মে মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯.৯৪ শতাংশ

মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে

মূল্যস্ফীতি স্মরণকালের সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে রয়েছে। চলমান অর্থনৈতিক ঘাটতির ফলে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির দেখা মিলেছে গত মে মাসে। মূল্যস্ফীতির তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এক বছর ধরেই মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে বিশ্ববাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমলেও এর প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে পড়ছে না।

এ রকম পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার বিকল্প নেই বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বণিক বার্তায় প্রকাশ, দেশে মে মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যা ১১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এ তথ্য জানিয়েছে। এর আগে ২০১২ সালের মার্চে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। এরপর আর কখনো ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের মূল্য প্রকাশের এ সূচক দুই অংকের ঘরে যায়নি। পরের মাসেই মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে নেমে আসে।

বিবিএসের তথ্যমতে, খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি খাদ্যবহির্ভূত দ্রব্যের দামও গড় মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। গত বছর একই সময়ে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। তিন মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ধারায় রয়েছে। চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, সবজি, মসলা ও তামাকজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে বলে বিবিএস জানিয়েছে।

এছাড়া বাড়ি ভাড়া, আসবাব, গৃহস্থালি, চিকিৎসাসেবা, পরিবহন ও শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়তি রয়েছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত উভয় ক্ষেত্রের মূল্যস্ফীতিই এ সামগ্রিক বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে। 

চলমান পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকার গড়ে ৬ শতাংশে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখার লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেই উল্লেখ করে এটিকে বাজেটের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হিসেবে দেখছে গবেষণা সংস্থাগুলো। কোনো নির্দিষ্ট মাসে বাজারে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার মূল্যসূচক আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কতটুকু বাড়ল, তার শতকরা হার পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করা হয়। বিভিন্ন পণ্য ও সেবা বাবদ মানুষের খরচের হিসাবের ভিত্তিতে প্রতি মাসের ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) তৈরি করে বিবিএস। গ্রাম, শহর ও সিটি করপোরেশনের ১৫৪টি বাজার থেকে নেয়া ৭৪৯ ধরনের ৩৮৩ আইটেমের পণ্যমূল্যের তথ্যের ভিত্তিতে এ মূল্যসূচক নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু সরকার মূল্যস্ফীতি নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারেনি।

সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতির এ প্রতিবেদন বেশ হতাশাজনক। এভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ার ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে। ডাল, চিনি, তেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভোগ্যপণ্যের মজুদ সীমিত পরিমাণে রয়েছে। এর সঙ্গে ডলার সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। সম্প্রতি আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়ার পর পেঁয়াজের দাম কমে আসে। যা বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়। এক্ষেত্রে বাজার অর্থনীতিতে অবশ্যই সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি উঠে আসে। মূল্যস্ফীতির কারণ হিসেবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা প্রকৃত অর্থে যৌক্তিক নয়। মূলত মূল্যস্ফীতির জন্য অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনাই দায়ী। যুদ্ধের অভিঘাতের মধ্যেই বাংলাদেশের সমপর্যায়ের দেশ কিংবা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশই অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সফলভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে।

যেমন থাইল্যান্ডে মূল্যস্ফীতি গত বছরের জুনের ৭ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে এ বছর এপ্রিলে ২ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ৯ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। এমনকি ভিয়েতনামের মূল্যস্ফীতিও ২ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে নেমে এসেছে। এ দেশগুলোর উদাহরণ থেকে আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে করণীয় ঠিক করা যেতে পারে।

এক্ষেত্রে সঠিক পথে দেশের অর্থনীতি পরিচালিত হচ্ছে কিনা সেটি নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে প্রস্তাবিত বাজেটের কিছু পদক্ষেপ আগামীতে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়িয়ে দিতে পারে এমন শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও সারের মূল্য কমার প্রভাব দেশের বাজারে পরিলক্ষিত হচ্ছে না, যা দুঃখজনক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য জ্বালানির মূল্য সমন্বয় ও খাদ্য সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আগামী দিনে সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন হবে। বছরের শেষ দিকে কৃষিতে ভালো ফলনের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে এ আশা করা হচ্ছে, কিন্তু কৃষি উৎপাদন ব্যয় যদি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তাহলে এক্ষেত্রে প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠবে।

সব মিলিয়ে চলমান তীব্র মূল্যস্ফীতি দেশের অর্থনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর এ সংকট ব্যাপক চাপ তৈরি করেছে। অর্থনীতির ভাষায় মূল্যস্ফীতিকে বলা হয় এক ধরনের কর, যা ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার ওপর আরোপ হয়। তবে মূলত সীমিত আয়ের মানুষেরা এর চাপে পড়ে। মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির একটি স্বাভাবিক চিত্র হলেও বড় ধরনের মূল্যস্ফীতিকে অর্থনীতির জন্য অভিঘাত হিসেবে দেখা হয়।

মূল্যস্ফীতির প্রভাবে সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি আরেক শ্রেণী লাভের মুখ দেখে। তবে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিস্থিতি লাঘবে তৎপর হলে তা খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রায় প্রতিটি দেশই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে, যার বাস্তব প্রমাণ ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এর সঙ্গে বেকারত্ব তৈরির ফলে স্টাগফ্লেশন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, যা অর্থনীতির জন্য আরো বিপজ্জনক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কর্মসংস্থানের ঘাটতি দেখা দিলে এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। তাই মূল্যস্ফীতির ধকল থেকে সবকিছু সামলে নিতে এখনই সময়োপযোগী ও ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থার অনিয়ম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার বিকল্প নেই। আমরা প্রত্যাশা করব সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন