বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত

প্লাস্টিক দূষণ রোধে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা হোক

গতকাল পালিত হলো বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিক দূষণের সমাধানে শামিল হই সকলে’ এবং স্লোগান হচ্ছে ‘সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ’। বিশ্বে প্লাস্টিক দূষণ ভয়াবহ মাত্রা ধারণ করেছে। ফেলে দেয়া বা ব্যবহার করা প্লাস্টিক থেকে বেশ ভালো মাত্রায় দূষণ ছড়ায়। এটি সাধারণত মাটির সঙ্গে মেশে না। প্লাস্টিকে একধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ক্যান্সার, কিডনির জটিলতা, উচ্চরক্তচাপসহ নানা ধরনের ব্যাধির অন্যতম কারণ প্লাস্টিক। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগের পরিবর্তে জৈব পচনশীল পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। 

পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাত ও ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও প্রশাসনের নাকের ডগায়ই সবকিছু চলছে প্রকাশ্যে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশে প্রতিদিন প্রায় ২৪ হাজার টন বর্জ্য তৈরি হয়, যার মধ্যে সাড়ে ৮ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য। সে হিসাবে প্রতিদিন দুই হাজার টন আর মাসে ৬০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর দুই হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক কাঁচামাল আমদানি করা হয়। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) তথ্য মতে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর ৫০ হাজার কোটি প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরি করা হয়। প্রতি বছর সারা বিশ্বে ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য কখনো পচে না, যার কারণে এ প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি করছে। প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা মাছ পশুপাখির মাধ্যমে খাদ্যচক্রে ঢুকে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। একই সঙ্গে জমির উর্বরতা নষ্ট করছে। পানি নিষ্কাশনের পথও রুদ্ধ করছে এই প্লাস্টিক বর্জ্য। এদিকে পরিবেশদূষণ রোধে প্লাস্টিকের বেআইনি উৎপাদন, বাজারজাত ও ব্যবহার রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা। জার্মানভিত্তিক সংস্থাটি বলেছে, বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ২০০২ সালে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন করা হলেও কার্যকর প্রয়োগের অভাবে এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এসব পণ্য আমদানি, ব্যবহার বিষয়ে সরকারকে কঠোর হতে হবে। 

পলিথিনের দূষণ প্রতিরোধে আইন তৈরি করা হলেও তার কার্যকারিতায় সফলতা দৃশ্যমান হচ্ছে না, নাগরিকদের অসচেতনতার কারণে। পরিবেশ সুরক্ষার কর্মসূচিতে ব্যাপক হারে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারা জনসচেতনতার পরিধি বাড়াতে না পারার কারণে। ব্যাপক হারে সচেতনতা তৈরি করতে না পারলে পৃথিবীকে ভবিষ্যতে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না, তাতে বিজ্ঞানীরা একমত। আমাদের প্রত্যেক পরিবারকে বাজার করতে হয়। সেখানে ফ্রিতে দেয়া পলিথিন ব্যাগের কারণে, আমাদের ব্যক্তিগত সামান্য সুবিধা নিতে ও অসচেতনতার কারণে পরিবেশকে তথা আমাদের বাস করা আশপাশের জায়গাকে কী দুর্বিসহ করে তুলি তার বিষয় সামনে আসলে বোঝা যায়। আইনে নিষিদ্ধ থাকলেও পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতার অন্যতম কারণ এ পলিথিনের ব্যবহার থামানো যেমন যায়নি, তেমনি তার ব্যবহার কমানোও যায়নি, বরং দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। দেখা যায় বসতবাড়ির বর্জ্যের সঙ্গে ফেলে দেয়া অপচনশীল এই পলিথিনই পরিবেশকে দূষণ করার ও ঝুঁকিতে ফেলার অন্যতম কারণ। বাজার করায় তিল পরিমাণ বা নগণ্য সুবিধার জন্য ব্যবহার করা পলিথিন যুগ যুগ ধরে মাটির নিচে থেকে গিয়ে মাটি ও পরিবেশকে দূষণ করে যায়, উৎপাদনশীলতা কমাতে থাকে, তেমনি সেই পলিথিন ড্রেন নালায় জমে নাগরিক জীবনকে দুর্বিসহ করে যাচ্ছে। আমরা তাই নীরব থাকলে হবে না, এই ভয়াবহতার দূষণ থেকে মুক্তির জন্য, আমরা আমাদের প্রত্যেককে এই বিশ্বের পরিবেশ সুরক্ষার জন্য কিছু না কিছু বিনিয়োগ করতে হবে।

প্লাস্টিক দূষণ রোধে দশ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বন্ধে তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। নিষিদ্ধকৃত পলিথিন শপিং ব্যাগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে জানুয়ারি ২০১৯ থেকে এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ৩ হাজার ৬৯২টি মামলা দায়ের, ৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা জরিমানা আদায়, ১ হাজার ৭৬৩ টন পলিথিন জব্দ ও ১৬৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সুন্দরবনসহ অন্যান্য বনভূমিতে যাতে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক দ্বারা কোনো দূষণ না হয় সে বিষয়ে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সুষ্ঠুভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০২১ প্রণয়ন করা হয়েছে। সম্প্রতি পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় আইন ও বিধিমালার কোনো অভাব নেই, কিন্তু এর সঠিক প্রয়োগ নেই। যে কারণে পলিথিন নিষিদ্ধ হলেও বাজারে এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। আইন প্রণয়নের পাশাপাশি তার যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। 

বাজেটে পরিবেশের জন্য বরাদ্দ সামান্য বাড়লেও পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্ষমতা ও অঙ্গীকার বাড়ানো ছাড়া এ বাজেট বৃদ্ধি জনগণের কোনো কাজে লাগবে না। পরিবেশগত কর্মদক্ষতার দিক থেকে ১৮০টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১৭৯তে রেখে টেকসই উন্নয়নের দাবি বেমানান। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে পরিবেশ রক্ষার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার আদায় করে নিতে হবে পরিবেশকর্মীদের। যে উন্নয়ন বন উজাড় করে; নদী হত্যা করে; বাতাস আর মাটি বিষাক্ত করে, সে উন্নয়ন আত্মঘাতী। প্রকৃতি ধ্বংসের প্রক্রিয়া থেকে সরে আসতে হবে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্য বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এক হচ্ছে বিশ্বকে প্লাস্টিক দূষণমুক্ত করতে। প্লাস্টিক রোধে হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইন। ২০২৩ সালের পরিবেশ দিবসে আদালতের আদেশ মেনে এবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করবে এবং প্লাস্টিকবিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের নেতৃত্ব বলিষ্ঠ হবে, সেটিই প্রত্যাশা।

শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে পরিবেশের ভারসাম্য ধরে রাখার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে ভূমিকা পালন করতে হবে। যদি পরিবেশ ভালো থাকে, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাস্থ্যঝুঁকি কমবে বলে আশা করা যায়। ফলে মানুষ ফুসফুসের বিভিন্ন জটিল রোগ থেকে মুক্তি পাবে। সুস্থ পরিবেশ গড়ার জন্য জরুরি পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হওয়া। পরিবেশ বাঁচানোর প্রথম পদক্ষেপ আমাদেরই নিতে হবে। প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করে সামাজিক বনায়ন সৃষ্টি করতে হবে। ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। এছাড়া বায়োটেকনোলজি প্রযুক্তির সাহায্যে সুপার ফাংশনাল ব্যাকটেরিয়া উৎপাদন করে বর্জ্য বা আবর্জনাকে দ্রুত পচনশীল করার মাধ্যমে সার্বিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করা যেতে পারে। 

দুঃখজনক হলেও সত্য যে পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত কয়েকটি শহরের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে আছে আমাদের ঢাকা। ঘর থেকে বের হলেই আমাদের মুখোমুখি হতে হয় ভয়ানক ক্ষতিকর পরিবেশের সঙ্গে। এ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য শিল্প-কারখানাই বেশি দায়ী। এছাড়া বিজ্ঞানীরা আটটি শীর্ষ কার্বন নির্গমনকারী খাত চিহ্নিত করেছেন, যা পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। কারণ প্লাস্টিকের ব্যাগ শতকরা ১০০ ভাগই কৃত্রিম পলিথিনের, যা জীবাশ্মের অপরিশোধিত তেল থেকে তৈরি। এগুলো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে অন্তত ৫০০ থেকে ৬০০ বছর সময় লাগবে, যা মানবজীবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য হলেও এ দূষণ থেকে নিজেদের ও দেশকে রক্ষা করতে হবে। 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন