আর্থিক হিসাবে ঘাটতি

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা নাকি অর্থনৈতিক সংকট

মেহেদী হাসান রাহাত

একটি দেশের আন্তর্জাতিক সম্পদের মালিকানা বাড়া বা কমার বিষয়টি পরিমাপ করা হয় ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বা আর্থিক হিসাবের মাধ্যমে। এ হিসাবে ঘাটতি তৈরি হলে দেশের রিজার্ভ ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ বাড়ে। চলতি শতকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ সময়ই বাংলাদেশের আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত থাকতে দেখা গেছে। বিষয়টি অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করলেও এতে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরোক্ষ হলেও প্রভাব থাকে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, এখন পর্যন্ত যেসব বছরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, সেসব বছরের পুরো সময়েই আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দেখা গেছে। আবার বরাবরই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বছরগুলোয় আর্থিক হিসাব ছিল উদ্বৃত্তের ঘরে।

লেনদেন ভারসাম্য বা ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) তিনটি উপাদান হলো চলতি হিসাব (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট), মূলধন হিসাব (ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট) ও আর্থিক হিসাব (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট)। ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের আবার দুটি উপহিসাব রয়েছে। এগুলো হলো একটি দেশের বিদেশী সম্পদের স্থানীয় মালিকানা এবং স্থানীয় সম্পদের বিদেশী মালিকানা। যদি বিদেশী সম্পদের স্থানীয় মালিকানার পরিমাণ বাড়ে, তাহলে সার্বিকভাবে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টও বাড়ে। অন্যদিকে স্থানীয় সম্পদের বিদেশী মালিকানা বাড়লে সার্বিকভাবে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট কমে। একইভাবে স্থানীয় সম্পদের বিদেশী মালিকানা কমলেও সার্বিক ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বাড়ে। এর মাধ্যমে একটি দেশের আন্তর্জাতিক সম্পদ পরিমাপ করা যায়। ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট হিসাবের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই), পোর্টফোলিও বিনিয়োগ, অন্যান্য বিনিয়োগ এবং রিজার্ভ অ্যাসেট বিবেচনা করা হয়ে থাকে। অন্যান্য বিনিয়োগের মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক সহায়তা, সরকারের মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, ঋণের কিস্তি পরিশোধ, বাণিজ্যিক দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ, ট্রেড ক্রেডিট বা রফতানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ এবং অন্যান্য সম্পদ ও দায়। রিজার্ভ অ্যাসেটের অনুষঙ্গগুলো হলো স্বর্ণ, এসডিআর, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ইত্যাদি।

বিগত ২০০১-০২ থেকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ সময়ের মধ্যে দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ঘাটতিতে ছিল ২০০৫-০৬, ২০০৭-০৮, ২০০৮-০৯ এবং ২০০৯-১০ অর্থবছরে। ২০১০-১১ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত এটি উদ্বৃত্ত ছিল। সর্বশেষ চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে আবার ঘাটতি তৈরি হয়। 

২০০৫-০৬ অর্থবছরে অন্যান্য বিনিয়োগ খাতে ঘাটতির প্রভাবে দেশের আর্থিক হিসাবেও ১৪ কোটি ১০ লাখ ডলার ঘাটতি দেখা দেয়। অন্যান্য বিনিয়োগের মধ্যে এ সময় মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিশোধ, অন্যান্য নিট দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ, অন্যান্য সম্পদ এবং ট্রেড ক্রেডিটে ঘাটতি ছিল। ২০০৭-০৮ অর্থবছরেও অন্যান্য বিনিয়োগ খাতে ঘাটতির কারণে আর্থিক হিসাবে ৪৫ কোটি ৭০ লাখ ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়। অন্যান্য বিনিয়োগের মধ্যে এ সময় মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিশোধ, অন্যান্য নিট দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ, অন্যান্য সম্পদ এবং ট্রেড ক্রেডিটে ঘাটতি ছিল।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ও অন্যান্য বিনিয়োগ খাতে ঘাটতির প্রভাবে আর্থিক হিসাবে ৮২ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঘাটতি তৈরি হয়। অন্যান্য বিনিয়োগের মধ্যে এ সময় মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিশোধ, অন্যান্য নিট দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ, অন্যান্য সম্পদ এবং ট্রেড ক্রেডিটে ঘাটতি ছিল। ২০০৯-১০ অর্থবছরে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ও অন্যান্য বিনিয়োগ খাতে ঘাটতির প্রভাবে আর্থিক হিসাবে ৭৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার ঘাটতি তৈরি হয়। অন্যান্য বিনিয়োগের মধ্যে এ সময় মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিশোধ, অন্যান্য নিট দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, অন্যান্য সম্পদ এবং ট্রেড ক্রেডিটে ঘাটতি ছিল।

তথ্য বিশ্লেষণে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতির সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার বড় সংযোগ দেখা গেছে। বিষয়টিকে উড়িয়ে দিতে পারছেন না বিশ্লেষকরাও। যেসব বছরে দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ঘাটতিতে ছিল; সেসব বছরের ইতিহাস ঘেঁটে তারা বলছেন, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সঙ্গে প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছিল। আবার ২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ অর্থবছরেও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ, দুই নেত্রীকে কারাবন্দি, জাতীয় নির্বাচন এসব ইস্যুতে বড় এক ধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের পরই বিডিআর বিদ্রোহ এবং দেশের শেয়ারবাজারে ধসের মতো বিষয়গুলো সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি ও বিনিয়োগ পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলেছিল। সর্বশেষ চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে মতবিরোধ চরম পর্যায়ে রয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচন ইস্যুতে বিদেশী কূটনৈতিকদের তৎপরতা। 

আবার এর সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থনীতিকে সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে মূলত জ্বালানি তেলের ঊর্ধ্বমুখিতা, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি ও টাকার অবমূল্যায়নের মতো ইস্যুগুলোও। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম নয় মাস (জুলাই-মার্চ) শেষে দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২১ কোটি ৬০ লাখ ডলারে। যেখানে এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে এক্ষেত্রে ১ হাজার ১৯২ কোটি ৫০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। এজন্য মূলত রফতানির বিপরীতে দেশে অর্থ প্রত্যাবাসিত না হওয়া, স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ নবায়ন না হওয়ার পাশাপাশি নিট বিদেশী সহায়তা, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণ এবং এররস অ্যান্ড অমিশনস খাতে অর্থের বহিঃপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ার প্রভাবেই ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে নিট ট্রেড ক্রেডিট বা রফতানির বিপরীতে অর্থ প্রত্যাবাসনের ঘাটতি ছিল ৩১৯ কোটি ৮০ লাখ ডলারে। এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে এক্ষেত্রে ৬৭ কোটি ২০ লাখ ডলার ঘাটতি ছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত ছিল ২৯৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার। যেখানে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ১৬৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এররস অ্যান্ড অমিশনস খাতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের নয় মাসে ২৫৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার ঘাটতি হয়েছে। যেখানে এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে ঘাটতি ছিল ৮৪ কোটি ডলার।

দেশে বৈদেশিক সহায়তার নিট প্রবাহ উদ্বৃত্ত থাকলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে এর পরিমাণ কমে গেছে। এ সময়ে বৈদেশিক সহায়তা খাতে উদ্বৃত্ত ছিল ৩৭৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। যেখানে এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে উদ্বৃত্তের পরিমাণ ছিল ৫৪৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার। একইভাবে ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে ৬৬১ কোটি ৬০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল। এটি চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমে ৫০১ কোটি ৭০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আমাদের চলতি হিসাবে ঘাটতি কমেছে, কিন্তু ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের ঘাটতি বেড়ে গেছে। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে ডলারের সংকট রয়ে গেছে। আমাদের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট সব সময়ই উদ্বৃত্ত থাকত। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে এতেও ঘাটতি থাকবে। এর কারণে আমাদের ট্রেড ক্রেডিটে নেতিবাচক বহিঃপ্রবাহ দেখা যাচ্ছে। মূলত জাহাজে পণ্য উঠলেও এর বিপরীতে যে পরিমাণ ডলার দেশে আসার কথা, সেটি আসছে না। এ কারণে ট্রেড ক্রেডিট নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। আমাদের স্বল্পমেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রেও একটি বড় বহিঃপ্রবাহ দেখা যাচ্ছে। এর মানে হচ্ছে করপোরেট ও ব্যাংকগুলো তাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত বা চলতি মূলধন খাতে বিদেশী মুদ্রায় স্বল্পমেয়াদে যেসব ঋণ নিয়েছেন, সেগুলো আর নবায়ন হচ্ছে না। ঋণের অর্থ পরিশোধের পর এর বিপরীতে যে নতুন ঋণ আসবে, সেটিও হচ্ছে না।তারপর আমাদের নিট বিদেশী সহায়তা ইতিবাচক থাকলেও আগের বছরের তুলনায় এর পরিমাণ কমেছে। মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণও কমেছে। তাছাড়া এররস অ্যান্ড অমিশনস খাতে বড় অংকের অর্থ বহিঃপ্রবাহ হয়েছে। এটির কোনো হিসাব নেই। এসব কারণে আমাদের রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়েছে। পুরো বছরেই এ চাপ থাকবে কিনা সেটি নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং আসন্ন মুদ্রানীতিতে বিনিময় হার ও সুদের হারের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে তার ওপর।’ 

দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে বড় অংকের ঘাটতি চিন্তায় ফেলেছে সরকারকেও। রিজার্ভের পরিমাণ বাড়াতে হলে এ হিসাবে আগের মতো উদ্বৃত্ত অবস্থায় ফিরে যেতে হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বিগত বছরগুলোয় সব সময় উদ্বৃত্ত ছিল। কিন্তু এ বছর এটি প্রথমবারের মতো ঘাটতি হয়েছে। আমাদের মূল কাজ এখন এটিকে উদ্বৃত্ত করা। এজন্য বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট উদ্বৃত্ত হয়ে গেলে আমাদের রিজার্ভও বাড়তে থাকবে।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে দেশে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) নিট প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ১৩৪ কোটি ১০ লাখ ডলারে। যেখানে এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে এফডিআইয়ের নিট প্রবাহ ছিল ১৬৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ সময়ে এফডিআইয়ের নিট প্রবাহ কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের নয় মাসে নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ছিল ঋণাত্মক ৪ কোটি ১০ লাখ ডলার। যেখানে এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ঋণাত্মক ১১ কোটি ডলারে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুসারে চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে রফতানি হয়েছে ৫ হাজার ৫২ কোটি ৭২ লাখ ২৪ হাজার ডলারের পণ্য। গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয়েছিল ৪ হাজার ৭১৭ কোটি ৪৬ লাখ ৩০ হাজার ডলারের পণ্য। এ হিসেবে ১১ মাসে পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। এদিকে চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে দেশে ১ হাজার ৬০৩ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। যেখানে এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ১ হাজার ৫২৯ কোটি ৮৩ লাখ ডলার। এ সময়ে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ। রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সে ভালো প্রবৃদ্ধি হলে দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের অবস্থার উন্নতি হবে বলে মনে করছে সরকার।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল হয়ে আসছে। পাশাপাশি রফতানি ও রেমিট্যান্স বাড়লে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বাড়বে এবং কারেন্ট অ্যাকাউন্টের ব্যবধান কমে আসবে বলে আশা করি। আসন্ন মুদ্রানীতিতে পলিসি রেট, বিনিময় হার, মুদ্রার সরবরাহের বিষয়ে বক্তব্য থাকবে। এর সবগুলোই ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমরা এসব বিষয় মাথায় রেখেই নীতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি অর্থবছরের শুরুর দিন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার। সেটি কমতে কমতে এখন ২৯ বিলিয়নের ঘরে নেমে এসেছে। অর্থবছর শেষ হওয়ার এক মাস বাকি থাকতেই রিজার্ভের ক্ষয় ১২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগামী অর্থবছরে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান। ডলার সংকটের কারণে দেশের অনেক ঋণপত্রের (এলসি) দায় যথাসময়ে পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এলসি দায় পরিশোধ করতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় জ্বালানি তেল, গ্যাস, কয়লাসহ ভোগ্যপণ্য আমদানি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। সরকারের মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য উপকরণ আমদানি করতে গেলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। আর্থিক হিসাবের ঘাটতি আরো বাড়লে রিজার্ভের ওপরও চাপ আরো বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যেহেতু বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ খুব কম, সেহেতু বড় ধরনের ঋণ পরিশোধের চাপ এবং এর সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি ঋণ যোগ হলে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ঋণাত্মক হয়ে যায়। এটি আমাদের অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতা। স্বল্পমেয়াদি ঋণ, বহুপক্ষীয় ঋণ ও ট্রেড ক্রেডিট তো বটেই, এগুলো যখন একসঙ্গে ধাক্কা দেয় তখন ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ঋণাত্মক হয়ে যায়। আপনি এটিকে রাজনৈতিক শাসনামলের সঙ্গে মিলিয়ে বলতে পারেন ঘটনাক্রমে। মূলত বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক চক্রের মধ্য দিয়ে যায়, সেটির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এটি আসে। বৈশ্বিক সুদের হার বাড়তে থাকলে এ ঘাটতির পরিমাণ বাড়তে থাকে, বর্তমানে যেমনটা দেখা যাচ্ছে। রিজার্ভের সঙ্গে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। ফলে এক্ষেত্রে ঘাটতি বাড়তে থাকলে আমাদের রিজার্ভও কমতে থাকবে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ওপর চাপ পড়বে এবং বৈদেশিক ঋণের ব্যয় বেড়ে যাবে।’ 

বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতির সঙ্গে আর্থিক হিসাবের ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণের স্টক পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সাল শেষে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৮২১ কোটি ডলার। এর পরের ২০২০ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৯১৩ কোটি ডলারে। তবে ২০২১ সালে এটি বেড়ে ১ হাজার ৫৪৬ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০২২ সাল শেষে দেশের বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণ আরো বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৬৪২ কোটি ডলারে। সর্বশেষ চলতি বছরের এপ্রিল শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৮৭ কোটি ডলারে। 

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগের অর্থবছরগুলোয় আর্থিক হিসাবে ঘাটতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রভাব থাকার সম্ভাবনা থাকলেও চলতি অর্থবছরে ঘাটতির জন্য দেশের অর্থনীতির ওপর বাহ্যিক প্রভাবগুলোকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি এবং আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক মো. সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রফতানি খাতের উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী কিছু সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। যেমন তৈরি পোশাকের নতুন বাজারের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেয়া হয়েছিল। এ প্রণোদনাগুলো বেশ কাজে লেগেছে। বর্তমানে নতুন বাজারের ২০ শতাংশের বেশি বাজার অংশীদারত্ব আমাদের। এ কারণেই ২০১০-১১ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের হিসাবে আপনি উদ্বৃত্ত দেখছেন। কিন্তু চলতি অর্থবছরে সমস্যাটা হয়েছে যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরই জ্বালানি তেলের দাম অনেক বেড়ে গেল, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতা, সবখানেই কিন্তু মূল্যস্ফীতি দেখা গেছে এবং স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে তিনবার সুদহার বাড়াতে হয়েছে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এগুলোর প্রভাব পড়ে। রাজনৈতিক নয়, বরং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আমাদের এখানে এফডিআই আকৃষ্ট হচ্ছে না। এরশাদ সরকারের সময়, বিএনপির শাসনামলের শেষদিকে এবং ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যে ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল, সে অবস্থা কিন্তু বর্তমানে নেই। ফলে সে সময় ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব থাকতে পারে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, সেটির জন্য বাহ্যিক ঝুঁকিগুলোই দায়ী।’ 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন