যমে বণিক বার্তা বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে স্বতন্ত্র অবস্থান এবং পাঠকের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। 

শুরুতে তরুণ সম্পাদকের হাতে নতুন ধারার একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা চলবে কিনা তা নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তেমন সন্দেহ, কালপর্ব পেরিয়ে আমরা এক যুগ পার করেছি। কভিডকাল ছিল আমাদের এক যুগের যাত্রাপথের একটি বিশেষ সংকটকাল। অনলাইন যেকোনো অবস্থায় সচল রাখা যায়, কিন্তু ছাপা পত্রিকা বের করতে অফিসে ন্যূনতম কয়েকজন কর্মীর উপস্থিতি নিশ্চিত করার প্রয়োজন ছিল। নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের সবার মধ্যেই তখন উদ্বেগ। এমন পরিস্থিতি আমরা আগে কখনো দেখিনি। রাস্তাগুলো জনমানবহীন, জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত। আমাদের বেশির ভাগ কর্মীকে হোম অফিসে পাঠাতে হলো। খুব অল্প সময়ে হোম অফিস ও কারওয়ান বাজারে আমাদের মূল কার্যালয়ের মধ্যে কীভাবে সমন্বয় করে ছাপা পত্রিকা প্রকাশ হবে তা নির্ধারণ করতে হলো। এভাবে আমরা পত্রিকা প্রকাশ অব্যাহত রাখলাম। অবশ্য বিপদ এখানেই শেষ ছিল না।  বিজ্ঞাপন থেকে আয় প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসে। পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। দিন শেষে সংবাদপত্রও একটি বিজনেস কাঠামোর অংশ। তাই কভিড সংকট আমাদের অন্য আর যেকোনো প্রতিষ্ঠানের মতো আঘাত হেনেছিল। এমন পরিস্থিতিতে সংকল্প, ঝুঁকি গ্রহণ ও নিজস্ব বিজনেস মডেল আমাদের টিকিয়ে রাখে। কভিডের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়ে আমরা অনেক কিছু শিখেছি, যা আমাদের ভবিষ্যৎ পথচলায় কাজে আসবে। কভিডের সংকটকাল অতিক্রম করতে পেরেছিলাম বলে আমরা গতকাল এক যুগ পূর্ণ করে ১৩ বছরে আজ পা রেখেছি।

ডিজিটাল যুগে আমাদের চারপাশের অনেক কিছুই বদলে গেছে। ডিজিটাল প্লাটফর্মে সংবাদপত্রের লাইক, ভিউ, শেয়ার, ফলোয়ারের সংখ্যা নিয়ে প্রচারণা চোখে পড়ার মতো। অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার মৌলিক নীতি ও পেশাদারত্বের ওপর এসব প্রচারণার চাপ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বণিক বার্তা প্রচারসংখ্যার কৃতিত্ব নেয়ার চেয়ে ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম করার প্রতি মনোযোগ নিবিষ্ট রেখেছে। গত এক যুগে সংবাদপত্র অনেক নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। সেগুলো মোকাবেলা করে বণিক বার্তা তার স্বকীয় সাংবাদিকতা অব্যাহত রেখেছে। প্রচারসংখ্যার চেয়ে আমরা জোর দিয়েছি কেমন সাংবাদিকতা করতে পারছি তার ওপর। আমাদের অনুসন্ধান-প্রতিবেদন সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখছে কিনা, আমরা দুর্নীতির ঘটনাকে প্রকাশ করতে পারছি কিনা, দেশের অর্থনীতি-শিল্প খাতের সমস্যা তুলে ধরছি কিনা, উন্নয়নের গতিমুখ নিয়ে বিশ্লেষণ হাজির করছি কিনা, আমাদের প্রকাশ করা তথ্য পাঠক, নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী সমাজ, তরুণ গবেষকদের কাজে লাগছে কিনা—এমন সব বিষয়ই সাংবাদিকতা করতে গিয়ে বণিক বার্তা মাথায় রেখেছে সবসময়। এ সংকল্পের ফলও আমরা পেয়েছি, পাঠক বণিক বার্তার প্রতি আস্থা রেখেছেন, মনোযোগ দিয়েছেন। এটাই এক যুগে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন।  

বণিক বার্তায় আমরা সবসময় গুরুত্ব দিয়েছি বিষয়বস্তুর ওপর। আমাদের কাগজের বিষয়বস্তু প্রতিদিন পাঠককে নতুন কিছু যেন দিতে পারে তা নিয়ে আমরা সদাসতর্ক। সৃষ্টিশীল ও নির্ভরযোগ্য কনটেন্ট পাঠকের সামনে হাজির করা আমাদের সাংবাদিকতার প্রাণ। এ কারণে আমাদের প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, বিশেষ সংখ্যা, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা, সিল্করুট, ঈদ সংখ্যা পাঠকের মনোযোগ ও আস্থা পাচ্ছে। কনটেন্ট নিয়ে আমরা নিত্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা অব্যাহত রেখেছি এবং প্রতিনিয়ত শেখার চেষ্টা করছি।

ডিজিটাল যুগে গণমাধ্যমের অনেক ভারসাম্য হয়তো বদলে গেছে, কিন্তু সাংবাদিকতার মৌলিক নীতি বদলে যায়নি। বণিক বার্তা এক যুগে তার সুসাংবাদিকতার নীতি-পদ্ধতিতে ছাড় দেয়নি, ভবিষ্যতেও দেবে না। তবে বণিক বার্তার পৃষ্ঠাগুলো প্রতিদিন বদলে যায়—নতুন খবর, ফিচার আর বিশ্লেষণে। সমাজের এ নিত্য পরিবর্তনের সঙ্গে থাকা, তাকে প্রকাশ করা পেশাদার সাংবাদিকের কাজ। বণিক বার্তা সে কাজটি নিত্যদিন করে যাচ্ছে নীতিতে অটল থেকে। বণিক বার্তা কারো পক্ষে নয়, কারো বিপক্ষে নয়—সত্য তথ্য অনুসন্ধানই আমাদের কাজ। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন কিংবা প্রবন্ধ, নিবন্ধ যা-ই আমরা প্রকাশ করি তার উদ্দেশ্য থাকে বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে পাঠকের সামনে হাজির করা। আমরা পাঠককে চমকে দিতে চাই না, ভাইরাল হতে চাই না—আমরা চাই বস্তুনিষ্ঠ তথ্যনির্ভর পেশাদার সাংবাদিকতা করতে। বণিক বার্তা এমন আঙ্গিক থেকে কোনো বিষয়কে উপস্থাপন করে, যা অন্যদের থেকে আমাদের পৃথক করে। 

সংবাদপত্রকে বলা হয় ইতিহাসের প্রথম খসড়া। সংবাদপত্রের পাতায় আজ যে তথ্য প্রকাশ হলো তা অনেক বছর পর ইতিহাস রচনার উপাদান। তাই আমরা কনটেন্টের মান ও নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিতে সদাসতর্ক। আমরা দেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে যখন সংবাদ প্রকাশ করি তখন তথ্যের সঙ্গে বিশ্লেষণও হাজির করি যেন নীতিনির্ধারক ও পাঠকরা ভবিষ্যৎ চিত্রটি দেখতে পান। প্রতিদিন দেশী-বিদেশী অসংখ্য সংবাদপত্র, অনলাইন সাইট সংবাদ প্রকাশ করছে। এমন বিশ্বে নতুন প্রেক্ষিত থেকে সংবাদ ও বিশ্লেষণ হাজির করতে না পারলে পাঠকের মনোযোগ পাওয়া কঠিন। আমরা বলতে পারি বণিক বার্তার কনটেন্ট দেশের সচেতন পাঠকের কাছে প্রশংসা, মনোযোগ পেয়েছে। বড় প্রচারসংখ্যার দাবি না করলেও এটা বলতে পারি যে এক যুগে আমরা বিশ্বস্ত একটি পাঠক গোষ্ঠীকে পাশে পেয়েছি। তারা পাশে আছেন বলেই আমরা দীর্ঘ যাত্রার স্বপ্ন দেখতে পেরেছি। 

১৩ বছরে পদার্পণের এই দিনে বণিক বার্তার পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা, এজেন্ট, হকার ও শুভানুধ্যায়ীদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। যে কথা দিয়ে শেষ করতে চাই—পাঠকের সমর্থন আমাদের স্বাধীন সাংবাদিকতার সুযোগ করে দিয়েছে। আমাদের সব পাঠককে আন্তরিক ধন্যবাদ; আপনারা এক যুগ ধরে আস্থা, ভালোবাসা নিয়ে পাশে না থাকলে আমাদের এ অর্জন সম্ভব হতো না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন