রংপুরে তিনটি ফসলের পরীক্ষামূলক চাষাবাদ

সারের সুষম ব্যবহারে ১৪-২৬ শতাংশ ফসল উৎপাদন বাড়বে

এসএম পিয়াল, রংপুর

রংপুরে মাটি পরীক্ষার পর সারের সুষম ব্যবহারে সাফল্য পেয়েছে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বিভাগীয় কার্যালয় ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

রংপুরে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট নির্দেশিত পদ্ধতিতে বিভিন্ন শস্যের পরীক্ষামূলক চাষাবাদ (প্রায়োগিক ট্রায়াল প্লট) কৃষকের মাঝে সাড়া ফেলেছে। দুই অর্থবছরে (২০২১-২২ ও ২০২২-২৩) জেলায় ধান, আলু ও সরিষা আবাদে সাতটি ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হয়েছে। 

মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সারের সুষম ব্যবহারই হলো এ চাষ পদ্ধতি। এতে চাষাবাদে কৃষকের প্রচলিত ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে। তারা জমিতে বিভিন্ন ফসল আবাদে নির্দিষ্ট সময় সুষম সার প্রয়োগের অভিজ্ঞতা যেমন অর্জন করছেন, তেমনি প্রচলিত আবাদের চেয়ে কম খরচে বেশি ফলন পাচ্ছেন। মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সারের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে সারের অপচয় অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব বলে দাবি করেছেন কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষক। 

মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের কালীগঞ্জ পাড়ার কৃষক মো. আজিজার রহমান জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রোপা আমন মৌসুমে এক বিঘা করে তার দুটি জমি নির্বাচন করা হয়। একটিতে তিনি দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা থেকে ধান (বিআর-১১) চাষ করেন। অন্যটিতে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট নির্দেশিত পন্থায় বীজ বপন ও চারা রোপণ করা হয়। তিনি নিজস্ব পদ্ধতিতে আবাদে ২০ কেজি ইউরিয়া, ডিএপি ১০ কেজি এবং এমওপি ১৫ কেজি ব্যবহার করেছেন। সেখানে মৃত্তিকা ইনস্টিটিউট নির্দেশিত প্লটে জমির মাটি পরীক্ষা করে চারা রোপণ থেকে ধানা কাটা পর্যন্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়েছিল ১৪ কেজি, এমওপি ৭ কেজি, টিএসপি ৪ কেজি, জিপসাম ২ কেজি এবং দস্তা ৫০০ গ্রাম। পরে মৃত্তিকা ইনস্টিটিউট নির্দেশিত প্রায়োগিক প্লট থেকে ধান পেয়েছেন ১৯ মণ আর নিজস্ব পদ্ধতিতে আবাদি জমি থেকে ধান পেয়েছেন ১২ মণ।

দুটি প্লট থেকে দুই রকম ফল পাওয়ায় কৃষক আজিজার রহমান এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন, প্রচলিত পদ্ধতিতে ধান আবাদে তারা ইচ্ছামতো সার প্রয়োগ করেছেন। আবার অজ্ঞতার কারণে জমির প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করেননি। অর্থাৎ এতদিন তারা আবাদে সঠিক নিয়ম প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, তারা আবাদে কখনো দস্তা এবং জিপসাম সার ব্যবহার করেননি। আবার নন-ইউরিয়া সার এমওপি একবার ব্যবহার করেছেন। এছাড়া জমি তৈরির পর সাধারণত প্রচলিত নিয়মে সবাই চারা রোপণের পর ইউরিয়া সার ব্যবহার করেন। কিন্তু মৃত্তিকা নির্দেশিত প্লটে আগে সার জমিতে প্রয়োগ করা হয়। পরে চারা রোপণ করা হয়। কৃষক আজিজার রহমান আসন্ন আমন মৌসুমে নতুন পদ্ধতিতে দেড় থেকে দুই একর জমিতে ধান চাষ করার প্রস্তুতি নিয়েছেন। তবে এবার তিনি শুধু একা নন, কালীগঞ্জপাড়ার আরো অনেক কৃষক মৃত্তিকা ইনস্টিটিউট নির্দেশিত নিয়মে ধান আবাদ করবেন বলে জানা গেছে। 

কাউনিয়া উপজেলার মর্ণেয়া ইউনিয়নের কুর্শা এলাকার কৃষক খায়রুল ইসলাম এক বিঘা করে দুটি জমিতে বারি সরিষা-১৪ আবাদ করেন। একটি জমিতে তিনি প্রচলিত পদ্ধতিতে সার প্রদান ও পরিচর্যা করেন অন্যটিতে মৃত্তিকা ইনস্টিটিউট নির্দেশিত সার প্রদান করা হয়। জমিতে বীজ বপন করা হয় গত বছরের ২ ডিসেম্বর এবং ফসল সংগ্রহ করা হয় চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি। ফলন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দেখা গেছে মৃত্তিকা নির্দেশিত জমিতে সরিষা পাওয়া গেছে প্রায়ে সাড়ে তিন মণ এবং অন্য জমিতে সরিষার ফলন পাওয়া গেছে আড়াই মণ।  

রংপুর সদর উপজেলা পীরজাবাদের কৃষক মো. আমিনুল ইসলাম গত বোরো মৌসুমে এক বিঘা জমিতে ব্রি ধান-২৮ আবাদে ইউরিয়া ব্যবহার করেছিলেন ৪০ কেজি আর মৃত্তিকা নির্দেশিত ওই পরিমাণ জমিতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করেন ২৪ কেজি। পীরগাছা উপজেলার  কল্যাণী ইউনিয়নের বড় হাজরা গ্রামের কৃষক অন্তেশ্বর চন্দ্র এক বিঘা জমিতে কার্ডিনাল জাতের আলু আবাদে ইউরিয়া সার ব্যবহার করেছিলেন ৬৫ কেজি। অথচ একই সময় মৃত্তিকা নির্দেশিত এক বিঘা জমিতে ইউরিয়ার ব্যবহার হয়েছে ৫৪ কেজি।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা খন্দকার তাহেরাতুল হোসনা বলেন, ‘অসচেতনতা হোক অথবা অজ্ঞতায় হোক কৃষক জমিতে সারের সুষম ব্যবহার করছেন না। তাই মাটি পরীক্ষা করে অথবা কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী ফসল আবাদ করতে হবে। এতে যেমন জমির স্বাস্থ্য ভালো থাকবে তেমনি ফসল উৎপাদন বাড়বে। পাশাপাশি সারের অপচয় রোধের মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদন খরচও কমবে। কৃষক যাতে মাটি পরীক্ষা করতে উদ্বুদ্ধ হয় এজন্য দুটি অর্থ বছরে ধান, আলু ও সরিষার সাতটি প্রায়োগিক ট্রায়াল প্লটের ব্যবস্থা করেছি আমরা। প্রতিটি ট্রায়ালে প্রচলিত আবাদের চেয়ে ১৪-২৬ শতাংশ ফলন বেশি হয়েছে। এছাড়া বেশকিছু মাঠ দিবস করে কৃষকের মাটি পরীক্ষার বিভিন্ন সুবিধা তুলে ধরা হয়েছে। যদি জমির শস্য বিন্যাস পরিবর্তন না করা হয় তাহলে একবার মাটি পরীক্ষা করলে সাধারণত তিন বছরে আর মাটি পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয় না। মাটি পরীক্ষার জন্য মাত্র ৬৩ টাকা নেয়া হয়।’ 

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, ‘মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে চাষাবাদ করলে সারের সুষম ব্যবহার যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি কৃষক কম খরচে কাঙ্ক্ষিত ফলন পাবেন। এজন্য আমাদের কৃষি বিভাগের লোকজন বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ে থাকা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকের মাটি পরীক্ষা উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি স্যাম্পল পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছেন। মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সব ধরনের সার বিশেষ করে আমদানিনির্ভর ইউরিয়া সারের ব্যবহার অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন