
ছাপচিত্র ও সফিউদ্দীন আহমেদ একসঙ্গেই উচ্চারিত হয়। বাংলাদেশে আধুনিক ছাপচিত্রের জনক তিনি, এর যথেষ্ট কারণ অসংখ্যবার লেখা হয়ে গেছে আমাদের শিল্প ইতিহাসে। পারফেকশনিস্ট এ শিল্পী ‘শিল্পগুরু’ অভিধা পেয়েছিলেন জীবদ্দশায়। তার নামে প্রতিষ্ঠিত সফিউদ্দীন শিল্পালয় আয়োজন করেছে ‘সফিউদ্দীন ছাপচিত্র উৎসব ২০২৩’।
এবার বসেছে উৎসবের দ্বিতীয় আসর। উপলক্ষটাও গুরুত্বপূর্ণ। এ বছর পালিত হচ্ছে শিল্পগুরুর জন্মশতবার্ষিকী। এ আয়োজনে নবীন-প্রবীণসহ ৫১ জন শিল্পীর কাজ স্থান পেয়েছে। উডকাট, লিথোগ্রাফ, এচিং, রিলিফ ওয়ার্ক বা মিশ্র মাধ্যম; নানা ধরনের শিল্পকর্মের সমাহার এ প্রদর্শনী।
চিত্রকর্ম হিসেবে ছাপচিত্র এখনো বাংলাদেশে অবহেলিত। যদিও এ মাধ্যম অনেক আগে থেকেই আমাদের দৈনন্দিনতার সঙ্গে মিশে গেছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশের সমকালীন ছাপচিত্রীদের সঙ্গে পরিচয় ও তাদের কাজ সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে এ উৎসবের গুরুত্ব অনেক। পাশাপাশি আমাদের মাস্টার পেইন্টারদের কাজ থাকায় বিষয়, পরিসর ও আঙ্গিকগতভাবে বোঝাপড়ার একটা মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে ছাপচিত্র উৎসব।
উৎসবের চত্বরটিও গুরুত্বপূর্ণ। যার লাগোয়া সফিউদ্দীন সংগ্রহশালা। সেখানে শুধু তার আঁকা ছাপচিত্র বা ক্যামেরায় তোলা ছবি নয়, তার ব্যবহৃত উপকরণ ও আনুষঙ্গিক বিষয়বস্তু স্থান পেয়েছে। সফিউদ্দীন তার কাজের বিষয়ে কতটা সূক্ষ্মদর্শী ছিলেন, সেখান থেকে বোঝা যায়।
উৎসবে ঠাঁই পেয়েছে প্রায় ২০০ ছাপচিত্র। বিচিত্র বিষয়াদির মধ্যে কমন কিছু মোটিফ লক্ষ করা গেলেও সময়ের দিক থেকে আলাদা করা যায় এসব কাজ। যাপিত জীবনের নানান দিক দৃশ্য বা প্রতীকীভাব উঠে এসেছে। গ্রামীণ জীবন, নিসর্গ, নারী কিংবা প্রাণী আদলগুলো সৌন্দর্যের উপস্থাপন হিসেবে মুগ্ধকর। আবার খুব কম ক্ষেত্রে আমাদের সময় ও রীতিনীতির ক্রিটিক আকারে বিবেচনা করতে পারি। দৃশ্যগত উপস্থাপনা বা সৌন্দর্য মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।
গ্যালারিতে ঢোকার পর পরই হাতের ডান পাশে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন থেকে শুরু করে কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ, রশিদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, দেবদাস চক্রবর্তী, মোহাম্মদ কিবরিয়া, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, রফিকুন নবী, মনিরুল ইসলাম, শহীদ কবির, আবুল বারক আলভীদের কাজ।
মা ও শিশুর ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় জয়নুল আবেদিনের উডকাটের চিত্রকর্মে, ১৯৪০ সালে এঁকেছিলেন তিনি। মেঝেতে বিছিয়ে রাখা মাদুরে বসে হুক্কা টানছেন শিক্ষক, আর বই ও স্লেট নিয়ে বসে আছে এক কিশোর। লিথোগ্রাফ মাধ্যমে কামরুল হাসান ছবিটি এঁকেছিলেন ১৯৪৫ সালে। আছে শিল্পগুরু সফিউদ্দীনের এচিং; যেখানে বৈচিত্র্যময় ফর্ম ও টেক্সচারের সম্মিলন ঘটেছে। সঙ্গে মুর্তজা বশীরের আঁকা ছোট্ট নারীর মুখসহ অন্যদের কাজ।
অন্যদিকে বিপরীতে দেয়ালে শোভা যাচ্ছে শিল্পী সাদেক আহমেদের রিকশাকেন্দ্রিক সিরিজ। তিনটি ডিজাইনকে প্রাধান্য দিয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে মোট নয়টি ছবির এ সিরিজ। রিকশা ও মহানগরের মানুষের ভাবনা ও মিথস্ক্রিয়াকে তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে রিকশার আদলে খোদ মহানগরেরই রূপান্তর ঘটে উডকাটে। চিত্রম সেন অনিকের ‘সুরিয়েল’ শিল্পীকর্মে আরেক ধরনের রূপান্তর ধরা পড়ে। সেরিগ্রাফি মাধ্যমে করা এই চিত্রকর্মে শিকারি বিড়াল ও শিকার মাছ রয়েছে উল্টো ভূমিকায়। আবার আনিসুজ্জামানের শেষ হেমন্তের দিগন্তজোড়া মাঠের সিরিজটি মন জুড়াবে। দুটি ছবিতে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার ও স্থানিক মাত্রা বেশ সূক্ষ্ম। শাকিল মৃধা উডকাটে করা চার ছবির সিরিজে মৌলিক আকারগুলোকে ভেঙেচুরে দৈনন্দিন জীবনের চিত্র তুলে ধরেছেন, যার দুটোর শিরোনাম জেলেনী ও রাঁধুনী। সুশান্ত কুমার অধিকারী মানুষের মুখাবয়বের ভেতর তুলে ধরেছেন বিভিন্ন মুহূর্ত। উডকাটের ল্যান্ডস্কেপে জয়িতা বসতি ও বাজারের দুটি দৃশ্য তুলে ধরেছেন, যা সাদেক আহমেদের রিকশাচিত্রের মতো। হুট করে মনে করিয়ে দিতে পারে এসব ছবির গল্পে আবহমান বাংলার চেনা চিত্র বিদ্যমান, তার বাইরে আধুনিক সময়কে তুলে ধরতে হয়তো অনিচ্ছুক শিল্পীরা। যাকে আমরা শুধু আঙ্গিকের মুনশিয়ানা বা বিষয়ের মানসিক অভিব্যক্তির ভেতর দিয়ে দেখি। কিন্তু এই যাপিত জীবন ও তার সংকট শুধু অভিব্যক্তির ঘটনাই নয়, দৃশ্যগতভাবেও তাৎপর্যপূর্ণ। প্রতীকী ব্যঞ্জনার বাইরে এর উপস্থিতি নেই আয়োজনে। শিল্পীরা যেন এক ছদ্ম দুনিয়ায় থাকেন!
প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া সমকালীন শিল্পীদের মধ্যে আরো রয়েছেন শাম্মি ইয়াসমিন, মুসলিম মিয়া, আহমেদ নাজির, রিফাত জাহান কান্তা, রুজবেল বেঞ্জামিন ডি রোজারিও, এএইচ ঢালী তমাল, আসমিতা আলম শাম্মি, মানসী বণিক, ঝোটন চন্দ্র রায়, আব্দুল হালিম, ফারহানা ববি প্রমুখ।
২ জুন বিকালে প্রধান অতিথি হিসেবে উৎসব উদ্বোধন করেন চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী। ছিলেন সৈয়দ আবুল বারক আলভী ও আনিসুজ্জামানসহ আরো অনেকে। উৎসব চলবে ১৩ জুন পর্যন্ত।