কর্মসংস্থানে দেশের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান নোমান গ্রুপ বিপদে

বদরুল আলম ও হাছান আদনান

দেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিক থেকে অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান নোমান গ্রুপ। গ্রুপটির আওতাভুক্ত ৩৬ প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষের। ইউরোপ-আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে বড় বাজার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল বস্ত্র শিল্প খাতের জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানটি। শীর্ষ রফতানিকারক হিসেবে বেশ কয়েকবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে নোমান গ্রুপের ফ্ল্যাগশিপ প্রতিষ্ঠান জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফ্যাব্রিকস লিমিটেড।  

যদিও প্রতিষ্ঠানটি এখন কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন নোমান গ্রুপের উদ্যোক্তা-কর্মকর্তারা। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎ-জ্বালানির সংকট এবং মূল্যবৃদ্ধিতে বেড়েছে উৎপাদন ব্যয়। কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে ডলারের বিনিময় হারে ঊর্ধ্বমুখিতায়। আবার প্রাপ্যতা সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে এ কাঁচামালেরও দাম বেড়েছে। উৎপাদনের সব অনুষঙ্গে ব্যয় বাড়লেও যুদ্ধসৃষ্ট মূল্যস্ফীতির কারণে পশ্চিমা বাজারগুলো থেকে আগের মতো ক্রয়াদেশ পাচ্ছে না নোমান গ্রুপ। দীর্ঘদিন ধরে বড় বিনিয়োগে শিল্প সক্ষমতা ক্রমেই বাড়ানো হলেও এখন এর অর্ধেকই অব্যবহৃত পড়ে আছে। ২০২১-২২ অর্থবছরেও প্রতিষ্ঠানটির রফতানির অর্থমূল্য ছিল ১২০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। বর্তমানে এটিও নেমেছে অর্ধেকে। প্রতিষ্ঠানটির অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরো চাপে ফেলে দিয়েছে জনবল ও অব্যবহৃত সক্ষমতা। তবে ব্যবসায়িক পরিবেশের বহিঃস্থ উপাদানগুলো নিয়েই নোমান গ্রুপের কর্ণধারদের দুশ্চিন্তা সবচেয়ে বেশি। নিকট ভবিষ্যতে কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়। 

বাংলাদেশ ব্যাংক এবং গ্রুপসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, নোমান গ্রুপের ২৩ প্রতিষ্ঠানের কাছে ৩৫টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ভালো গ্রহীতা হিসেবে এখনো কোনো ঋণ খেলাপ হয়নি প্রতিষ্ঠানটির। যদিও গ্রুপটির অনেক ঋণ এখন মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পথে। বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে খেলাপি হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন খোদ প্রতিষ্ঠানটির মূল প্রতিষ্ঠাতাও।  

নোমান গ্রুপ সূত্রে জানা গেছে, কারখানা পূর্ণ সক্ষমতায় সচল রাখতে পারলে বছরে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের রফতানি করতে পারে গ্রুপটি। এখন তা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানি ছিল ১২০ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ৬৫-৭০ কোটিতে নেমে এসেছে। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রয়োজনমতো গ্যাস পায়নি গ্রুপের কারখানাগুলো। ক্রয়াদেশ থাকলেও তখন পণ্য সরবরাহ করা যায়নি। লোকসান হয়েছে। 

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নোমান গ্রুপের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় কারণ হলো জ্বালানির দাম। দ্বিতীয়ত হলো জ্বালানি সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন না। এ কারণে ব্যবসার খরচ অনেক গুণ বেড়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদাও এখন অনেক কমেছে। এত বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিস্থিতি খারাপ হওয়াটা অর্থনীতির জন্য ভালো না। আবার এটাও ঠিক যে বড় বলেই শিল্পগুলো এখনো নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারছে। বড়রা একটা প্রকল্পের অর্থ দিয়ে অন্য প্রকল্প চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু ছোটগুলোর পরিস্থিতি আরো খারাপ। তারা ব্যাংকের সহযোগিতাও পাচ্ছে না। এ প্রেক্ষাপটে সংগঠনের পক্ষ থেকে ব্যাংকঋণের কিস্তি ও সুদ অন্তর্বর্তীকালীন হিসেবে আগামী জুন ২০২৪ পর্যন্ত ব্লক অ্যাকাউন্টে রাখার সুযোগ দেয়াসহ পরবর্তী সময়ে সহজ কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ সরকারের কাছে চাওয়া হয়েছে।’

গ্রুপটির কর্ণধারদের দাবি, সরকারের কাছে জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে চাওয়া এসব সুযোগ-সুবিধার দাবিতে সাড়া না পাওয়া গেলে আগামী ছয় মাস পর থেকে গ্রুপটির প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে খেলাপি হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে তা রাতারাতি না হয়ে পর্যায়ক্রমে ঘটতে পারে। 

নোমান গ্রুপের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটির ক্ষেত্রে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপের পরিণতির পুনরাবৃত্তির ভয় পাচ্ছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্যমতে, একসময় একক অবকাঠামো ও কর্মসংস্থান বিবেচনায় গোটা এশিয়ায় অন্যতম বৃহৎ উৎপাদন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপ। ২০২১ সালে বন্ধ হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। এর আগে দীর্ঘদিন ধরেই নগদ মূলধনের অভাব, ঋণ দায়, শ্রম অসন্তোষসহ নানামুখী সংকটে ভুগেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ সংকট বড় হয়ে দেখা দেয় কভিডের প্রাদুর্ভাবে। একপর্যায়ে বাধ্য হয়েই স্থায়ীভাবে উৎপাদন বন্ধের ঘোষণা দেয় ওপেক্স অ্যান্ড সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপ কর্তৃপক্ষ। বর্তমান পরিস্থিতিতে আরেক জায়ান্ট নোমান গ্রুপের পরিস্থিতিও দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি নিয়ে ভালো কোনো বার্তা বহন করছে না। 

রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এবং বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌নোমান গ্রুপের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার পক্ষে বলা সম্ভব হবে না। তবে বাংলাদেশে ছোট থেকে বড় অনেক কোম্পানির পরিস্থিতিই এখন নাজুক। ছোট-মাঝারিদের মধ্যে অনেকে এরই মধ্যে বন্ধ হয়েছে। বড় গ্রুপগুলোর মধ্যেও বেশ কয়েকটি আর্থিক ক্ষতি পোহাতে হিমশিম খাচ্ছে। এরই মধ্যে ওপেক্স অ্যান্ড সিনহার মতো বড় প্রকল্প বন্ধের ঘটনা আমরা দেখেছি। প্রকল্পটি এখনো চালু হতে পারেনি। বড় গ্রুপগুলো ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে। এখন তারা দেনার দায় বহন করতে পারছে না। তবে বড় বিনিয়োগকারীদের ভঙ্গুর হয়ে পড়া অর্থনীতির জন্য কোনো ভালো ইঙ্গিত বহন করে না। কারণ বড় প্রকল্পগুলোর অবদানও অর্থনীতিতে বড়।’

খাতসংশ্লিষ্টদের দাবি, দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখে আরো এগিয়ে নিচ্ছে বৃহৎ শিল্পগুলোই। সরকারি তথ্য-উপাত্তও বলছে, বৃহৎ এ প্রতিষ্ঠানগুলোই ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের মোট উৎপাদনে প্রায় ৭০ শতাংশ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু জ্বালানি সংকট, কাঁচামালের দামে ঊর্ধ্বগতি এবং উৎপাদন সক্ষমতা পূর্ণভাবে ব্যবহার করতে না পারায় বর্তমানে ব্যবসার চাপে রয়েছে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এ চাপে থাকাটা অর্থনীতির জন্য ভালো ইঙ্গিত নয়। বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর এ চাপ প্রশমন করতে না পারলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিই বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে।

নোমান গ্রুপের ৩৬টি শিল্প ইউনিট ঢাকার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে আছে। ৮০ হাজার শ্রমিকের মধ্যে ২০ হাজার আছে টঙ্গী এলাকায়। শ্রীপুর এলাকায় আছে ৩৫ হাজারের মতো শ্রমিক। সেখানে একই সীমানার মধ্যে ১৪টি শিল্প ইউনিট আছে। ৬৫০ বিঘা জমির ওপর গড়ে উঠেছে ইউনিটগুলো। জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফ্যাব্রিকসে হোম টেক্সটাইল পণ্য উৎপাদন হয়। সেটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম প্রকল্প। সেখানে শ্রমিক কাজ করেন ২০ হাজার। এছাড়া স্পিনিং মিলগুলোয়ও আছেন কিছু শ্রমিক।

গ্রুপটির বর্তমান পরিস্থিতিতে এ শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে আশঙ্কা। গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু আমাদের প্রতিষ্ঠানে নয়, সারা দেশের সব শিল্প নিয়েই আশঙ্কা রয়েছে। অর্থনীতিতে যখন উৎপাদন হবে না, তখন ব্যাংকও সংকটে পড়বে। সরকারের রাজস্ব আহরণ ব্যাহত হবে। বীমা কোম্পানি চলবে না। পরিবহন কোম্পানি চলবে না। কর্মসংস্থানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। ৪০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে যদি ২০ লাখের কর্মচ্যুতি ঘটে, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৮০ হাজারের মধ্যে ৪০ হাজারকে যদি রাখতে হয়, তাদের কয়দিন বেতন দিয়ে চলতে পারব? নিশ্চয়ই লে-অফ করতে হবে। ছাঁটাই করতে হবে। কর্মসংস্থান সবচেয়ে বড় জিনিস। ৪০ লাখ শ্রমিক মানে ৪০ লাখ পরিবার। এদের কিছু হলে কোনো কিছুর ওপর তাদের আস্থা থাকবে না। তারা রাস্তায় নেমে পড়বে। এটাই সবচেয়ে বড় ভয়ের বিষয়।’

নোমান গ্রুপ সূত্র জানিয়েছে, গ্রুপের মোট উৎপাদনের ৭০-৮০ শতাংশ পণ্য রফতানি হয়। স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মাসে রফতানি হয় ৯ কোটি ডলারের। বর্তমানে রফতানি হচ্ছে ৫ থেকে সাড়ে ৫ কোটি ডলারের। মূল ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে গন্তব্য দেশগুলোয় মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। কমেছে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা। এ পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটিকে ৫০ শতাংশ কম ক্রয়াদেশে কারখানা চালাতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত পণ্যের দামের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের মতো তুলা উৎপাদনকারী কয়েকটি দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারা যাচ্ছে না। দেশগুলোর তুলাসহ কাঁচামালের নিজস্ব সংস্থান আছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে রফতানি পণ্যের কাঁচামালের প্রায় পুরোটাই আমদানি করে আনতে হয়। এ আমদানিনির্ভরতার কারণে নোমান গ্রুপের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্তত ছয় মাসের কাঁচামাল মজুদ করতে হয়। বেশি পরিমাণে আমদানি করতে গিয়ে বহন করতে হয় বড় আকারের আর্থিক ব্যয়। আবার এসব কাঁচামাল মজুদ করে বীমা খরচও আছে। সব মিলিয়ে মজুদের জন্য বড় ধরনের আর্থিক ব্যয় এখন বোঝায় পরিণত হয়েছে। এছাড়া গত কয়েক মাসে শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বেড়েছে প্রায় ২৫০ শতাংশ। এতে নোমান গ্রুপের উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও রফতানি পণ্যের দাম বাড়েনি। আবার গ্যাসের দাম বাড়লেও প্রাপ্যতা নিশ্চিত হয়নি। কারখানায় দিনে ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকে না। এখন বিদ্যুৎও থাকছে না দীর্ঘ সময়। অটোমেটিং মেশিনে কাপড় প্রক্রিয়াজাত করতে হয় ৮ ঘণ্টা ধরে। এটুকু সময়ের মধ্যেই দুই-তিনবার বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন কাপড় প্রক্রিয়াজাত করার বিষয়টি আবার শুরু করতে হয়। এতে খরচ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।

গ্রুপের বর্তমান দুরবস্থার কথা স্বীকার করে প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, ‘‌সামগ্রিক পরিস্থিতি জানিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এবং সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারকে কিছু সুবিধা চেয়ে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সেগুলো গ্রহণ হওয়া প্রয়োজন। মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে এক বছরের মোরাটরিয়াম চাওয়া হয়েছে। এ খাতের সবার স্বার্থেই এ প্রস্তাব আমলে নেয়া প্রয়োজন। স্থানীয় বাজারের অবস্থাও এখন খুব খারাপ হয়ে গেছে। স্থানীয় বাজারের জন্য যে স্পিনিং মিলগুলো পণ্য বিক্রি করত, এখন সেগুলোর পাশাপাশি রফতানিমুখী মিলগুলোও স্থানীয় বাজারে পণ্য বিক্রি করছে। এতে পণ্যের দাম অনেক কমেছে। কিন্তু দাম পড়ে গেলে কী হবে? মানুষের কাছে এখন অর্থ নেই। জিনিসপত্রের দাম এতটা বেড়েছে যে কম দামেও মানুষ পণ্য কিনতে পারছে না। মাসের উপার্জন দিয়ে মানুষ উচ্চমূল্যে হলেও খাদ্য নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে। তারপর কাপড়ের কথা ভাবতে হচ্ছে। সঞ্চয় অনেক দূরের কথা।’

প্রকল্প পরিচালনার সার্বিক আর্থিক খরচ অনেক গুণ বাড়ায় ব্যাংকগুলোর পক্ষে এখন চাইলেও সহযোগিতা করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানালেন তিনি। তার বক্তব্য অনুযায়ী, ‘‌ব্যাংক চাইলেও আমাদের ব্যয়ের বোঝা বহনে সহযোগিতা করতে পারছে না। কারণ ব্যাংকের সহযোগিতার সীমা অতিক্রম করেছে। এখন সহযোগিতা করতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমাদের একটি স্পিনিং মিলকে আগে বছরে ৩ কোটি ডলারের রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) দেয়া হতো। সেটা এখন শূন্য করে দিয়েছে। ব্যাংক এখন অর্থায়ন করতে পারছে না।’

ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম। ঢাকায় এসে তৈয়ব আশরাফ টেক্সটাইল মিলস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এ প্রতিষ্ঠানের অধীনে আবার একাধিক প্রতিষ্ঠান ছিল। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম মরিয়ম টেক্সটাইল, আরটেক্স ফ্যাব্রিকস, নাজনীন ফ্যাব্রিকস। 

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম নতুন করে সবকিছু শুরু করেন। এর মধ্যে ব্যাংকঋণের কারণে মরিয়ম টেক্সটাইল, আরটেক্স ও নাজনীন ফ্যাব্রিকসের আর্থিক অবস্থা ক্রমেই দুর্বল হতে থাকে। তখন এসব প্রতিষ্ঠান ভাড়ায় নেন নুরুল ইসলাম। শুরুতে মশারি ও গেঞ্জির কাপড় তৈরি করতেন। ১৯৭৬ সালে পাওনা ঋণ আদায়ে এসব কারখানা একে একে নিলামে তোলে ব্যাংক। নিলামে অংশ নিয়ে যন্ত্রপাতিসহ কারখানাগুলো কিনে নেন নুরুল ইসলাম। শুরুতে শ্রমিক ছিল ২২ জন। বর্তমানে তার গড়ে তোলা নোমান গ্রুপের কর্মীর সংখ্যা ৮০ হাজারের বেশি।

১৯৭৬ সাল থেকে ব্যবসা শুরু হলেও নোমান গ্রুপের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৭ সালে। প্রতিষ্ঠার ১৩ বছর পর ২০০০ সালে এসে আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি শুরু করে নোমান গ্রুপ। বর্তমানে গ্রুপটির ফ্ল্যাগশিপ প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ এশিয়ায় হোম টেক্সটাইল পণ্যের বৃহত্তম রফতানিকারক জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফ্যাব্রিকস লিমিটেড। 

জাবের অ্যান্ড জোবায়ের থেকে বর্তমানে ১৮-২০ ধরনের পণ্য যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পণ্যের বড় ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে আইকিয়া, এইচঅ্যান্ডএম, ওয়ালমার্ট, টার্গেট, কেমার্ট, ক্যারিফোর ইত্যাদি।

নোমান গ্রুপের আওতাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে আইএসএ ওয়াশিং লিমিটেড, ইসমাইল স্পিনিং মিলস লিমিটেড, মরিয়ম টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, নাইস ফ্যাব্রিক প্রসেসিং লিমিটেড, নাইস ডেনিম মিলস লিমিটেড, নাইস মাইক্রোফ্যাব লিমিটেড, নাইস স্পিনিং মিলস লিমিটেড, নাইস সিনথেটিক ইয়ার্ন মিলস লিমিটেড, নোমান ফ্যাব্রিকস লিমিটেড, নোমান হোমস টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, নোমান নিট কম্পোজিট মিলস লিমিটেড, নোমান টেরি টয়েলস মিলস লিমিটেড, নোমান টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, সাদ সান অ্যাপারেল লিমিটেড, সুফিয়া কটন মিলস লিমিটেড, সুফিয়া ফ্যাব্রিকস লিমিটেড, তালহা ফ্যাব্রিকস লিমিটেড, তালহা স্পিনিং মিলস লিমিটেড, তালহা টেক্স প্রো লিমিটেড, জাবের অ্যান্ড জোবায়ের অ্যাকসেসরিজ লিমিটেড, জাবের স্পিনিং মিলস লিমিটেড, জারবা টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, জোবায়ের স্পিনিং মিলস লিমিটেড।

দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রায় ৩৫টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) থেকে ঋণ নিয়েছে নোমান গ্রুপ। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে ঋণ রয়েছে গ্রুপটির। গ্রুপটিকে ঋণ দেয়ার তালিকায় রয়েছে অন্তত ২৫টি বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংকও। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ আছে এমন একটি ব্যাংক হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। নোমান গ্রুপের কাছে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৫১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফান্ডেড ঋণ ৯৭৫ কোটি এবং ১ হাজার ৭৬ কোটি টাকার নন-ফান্ডেড ঋণ রয়েছে।

নোমান গ্রুপকে ঋণ দেয়ার ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা বলছেন, দেশে বেসরকারি খাতের বিকাশ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রফতানি আয় বৃদ্ধিতে নোমান গ্রুপের বড় ভূমিকা রয়েছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোও পর্যাপ্ত জামানতের কথা চিন্তা না করেই ঋণ দিয়েছে। এতদিন গ্রুপটির ঋণ নিয়ে ব্যাংকারদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নোমান গ্রুপের ব্যবসায়িক পরিস্থিতি ভালো যাচ্ছে না। গ্রুপটির বার্ষিক টার্নওভার কমার পাশাপাশি নগদ অর্থের প্রবাহ কমছে। এ কারণে গ্রুপটি ঋণের কিস্তি যথাসময়ে পরিশোধ করতে পারছে না। দেশের অন্তত ছয়টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী প্রায় একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন। তবে ব্যবসায়িক সম্পর্কের কথা বিবেচনায় রেখে নিজেদের নাম উদ্ধৃত করে বক্তব্য দিতে চাননি। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করেও নোমান গ্রুপের ঋণ নিয়ে প্রায় একই ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। পর্যালোচনায় দেখা যায়, নোমান গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির ঋণের একটি অংশ ওভারডিউ (মেয়াদোত্তীর্ণ) হয়ে গেছে। যেমন জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফ্যাব্রিকস লিমিটেডের ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৭ কোটি টাকা ওভারডিউ। একইভাবে অন্য কোম্পানিগুলোর ঋণের কিস্তিও অনিয়মিত হয়ে যাচ্ছে।

নোমান গ্রুপ সম্পর্কে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌নোমান গ্রুপ বাংলাদেশকে অনেক কিছু দিয়েছে। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রফতানি আয় দেশে আনার ক্ষেত্রে গ্রুপটির ভূমিকা অতুলনীয়। বিশ্বের সর্ববৃহৎ হোম টেক্সটাইল তারা তৈরি করেছে। নানা কারণে বিশ্বের স্বনামধন্য কোম্পানিগুলোও এখন ব্যবসায়িক দিক থেকে চাপে আছে। গ্রুপটির ক্ষেত্রেও বিষয়টি তেমনই। তবে আমরা আশা করছি, দ্বিতীয় প্রজন্মের হাত ধরে নোমান গ্রুপ তার ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির পথে ফিরে আসবে।’

এখন পর্যন্ত নোমান গ্রুপের ঋণখেলাপি হওয়ার ঘটনা ঘটেনি জানিয়ে গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ইসলাম বণিক বার্তা বলেন, ‘‌এখন যেভাবে চলছে তাতে সন্দেহ হচ্ছে হবে। কারণ আমাদের অর্থায়ন দরকার। ব্যাংকগুলো ১০-১২ বছর আগে যখন ঋণ দিয়েছিল, তখন ডলার ছিল ৬৮ টাকা। এখন হয়ে গেছে ১০৭ টাকা। ১০০ টাকা বিনিয়োগ করলে এখন দরকার ১৪০ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী আগে ১০০ টাকার ৫০ শতাংশ অর্থায়ন পাওয়া যেত, এখন পাওয়া যাচ্ছে ২৫ শতাংশ। একটা গ্রুপকে এখন ২৫ শতাংশ দিতে পারছে ব্যাংক, ১০ শতাংশ ফান্ডেড, ১৫ শতাংশ নন-ফান্ডেড। সীমা কমিয়ে দেয়ায় ব্যাংকে তারল্য থাকলেও তারা দিতে পারছে না। ঋণ এক্সপোজারের যে সীমা আছে তা অতিক্রম হলে ব্যাংক আর দিতে পারছে না। আগে তুলার দাম ছিল ৪৮ থেকে ৫০ সেন্ট। গত বছর দেড় ডলার হয়ে গেছে। ৫০ সেন্টের রানিং ক্যাপিটাল দিয়ে দেড় ডলারের পণ্য কীভাবে আনা সম্ভব। এর প্রভাবে যেটা হয়েছে আগে ৩ পাউন্ড তুলা পাওয়া গেলে এখন ১ পাউন্ড তুলা আনতে হচ্ছে। বেশি আনতে হলে বিদেশী মুদ্রায় ঋণ হয়েছে, যেমন ইউপাস করা হয়েছে, নয়তো সাপ্লাইয়ার ক্রেডিট নেয়া হয়েছে। সাপ্লাইয়ার ক্রেডিটে ইন্টারেস্ট হয়ে গেছে ১০-১২ শতাংশ। ইডিএফ এখন পাওয়া যাচ্ছে না আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের কারণে।’

তিনি আরো বলেন, ‘‌আমাদের গ্রুপের ঋণ আছে ৮ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। প্রকল্প বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যাংক রয়েছে ৩০টির মতো। আমার ব্যাংকিং এবং ব্যবসার বয়স ৫৩ বছর। বর্তমানের মতো পরিস্থিতি কখনো দেখতে হয়নি। বিগত সময়গুলোয় আমরা ক্রমাগতভাবে বিনিয়োগ বাড়িয়েছি। ১০০ টাকা লাভ হলে ব্যাংক থেকে ১০০ টাকা নিয়ে প্রকল্প সম্প্রসারণে বিনিয়োগ করেছি। আমার সমস্যা হলে অবশ্যই ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সবার সমস্যা। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের মেয়াদি ঋণের মধ্যে প্রায় ২ থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা ইমিডিয়েট রিস্কের মধ্যে রয়েছে।’

নুরুল ইসলাম বলেন, ‘‌২০২৪ সাল পর্যন্ত ব্লক অ্যাকাউন্টে রাখার সুবিধা আমরা ব্যাংকের কাছে চেয়েছি। কিন্তু ব্যাংকের সক্ষমতা নেই। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতির বিষয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি বলে তাহলে ব্যাংক আমাদের সুবিধা দিতে পারবে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকেও চিঠি দিয়েছি। বর্তমানে রফতানি আছে বলেই ডলারের চাপটা মোকাবেলা করা যাচ্ছে। কিন্তু আমার ১০০ টাকা রফতানির বিপরীতে ৭০-৭৫ টাকার আমদানি দায় রয়েছে। রফতানির বিপরীতে টাকা নগদ করে বিদ্যুৎসহ অন্যান্য পরিষেবা বিল ও বেতন-বোনাস দিতে হয় ২৫ টাকা। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব হয়ে উঠছে না। প্রতি মাসে ৪০ কোটি টাকার মতো লোকসান হচ্ছে ব্যবসায়। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে আমরা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছি। আমাদের সমস্যাটা তীব্র হতে শুরু করেছে গত এপ্রিল থেকে। এর আগে মোটামুটি চলছিল। কিন্তু এপ্রিল থেকে ক্রয়াদেশে পতন ঘটেছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন