ধোলাইখাল জলাধার সবুজায়ন প্রকল্প

পরিবেশের চেয়ে বাণিজ্যে বেশি প্রাধান্য দেয়ার অভিযোগ

আল ফাতাহ মামুন

রাজধানীর অন্যতম জলাধার ধোলাইখাল ঘিরে উন্নয়নকাজ শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকা সিটি নেইবারহুড আপগ্রেডিং প্রজেক্টের (ডিসিএনইউপি) অধীনে ধোলাইখাল জলাধারের উন্নয়নকাজ শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ‘‌ধোলাইখাল জলাধার সবুজায়ন ও নান্দনিক পরিবেশ উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় উন্নয়ন করা হচ্ছে পুরান ঢাকার অন্যতম জলাধারটির। 

প্রকল্পের নকশা পর্যালোচনার ভিত্তিতে নগরবিদ ও স্থপতিরা বলছেন, ধোলাইখাল জলাধারের মতো এত ছোট্ট জায়গায় অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো বেশি রাখা হয়েছে। নান্দনিক পরিবেশ ও সবুজায়নের কথা বলা হলেও এতে পরিবেশের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে বাণিজ্যকে। এতে জলাধারের উন্নয়নের সুফল থেকে নগরবাসী তো বঞ্চিত হবেই, পুকুরের পানি পরিষ্কার রাখার নামে দীর্ঘমেয়াদি খরচের ফাঁদও তৈরি হবে। সরকারি অর্থ ব্যয়ে এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের বিষয়ে ডিএসসিসির আরো ভাবার অবকাশ আছে।

ধোলাইখাল জলাধারের উন্নয়ন প্রকল্পের নকশা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রকল্পের যাবতীয় কাজ করা হবে পাঁচ একর জায়গার মধ্যে। এর মধ্যে হাঁটার পথ ১ হাজার ৯৬৮ ফুট, সাইকেল লেন ২ হাজার ১৫৫ ফুট, সবুজায়ন ৬০ হাজার ফুট, অ্যাম্ফিথিয়েটার দুটি, শৌচাগার দুটি, ঘাট একটি, শিশুদের খেলার জায়গা ২ হাজার ১৩০ বর্গফুট ও ঝরনা চারটি। এর সঙ্গে থাকব কিয়স্ক বা ছোট খাবার দোকান। 

ছোট খাবারের দোকান কয়টি থাকবে এ বিষয়ে নকশায় স্পষ্ট করে কিছু লেখা নেই। এ প্রসঙ্গে জানতে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একজনের সঙ্গে কথা বলা হয়। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে তিনি বলেন, ‘‌চার থেকে ছয়টি খাবারের দোকান করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। খাবারের দোকান কয়টি হবে, তা প্রকল্পের কাজ শেষ হলে বোঝা যাবে।’

নগরবিদরা বলছেন, এত ছোট জায়গায় এ ধরনের নকশা ব্যয়বহুল। শুধু তাই নয়, পরিবেশের উন্নয়নের নাম দেয়া হলেও আসলে বাণিজ্যিক নকশা প্রণয়ন করেছে ডিএসসিসি। 

ধানমন্ডি লেক, হাতিরঝিলসহ ঢাকার অনেক পার্ক ও লেকের নকশা প্রণয়ন করেছেন নগরবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব। ধোলাইখাল জলাধার সংরক্ষণের নকশা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‌এত ছোট জায়গায় সাইকেল লেনের কোনো প্রয়োজন নেই। এখানে দুটি শৌচাগারও অপ্রয়োজনীয়। জলাধারের পাশেই সাদেক হোসেন খোকা মাঠ আছে। সেখানেও শৌচাগার আছে। তবুও এখানে ১ হাজার ১০৮ বর্গফুট এবং ১ হাজার বর্গফুটের দুটি শৌচাগার নির্মাণ করা অনর্থক হবে। বড়জোর একটি শৌচাগার হতে পারে। না হওয়াই ভালো।’ 

ইকবাল হাবিব বলেন, ‘‌নকশায় দুটি অ্যাম্ফিথিয়েটার দেখছি। এ দুটোই অপ্রয়োজনীয়। অ্যাম্ফিথিয়েটার বা খাবারের দোকান এগুলো তো বাণিজ্যিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। অথচ এখানে পরিবেশকে গুরুত্ব দেয়ার কথা। সেটা তো স্পষ্ট করে বলা নেই। সবুজায়ন মানে গাছ লাগানো। ঘাস দিয়ে সবুজায়ন হয় না এটা প্রকল্পের লোকদের বুঝতে হবে। আর অ্যাম্ফিথিয়েটার তো তাপ নিরোধক না। তাহলে দুটো কেন বানানো হচ্ছে?’

এছাড়া ধোলাইখাল সবুজায়নের জন্য প্রকল্পটি নেয়া হলেও আদতে ধোলাইখালের সীমানাই এখনো নির্ধারণ করতে পারেনি ডিএসসিসি। সংস্থাটি ধোলাইখাল সবুজায়নের নামে শুধু পুকুর উন্নয়ন করছে বলে অভিযোগ তুলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘‌খাল উদ্ধার না করলে আশপাশের সব ময়লা পানি এ পুকুরে এসে জমা হবে। তখন পুকুরের পানি পরিষ্কার করার জন্য আরেকটি খাতে ব্যয় বাড়বে ডিএসসিসির। ধোলাইখাল উদ্ধার না করে পুকুর উন্নয়ন করা একটি অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত।’

ঢাকার খাল ও জলাধার নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণা করেছেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান  মোহাম্মদ এজাজ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌পরিবেশ উন্নয়নের কথা বলা হলেও নকশায় ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি পরিষ্কার। ধোলাইখাল উদ্ধার না করলে ময়লা পানি এ পুকুরে এসে পড়বে। তখন নগরবাসীর কোনো উপকার হবে না। দেখা গেল যারা দোকান ভাড়া নিয়েছে, শুধু তারাই লাভবান হয়েছে। শুধু দোকান বা অ্যাম্ফিথিয়েটার করা তো এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য না। সিটি করপোরেশনকে নিশ্চিত করতে হবে এখানে যাতে বেশি বেশি গাছ লাগানো হয়। এবং এর মাধ্যমে পুরান ঢাকার মানুষকে তাপপ্রবাহ থেকে মুক্তি দিতে এ জলাধার কার্যকরী ভূমিকা রাখে।’

ধোলাইখাল জলাধারটি মূলত পানি জমা হওয়ার জায়গা। সংস্কারের পর এখানে কত বেশি পরিমাণ পানি জমা হবে সেটি নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত নকশায় হাঁটাপথের পাশাপাশি বাইসাইকেল লেনের ডিজাইন করা হয়েছে। গণপরিসর হিসেবে এ জলাধারের আকার বিবেচনায় ও পরিকল্পনাগত কারণে বাইসাইকেল লেন প্রাসঙ্গিক নয়। এটি জলাধারের পাশে কংক্রিটের আচ্ছাদন বাড়াবে, যা নগরে তাপ বৃদ্ধির কারণ হবে। একই সঙ্গে মাত্র পাঁচ একর এলাকায় দুটো অ্যাম্ফিথিয়েটারের প্রয়োজন নেই। এ জলাধারের মূল কাজ পানি ধারণ করা, এটা যাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়। একই সঙ্গে বৃক্ষের আচ্ছাদন বাড়িয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টির দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো যুক্ত করে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোও কোনোভাবেই ঠিক হবে না।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে প্রকল্প পরিচালক ও ডিএসসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম ও প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছেরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন